প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ সম্পন্ন হয়েছে । কোটি কোটি ভক্ত তাদের বিশ্বাস অনুসারে ত্রিবেণীতে স্নান করে নিরাপদে বাড়ি ফিরেছেন। এই সময়ের মধ্যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যা কিছু জ্বলন্ত প্রশ্ন রেখে গেছে। ২৮-২৯ জানুয়ারী রাতে প্রয়াগরাজে পদদলিত হওয়ার প্রথম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি প্রকাশ পায়, যেখানে সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা ৩০ জন। দ্বিতীয় মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ১৫ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে, যেখানে ১৮ জন তীর্থযাত্রী নিহত হন। এই দুর্ঘটনাগুলো কি রোখা যেত? যদি তাই হয়, তাহলে এর জন্য দায়ী কে? সরকার? ভক্তরা? নাকি দুপক্ষ ? প্রকৃতপক্ষে, এই দুর্ঘটনাগুলির একটি বড় কারণ হল প্রশাসন এবং তীর্থযাত্রীদের, দেশের পরিবর্তিত মানসিকতাকে লক্ষ্য না করা এবং আত্মীকরণ করতে ব্যর্থতা।
এবার কেন এত বিপুল সংখ্যক ভক্ত মহাকুম্ভে এসেছিলেন? এর প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে- অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নিজের পরিচয় সম্পর্কে সচেতনতা এবং নিরাপত্তার অনুভূতি। স্বাধীনতার ৬০ বছর ধরে, একজন সাধারণ হিন্দু, যাকে ‘হিন্দু বৃদ্ধির হার’ বলে অপমান করা হয়েছিল, সে তার বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করেছে। অষ্টম শতাব্দী থেকে হিন্দু ধর্মলম্বীরা ক্রমাগত ইসলামী আক্রমণকারীদের দ্বারা ধর্মীয় আক্রমণের শিকার হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে তরবারির জোরে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, হিন্দু ধর্মলম্বীদের উপশনাস্থল এবং মন্দিরগুলি (অযোধ্যা, সোমনাথ, কাশী, মথুরা সহ) মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল । এই সময়ে পবিত্র শহরগুলি – অযোধ্যা, কাশী, মথুরা, কাটাসরাজ, হরিমন্দির সাহেব, সারনাথ, বোধগয়া এবং শারদা শক্তিপীঠ ইত্যাদি হয় ধ্বংস করা হয়েছিল অথবা অপবিত্র করা হয়েছিল। এরপর আসা ইউরোপীয় আক্রমণকারীরা তাদের অনেক কৌশলের মধ্যে একটি – ‘ম্যাকোলে শিক্ষা ব্যবস্থা’ – দিয়ে সনাতনীদের মধ্যে তাদের বিশ্বাস-আত্মপরিচয়ের প্রতি হীনমন্যতা ভরিয়ে দিতে শুরু করে।
১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে রক্তক্ষয়ী দেশভাগ এবং ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর, আশা করা হয়েছিল যে গান্ধী-প্যাটেলের নেতৃত্বে যেমন সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ শুরু হয়েছিল, তেমনই অযোধ্যা, কাশী, মথুরা এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলির পুনরুদ্ধার সম্পন্ন হবে এবং হিন্দুরা আবার তাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত হবে। কিন্তু তা ঘটেনি, কারণ পণ্ডিত নেহরুর কাছে সেইসব হিন্দুরা ‘সাম্প্রদায়িক’ ছিল , যারা তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের উপর গর্ব বোধ করতো । গত দশকে সকল ধরণের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পরে, হিন্দু সম্প্রদায় আগের চেয়েও বেশি সচেতন হয়েছে এবং তাদের সনাতনী পরিচয় সম্পর্কে সোচ্চার। অষ্টম শতাব্দীর পর, এই প্রথম সনাতনীরা তাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পেয়েছে।
কুম্ভ কেবল একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের উৎসব নয়, এটি মানুষকে সনাতনের বিশাল ও সামগ্রিক রূপের সাথে সংযুক্ত করার একটি সঙ্গম, যার মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি-বিশ্বের বহুত্ববাদ-অন্তর্ভুক্তি এবং সকলের কল্যাণের অনুভূতি। ত্রিবেণী সকল সনাতনীদের জন্য। এতে জাত -পাতের কোন স্থান নেই। কুম্ভ হল ঐশ্বরিক শক্তির একটি পবিত্র সমষ্টি, যেখানে সূর্য যখন মকর রাশিতে এবং বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে প্রবেশ করে তখন, ঐশ্বরিক শক্তির একটি চমৎকার সংযোগ তৈরি হয়। প্রয়াগরাজ ভ্রমণের সময় জুনা আখড়ার আচার্য মহামণ্ডলেশ্বর স্বামী অবধেষানন্দ গিরিজি মহারাজের কাছে যখন একজন কৌতূহলী ভদ্রলোক, স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর কোন দেবতার উপাসনা করা উচিত, তখন তাঁর উত্তর ছিল যে তিনি গ্রামদেবতা, কুলদেবী এবং পূর্বপুরুষদের পরে যে কোনও দেবতার উপাসনা করতে পারেন। তিনি তার ইষ্টদেবতা তার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। এটিই সনাতন সংস্কৃতির মৌলিক চরিত্র, যেখানে চিন্তাভাবনা এবং মতবিনিময়ের স্বাধীনতা রয়েছে, সনাতনীরা ‘আমি সত্য, তুমি মিথ্যা’ এই সংকীর্ণ ধারণা থেকে মুক্ত।
সমাজের পরিবর্তিত চিন্তাভাবনার প্রতি লক্ষ্য রেখে, কেন্দ্র এবং উত্তরপ্রদেশ সরকার যৌথভাবে মহাকুম্ভের জন্য ১২,০০০ কোটি টাকারও বেশি বাজেট বরাদ্দ করেছে এবং এর সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে অভূতপূর্ব ব্যবস্থা করেছে। আমাদের এটা মানতে হবে যে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, এই সাংস্কৃতিক চেতনা এবং বিশ্বাসের জোয়ারের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এটিকে প্রত্যাশিত মনোভাবের বিপরীতে একটি নিয়মিত দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন, তাই অনেকেই তাদের কর্তব্যের প্রতি উদাসীন ছিলেন এবং হয়তো কিছু কর্মকর্তা, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ-এর ব্যবস্থা করতে গিয়ে, মানসিক চাপের ফলে কখনো কখনো কাজের উপর বিরক্ত হয়েছিলেন।
এমনকি অনেক হিন্দু, যারা তাদের সংস্কৃতির উপর গর্বিত, তারা বুঝতেও পারেনি, যে উৎসাহের পাশাপাশি শৃঙ্খলা এবং নাগরিক কর্তব্যও প্রয়োজনীয়। তাদের উচিত ছিল অনিয়ন্ত্রিত ভিড়ের পরিবর্তে, নিয়ম অনুযায়ী ও সুশৃঙ্খলভাবে আস্থাবান তীর্থযাত্রী মত মহাকুম্ভ অথবা তাদের অন্যান্য পবিত্রস্থানে দর্শন করা । তীর্থস্থানগুলিতে দুর্ঘটনা কেবল ভারতেই ঘটে তা নয়। মক্কায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও হজযাত্রার সময় আটটিরও বেশি পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই দুর্ঘটনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ঘটনাটি ছিল ২০১৫ সালে, যেখানে ২,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। একইভাবে ২০১৬-২৪ সালের মধ্যে, নাইজেরিয়ার গির্জাগুলিতে বেশ কয়েকটি তাণ্ডবের ঘটনায় ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

কিছু স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মহাকুম্ভকে উপহাস করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— “গঙ্গায় স্নান করলে কি দারিদ্র্য দূর হবে, ক্ষুধা মিটবে?” প্রথমত, মহাকুম্ভ বা ধর্ম সম্পর্কিত কোনও অনুষ্ঠান, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির অংশ নয়। ক্ষুধার কথা বলতে গেলে, মহাকুম্ভে ৫০০ টিরও বেশি ছোট-বড় (বিনামূল্যে সহ) ভান্ডার চলছে। এর আগে, ২০১৩ এবং ২০১৯ সালে যথাক্রমে ১২ কোটি এবং ২৪ কোটি ভক্ত কুম্ভমেলায় এসেছিলেন। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (CII) অনুসারে, ২০১৯ সালের প্রয়াগরাজ অর্ধকুম্ভ অনুষ্ঠান ঘিরে সরকার ১.২ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছিল এবং ৬ লক্ষেরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল । এই মহাকুম্ভে ৬৩.৩৬ কোটিরও বেশি ভক্ত স্নান করেছেন। তারা অতি দরিদ্র থেকে শুরু করে ধনী পর্যন্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েক কোটি সনাতনী অযোধ্যা-কাশী দর্শন করতে গিয়েছিলেন।
যদি প্রতিটি মধ্যবিত্ত তীর্থযাত্রী গড়ে ৪,০০০-৫,০০০ টাকা খরচ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় অর্থনীতি এবং এর সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা কতটা উপকৃত হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
প্রয়াগরাজ, কাশী বা অযোধ্যা সহ অন্যান্য তীর্থস্থানগুলি কোনও সাধারণ শহর নয় এবং এগুলি কেবল আবাসন, পর্যটন বা কর্মসংস্থানের মাধ্যমও নয়। পর্যটনের দিক থেকে, দিল্লি, জয়পুর এবং আগ্রাকে ঐতিহ্যগতভাবে ‘স্বর্ণ ত্রিভুজ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সনাতনী ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রয়াগরাজ, কাশী এবং অযোধ্যাকে ভারতের ‘আধ্যাত্মিক ত্রিভুজ’ হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। এই অঞ্চলগুলির পরিকাঠামো এমনভাবে বিকশিত করা উচিত যাতে এই শহরগুলির কালজয়ী আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক সারাংশ অক্ষুণ্ণ থাকে।
লেখক : বলবীর পুঞ্জ ( বাংলা ভাবার্থ : হিমাদ্রি – বিচার বিনিময় ন্যাস , দিল্লি )
