বেআইনি নিয়োগের জন্য সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’র থেকে ১৫ কোটি টাকা চেয়েছিলেন জনৈক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়! প্রাথমিকের নিয়োগ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটে এক অডিয়ো ক্লিপের ভিত্তিতে এমনই দাবি করেছে সিবিআই। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মানিক ভট্টাচার্যের নামও উল্লেখ করতে শোনা গিয়েছে ওই অডিয়ো ক্লিপে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তাদের চার্জশিটে জানিয়েছে, ঘুষের টাকা দিতে ২০১৭ সালে বেহালায় ‘কাকু’র বাড়িতে গিয়েছিলেন অপর দুই অভিযুক্ত কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ আরও দু’জন। সিবিআইয়ের দাবি, ওই সময়ে তাঁদের কথোপকথনের একটি অডিয়ো ক্লিপ তদন্তকারীদের হাতে এসেছে। কী ভাবে বেআইনি নিয়োগ চলত, এই চক্রে কারা ছিলেন, তা নিয়ে আলোচনা ওই অডিয়ো ক্লিপে রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে চার্জশিটে।
অডিয়ো ক্লিপটি কী ভাবে পেলেন তদন্তকারীরা, তা-ও একটি অনুচ্ছেদ জুড়ে বিস্তারিত লেখা রয়েছে আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে। সিবিআইয়ের দাবি, ২০১৭ সালের ওই দিন কুন্তলের নির্দেশেই তাঁর বেতনভুক কর্মী অরবিন্দ রায়বর্মণ একটি মোবাইলে কথোপকথন রেকর্ড করেন। পরে তা ল্যাপটপে সরিয়ে রাখা হয়। তদন্তে নেমে ওই অ়ডিয়ো ক্লিপটি সিবিআইয়ের হাতে আসে। অডিয়ো ক্লিপটির ‘সত্যতা’ যাচাই করার জন্য সেটি সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্সেস ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছে সিবিআই। পাশাপাশি, সুজয়কৃষ্ণ, কুন্তল এবং শান্তনুর কণ্ঠস্বরের নমুনাও দিল্লিতে পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার জন্য। যদিও সাক্ষীদের মধ্যে কয়েকজন ওই অডিয়োর সত্যতার কথা স্বীকার করেছেন বলে সিবিআই সূত্রের খবর। সিবিআই চার্জশিটে জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ওইদিন ‘কাকু’র বাড়িতে কুন্তল এবং শান্তনুর সঙ্গে ছিলেন আরও দু’জন— অরবিন্দ এবং সুরজিৎ চন্দ। ঘটনাচক্রে, উভয়েই এই মামলার অন্যতম সাক্ষী। তাঁদের গোপন জবানবন্দিও সংগ্রহ করা হয়েছে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি বিচার ভবনে সুজয়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। সেই চার্জশিটে সিবিআই বিস্তারিত ভাবে এক ঘণ্টারও বেশি দৈর্ঘ্যের ওই অডিয়ো ক্লিপের কথোপকথনের বৃত্তান্ত জানিয়েছে। সিবিআইয়ের দাবি, অডিয়োয় জনৈক অভিষেকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনা গিয়েছে। কিন্তু কে সেই অভিষেক, কী তাঁর পরিচয়, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই ২৮ পাতার চার্জশিটে (তার প্রতিলিপি আনন্দবাজার অনলাইনের হেফাজতে রয়েছে)। রয়েছে শুধু নামটুকুই। যদিও বাকি অনেকের ক্ষেত্রে তাঁদের নামের সঙ্গে চার্জশিটে নির্দিষ্ট পরিচয়ের উল্লেখ করেছে সিবিআই। যেমন পার্থের ক্ষেত্রে তাঁর ‘প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী’ পরিচয় লিখেছে সিবিআই। সুজয়কৃষ্ণের পরিচয় দিয়েছে ‘লিপ্স এন্ড বাউন্ডস’-এর ‘চিফ অপারেটিং অফিসার’ হিসাবে। চার্জশিট অনুযায়ী, শান্তনু এবং সুজয়কৃষ্ণ একই দলের (অর্থাৎ তৃণমূলের) সদস্য ছিলেন। তার পরে লেখা হয়েছে, তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেস (যুবা)-এর সদস্য ছিলেন। সুজয়কৃষ্ণের ‘সাব-এজেন্ট’ হয়ে কাজ করতেন শান্তনু। তবে অভিষেকের ক্ষেত্রে সিবিআই কোনও পরিচয় চার্জশিটে দেয়নি। তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, না ব্যবসায়ী, নাকি শিক্ষা বা অন্য কোনও সরকারি দফতরের সঙ্গে যুক্ত, নাকি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত, সে বিষয়ে সিবিআই চার্জশিটে একটি শব্দও ব্যয় করেনি। শুধু নামটিই লিখেছে তারা।
সিবিআই চার্জশিটের ১২ নম্বর পাতায় লেখা হয়েছে, ওই অডিয়ো ক্লিপের কথোপকথনে সুজয়কৃষ্ণকে বলতে শোনা গিয়ছে, ইতিপূর্বে নিশ্চিত হয়ে যাওয়া বেআইনি নিয়োগের জন্য ১৫ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন অভিষেক। সুজয়কৃষ্ণ তখন বলেছিলেন, তিনি ওই টাকা দিতে অপারগ। কারণ, আগেই প্রার্থীপিছু সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সিবিআই চার্জশিটে লিখেছে, অডিয়ো ক্লিপে সুজয়কৃষ্ণকে বলতে শওনা গিয়েছে, তাঁর কথা শুনে ওই চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ আটকে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন অভিষেক। সুজয়কৃষ্ণ বলেছেন, অন্যথায় ওই প্রার্থীদের গ্রেফতার করিয়ে দেওয়া হবে। অথবা দূরে কোথাও নিয়োগ দেওয়া হবে।
চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, ওই অডিয়ো ক্লিপ থেকেই সিবিআই জানতে পারে, পার্থের মারফতই বেআইনি নিয়োগের ব্যবস্থা করতেন কুন্তল, শান্তনু এবং সুজয়কৃষ্ণ। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, তারা অ়ডিয়ো থেকে এ-ও জানতে পারে যে, বেআইনি নিয়োগের বিষয়ে অভিষেকের সঙ্গে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থের মনোমালিন্য চলছিল। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, সুজয়কৃষ্ণ, শান্তনু এবং কুন্তল মিলে আরও দু’হাজার চাকরিপ্রার্থীর থেকে নিয়োগের নামে টাকা তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। ওই চাকরিপ্রার্থীদের থেকে ১০০ কোটি টাকা তুলতে চাইছিলেন তাঁরা। চার্জশিটে সিবিআই দাবি করেছে, অডিয়ো ক্লিপ বলেছে, ওই টাকা থেকে পার্থ, মানিক এবং অভিষেককে ২০ কোটি টাকা করে দেওয়া হবে বলে ঠিক করেছিলেন সুজয়কৃষ্ণেরা। বাকি ৪০ কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার ছক কষেছিলেন।
আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে তদন্তকারী সংস্থার আরও দাবি, অডিয়ো ক্লিপে পাওয়া গিয়েছে হুগলি জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিষদের তৎকালীন সভাপতির প্রসঙ্গও। তাঁকে ফোন করে শান্তনু এক চাকরিপ্রার্থীকে হুগলির বলাগড়ে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেন তাঁর সঙ্গে। পরে তদন্তে দেখা গিয়েছে, চাকরিপ্রার্থীর তালিকায় ওই প্রার্থীর নামের সঙ্গে শান্তনুর মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।