প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভমেলা শেষ হতে চলেছে শিবরাত্রি তিথিতে। অর্থাৎ যাঁরা কুম্ভস্নান করবেন বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু যেতে পারেননি, তাঁদের হাতে সময় নেই বিশেষ। উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ (সাবেক ইলাহাবাদ)-এর ত্রিবেণি সঙ্গমে ২৬ ফেব্রুয়ারির শেষ শাহি স্নানে হয়তো যোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু তা বলে কি কুম্ভস্নানের ইচ্ছে পূরণ হবে না? প্রয়াগে কুম্ভস্নানের সুযোগ না থাকলেও ত্রিবেণি সঙ্গমে কুম্ভস্নান হতে পারে ঘরের কাছেই হুগলির ত্রিবেণীতে। যে ত্রিবেণীতে ৭০০ বছর আগেও কুম্ভস্নান হত। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাত ঋষির ইতিহাস।

কেন ত্রিবেণী?
তিন নদীর সঙ্গমস্থলকেই পবিত্র মনে করা হয় হিন্দু ঐতিহ্যে। সেই সূত্রেই প্রয়াগরাজে সঙ্গমকে তীর্থক্ষেত্র মানেন হিন্দুরা। কারণ, সেখানে গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতী একসঙ্গে এসে মিশেছে। একই ভাবে হুগলির ত্রিবেণীতেও পরষ্পরকে ছুঁয়ে রয়েছে তিন নদী— গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী! তাই প্রাচীনকালে হুগলির ত্রিবেণীকে ‘দক্ষিণ প্রয়াগ’ বলেও অভিহিত করা হত।

তফাৎ কোথায়
দু’টি জায়গাতেই তিন নদী ছুঁয়েছে পরস্পরকে। তা হলে প্রয়াগরাজের সঙ্গে ত্রিবেণীর পার্থক্য কোথায়? তফাৎ এটুকুই যে, প্রয়াগে তিন নদী পরস্পরের সঙ্গে মিশে জড়িয়ে গিয়েছে, তাই তিন নদীর ওই সঙ্গমকে বলা ‘যুক্তবেণি’। অন্য দিকে, হুগলির ত্রিবেণীতে পরস্পরকে ছুঁয়ে নিজের মতো মুক্ত হয়ে সাগরের পথ ধরেছে তিন নদী, তাই হুগলির তিন নদীর সঙ্গমস্থলকে বলা হয় ‘মুক্তবে্ণি’। এ ছাড়া প্রয়াগের ত্রিবেণির সঙ্গে হুগলির ত্রিবেণীর আরও একটি তফাৎ রয়েছে। প্রয়াগরাজে গঙ্গা-যমুনা দেখা গেলেও সরস্বতীর দেখা মেলে না। কারণ সেখানে সরস্বতী নদী অন্তঃসলিলা। হুগলির ত্রিবেণীতে সরস্বতী স্পষ্ট দৃশ্যমান। যমুনাও দেখা যেত একটা সময়ে। কিন্তু এখন তার দেখা পেতে গেলে যেতে হবে ত্রিবেণী থেকে আরও খানিক দূরে কল্যাণীর কাছাকাছি।

কুম্ভ মাহাত্ম্য
ত্রিবেণীর স্থানমাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘স্কন্দপুরাণ’-এ। সেখানে বলা হয়েছে, কুশদ্বীপের রাজা প্রিয়বন্তের সাত সন্তান— অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুস্মান, জ্যোতিস্মান, দ্যুতিস্মান, সবন এবং ভব্য সিদ্ধিলাভ করার জন্য প্রয়াগে যেতে না পেরে হুগলির ত্রিবেণীতেই স্নান করেছিলেন। একই বক্তব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় কানাডার ইতিহাসবিদ অ্যালান মরিনিসের লেখা ‘পিলগ্রিমেজ ইন দ্য হিন্দু ট্র্যাডিশন’ বইয়েও। সেখানে এ-ও বলা ছিল যে, রাজার ওই সাত সন্তান সিদ্ধিলাভের পর ত্রিবেণী সংলগ্ন সাতটি গ্রাম— বাসুদেবপুর, বাঁশবেড়িয়া, নিত্যানন্দপুর, কৃষ্ণপুর, দেবানন্দপুর, শিবপুর এবং বলদঘাটি, যাদের একত্রে ‘সপ্তগ্রাম’ বলা হত, সেখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে থাকতে শুরু করেন। পরবর্তী কালে ওই সপ্তগ্রামকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে ওঠে। সপ্তগ্রাম হয়ে ওঠে বাংলার অন্যতম বড় বন্দর। ত্রিবেণী সেই সময়েও হিন্দু তীর্থ হিসাবে খ্যাত ছিল। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, শাক্ত সাহিত্যে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। স্থানীয় ইতিহাস বলছে, গঙ্গাসাগরের মেলা শেষে এই হুগলির ত্রিবেণীতেই মাঘী পূর্ণিমায় কুম্ভস্নান সেরে ফিরতেন সাধু-সন্তরা! মাঘী পূর্ণিমা এবং তার আগে-পরের মোট তিন দিন ত্রিবেণীতে বসত অণুকুম্ভ মেলা। তবেও সে-ও ৭০০ বছর আগের কথা। সেই মেলা শেষ বসেছিল ১২৯৮ সালে।
এখন ত্রিবেণী
৭২৪ বছর পরে ত্রিবেণীতে আবার নতুন করে কুম্ভমেলা শুরু হয়েছে ২০২২ সাল থেকে। ২০২৫ সালেও মাঘী পূর্ণিমার আগে-পরে তিন দিন আয়োজন করা হয়েছিল কুম্ভস্নানের। উদ্যোগ নিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। উদ্যোগী হয়েছিলেন ত্রিবেণী ঘাট সংলগ্ন ব্যবসায়ীরাও। ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে হুগলির ত্রিবেণীর কুম্ভমেলার মাহাত্ম্যের কথা বলেছিলেন। এ বছর হুগলির সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঘী পূর্ণিমায় ত্রিবেণীতে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ত্রিবেণী সংলগ্ন সব ঘাটগুলিতে ওই দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন কুম্ভস্নান করতে।