বঙ্গের ভুলে যাওয়া ‘নর্তেশ্বর’কে স্মরণ করল সংস্কার ভারতী

১৫ই ডিসেম্বর,কলকাতা।এতদিন বিকৃত ইতিহাসের ফাঁদে পড়েছিলেন ভগবান শিব। বামপন্থীদের লেখা ইতিহাসে এতোদিন ভগবান শিবও ব্রাত্য ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া যায় না তা আবার প্রমানিত হল।

ইতিহাসকে মাটি খুঁড়ে তুলে আনতেই আজ ‘পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র’ নিবেদিত ও ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ প্রান্ত দ্বারা আয়োজিত হল নর্তেশ্বর শিবের চিত্র প্রদর্শনী ও নৃত্যোৎসব।১৫ই ডিসেম্বর,কলকাতায় ।প্রথমপর্বে ১৫ জন শিল্পীর আঁকা চিত্র প্রদর্শিত হয়।

বিকৃত ইতিহাস, বিধর্মী সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার চাপে বাঙালি ভুলতে বসেছে তার নিজের ঈশ্বরকে। বঙ্গের সেই বিস্মৃত প্রায় নর্তেশ্বর শিবকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে প্রথম এত জন শিল্পীর আঁকা নর্তেশ্বর-এর চিত্র প্রদর্শিত হল, সংস্কার ভারতীর ‘দৃশ্যকলা বিধা’র শিল্পীরা এই উদ্যোগ নেন।এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন রূপে উপস্থিত ছিলেন ড. আশিস গিরি, অধিকর্তা, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র; ড. স্বরূপ প্রসাদ ঘোষ,অধিকর্তা,MAKAIAS; ড.সায়ন ভট্টাচার্য,সহ-অধিকর্তা,ভারতীয় সংগ্রহশালা; বিদূষী বিম্বাবতী দেবী, মণিপুরী নৃত্য সাধিকা; বিদূষী পারমিতা মৈত্র, কথক নৃত্য সাধিকা।

ত্রিকালদর্শী যজ্ঞেশ্বর শিব, সর্বশ্রেষ্ঠ নর্তক, তাই তিনি নটরাজ। দক্ষিণ ভারতে নটরাজ মূর্তি আনন্দ তাণ্ডব নৃত্যের প্রতিমূর্তি। বঙ্গ তথা উত্তর ভারতের দেখা যায় বীণাধর নটরাজের মূর্তি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশে এই নটরাজের নামই ‘নর্তেশ্বর’।

বৃষরূপী নন্দীশ্বরের পৃষ্ঠে ললিত তাণ্ডবে মত্ত নর্তকরাজ, তাঁর বাহনটি ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দেখছে সেই নৃত্যলীলা। মহেশ্বরের মাথায় জটামুকুট, স্কন্ধে নাগ-উপবীত, অঙ্গে অঙ্গে বিবিধ অলঙ্কারের সমারোহ। সম্মুখভাগে প্রসারিত তাঁর মুখ। দক্ষিণহস্তে রয়েছে গজহস্ত মুদ্রা, বাম হাত উপরে তুলে পতাকা মুদ্রায় ত্রিজগতকে অভয় দিচ্ছেন। অন্য আটটি হাতে রয়েছে ধনুর্বাণ, খড়গ-চর্ম, ত্রিশূল, খট্টাঙ্গ, কপালপাত্র আর অঙ্কুশ। তাঁর ঊর্ধ্বলিঙ্গ দশা আত্মসংযমের প্রতীক। তাঁর পায়ের কাছে, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন গণপতি, স্কন্দ এবং অন্যান্য অদ্ভুতদর্শন শিবানুচরের দল। মহাদেবের প্রভামণ্ডলের দক্ষিণাংশে শূন্যে মরালপৃষ্ঠে বিরাজ করছেন বীণাধারিণী সরস্বতী, ঊর্ধ্বভাগে হাতে পুষ্পমালা নিয়ে ভেসে রয়েছেন দুই বিদ্যাধর। গীত, বাদ্য ও নৃত্যের ত্রিধারার সমন্বয়ে পূর্ণতা পাচ্ছে এক আশ্চর্য সঙ্গীত। বঙ্গে আজ বিস্মৃত প্রায় এই নর্তেশ্বর শিব।ইনিই বঙ্গের শিব।

এই প্রদর্শনী প্রসঙ্গে ড. গিরি বলেন, বঙ্গের সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে ভুল ইতিহাস পড়িয়ে।দীর্ঘদিন রাষ্ট্রবাদী শক্তিকে একঘরে করে রেখে রাষ্ট্র বিরোধী শক্তি এই কাজ করেছে। কিন্তু ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য সংস্কার ভারতী যে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয় ‘নর্তেশ্বর নৃত্য উৎসব’। ‘ভারতীয় সংগ্রহশালার ‘আশুতোষ জন্ম শতবার্ষিকী হল’-এ অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় প্রচার প্রমুখ সুনীল আম্বেকর, ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরী’র অধিকর্তা অজয় প্রতাপ সিং, সংস্কার ভারতীর অখিল ভারতীয় সম্পাদিকা নীলাঞ্জনা রায়, সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গের কার্যকরী সভাপতি সুভাষ ভট্টাচার্য ও আরও অনেকে।

আজ ‘নর্তেশ্বর নৃত্য উৎসব’ এর শুভারম্ভের মাহেন্দ্রক্ষণে নর্তেশ্বরের বিষয় আধারিত তথ্যসমৃদ্ধ মূল্যবান গ্রন্থ ‘বঙ্গ সংস্কৃতির আদিপুরুষ: নর্তেশ্বর’ প্রকাশ করা হয়। ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ -এর ‘কলা ধরোহর বিধা’র উদ্যোগে এবং পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, ভারতীয় সংগ্রহশালা, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ ও ভারতীয় সংস্কৃতি ন্যাস-এর সহযোগিতায় এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

এই নৃত্যোৎসবে মেহেন্দি চক্রবর্তীর পরিচালনায় দক্ষিণ কলকাতা জেলা ভরতনাট্যম নৃত্য আঙ্গিকে ‘শিব স্তোত্রম্’, মৌমিতা বিষ্ণু সেনগুপ্ত-এর পরিচালনায় বীরভূম জেলা রবীন্দ্রনৃত্য সহযোগে ‘শিব বন্দনা’, মোনালিসা ঘোষের পরিচালনায় দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা ওডিশি নৃত্য আঙ্গিকে ‘শিব ভজন’, পারমিতা মৈত্র-এর পরিচালনায় ‘নৃত্যাঙ্গন কথক কেন্দ্র’ উপস্থাপন করে ‘শিব তান্ডব’, মাধুরি মজুমদার-এর পরিচালনায় ‘কুচিপুড়ি কলামাধুরি’ উপস্থাপন করে ‘শিব বন্দনা’ ও কাবেরী পুইতণ্ডী কর-এর ‘NGCB ফাউন্ডেশন’ গৌড়ীয় নৃত্য আঙ্গিকে ‘নর্তেশ্বর বন্দনা’ পরিবেশন করে।

দুটি ভাগে বিভক্ত অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন গৌরী সেনগুপ্ত এবং তিলক সেনগুপ্ত ও অমিত দে।

এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক তিলক সেনগুপ্ত বলেন, বিদেশি ও বিধর্মী আক্রমণকারীরা বারবার আঘাত করেছে আমাদের মন্দির গুলোকে। সেই আক্রমণে নর্তেশ্বর-এর মূর্তিও ধ্বংস করা হয়েছে। মাটি খুঁড়লেই বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সনাতনী সংস্কৃতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এখনো দশভুজা ও দ্বাদশভুজা নর্তেশ্বর-এর পুজো করা হয়। বর্তমান বাংলাদেশের ‘নাটেশ্বর’ ও ত্রিপুরার ‘নাটঘর’ গ্রামে এখানো নিত্য পূজিত হন নর্তেশ্বর শ্রীবিগ্রহ। বঙ্গের নর্তেশ্বর-এর মূর্তি দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর জেলার মেলক্কাডম্বুর গ্রামে অমৃতঘটেশ্বর মন্দিরে পাওয়া গেছে। বঙ্গের এই আদি নর্তেশ্বর শিবকে বর্তমান সময়ের মানুষের কাছে জানান দিতেই আজকের এই প্রদর্শনী ও নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছে।

মিলন খামারিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.