প্রথম_পর্ব : কেমনে মুগরী বানে?
‘জোলা মরে তাঁতে।
বাঙালি আর কাঙালি মরে
মাছে আর ভাতে।’
হম , মাছে ভাতে বাঙ্গালী। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ মৎস। তাই মাছটা বাঙ্গালী হৃদয়ের নিকট রেখে মশলা দিয়ে বেটে রসিয়ে রাঁধতে চায়। সেই কোন সুপ্রাচীন কালের চন্দ্রকেতুগড়… ১৭০০ বছরের পুরনো মাছের ছবি খোদাই করা ফলক পাওয়া গিয়েছে। শুধু কি তাই? মধ্যযুগের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ ফুল্লরার বিশদ পাকপ্রণালী বা ‘অন্নদামঙ্গল’-এ মাছবৃত্তান্ত পড়লে বোঝা যায়, সেই কোন কাল থেকে বাঙ্গালীর আইডেন্টিটির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে মাছ, মাছের ঝোল আর তার রসনাকে শাসন করার ক্ষমতা।
গরম ভাত, মাছ সঙ্গে একটু ঘি….এটাই মধ্যবিত্ত বঙ্গজীবনের সুখীগৃহকোণের চিত্র। সাংসারিক জীবনের আটপৌঢ়ে চিত্রটিই বাঙালীর মৎস্যপ্রীতির অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন, প্রমাণ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ এর এই পদটি-
“ ওগগর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা, গাইকে ঘিত্তা
দুগ্ধ সযুক্তা।
মেইলি মচ্ছা নালিচ গচ্ছা দিজ্জই কন্তা
খা পুনবন্তা”।
অর্থাৎ, যে নারী রোজ কলাপাতায় গরমভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর পাট শাক পরিবেশন করেন, তাঁর স্বামীই পুণ্যবান।
দক্ষিণ বঙ্গের ইলিশ হোক বা উত্তর বঙ্গের রূপালী শস্য বোরোলি….অথবা রুই, কাতলা, মৃগেল, খয়রা, রূপচাঁদা, শোল, তপসে, পার্শে , ট্যাংরা, পাবদা, লটে , বোগ মাছ….
নদী-নালার বাংলায় এমনধারা রূপালী শস্যেরঅভাব ছিলনা এককালে। রুই-কাতলা হাটে বাজারে পাবেন বারোমাস। বর্ষাটা পড়তে দিন, ইলিশের গ্ল্যামারে আপনার চোখ ঝলসাবে।
পাবদার ঝালে নোলা সকসক করবে।
চিতল ভেকুট রুই কাতল মৃগেল।
বানি লাঠা গড়ই উল্কা শউল শাল।।
পাঁকাল খয়রা চেলা তেচক্ষা এলেঙ্গা।
গুঁতিয়া ভাঙন রাগি ভোলা ভোলাচেঙ্গা।।
মাগুড় গাগড় অরি বাটা বাচা কই।
কালবসু বাঁশপাতা শঙ্কর ফলুই।।
শিঙ্গি ময়া পাবদা বোয়ালি ডানিকোণা।
চিংড়ি ট্যাংরা পুঁটি চান্দা গুড়া লোনা।।
গাঙ্গদারা ভেঙ্গা চেঙ্গ কুড়িশা খলিশা।
খরশুলা তপসীয়া পাঙ্গাশ ইলিশা”।।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ছিলেন বর্ধমানের মানুষ। ঘটি। কবি বিজয় গুপ্ত ছিলেন বরিশালের লোক। কাঠ বাঙাল। এঁদের দুজনার রচিত দুই ‘মঙ্গলকাব্যে’ ঘটি বাঙালের মাছ রান্নার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে মৎস্যপ্রিয় বাঙালীর লালারস উদ্রেকের জন্য যথেষ্ট।
মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গলে’- দেবীর আদেশে, লহনা নির্বাসিতা খুল্লনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনে স্নান করিয়ে ‘পঞ্চাশ ব্যঞ্জন’ রেঁধে আপ্যায়ন করলেন।
মুকুন্দরাম লিখলেন- “ কটু তৈলে রান্ধে রামা চিতলের কোল।
রুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।।
কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ।
মুঠো নিঙাড়িয়া তথি (তাহাতে) দিল আদারস।
আবার, বিজয় গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ এ লিখলেন- “ মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ।।
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছ।
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ।।
ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জড়ায়ে সুতা।
তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা।।
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল”।।
মাছ বাঙালির কাছে যে প্রিয় খাদ্য ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন রন্ধন বইয়ে। গৃহিণীরা সেকালে বহুভাবে মাছ রান্না করতেন। যেমন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী তাঁর এক রান্নার বইতে ৫৮ পদের মাছ রান্নার পদ্ধতি জানিয়েছেন।
বাঙালির বিয়েবাড়িতে কিংবা গায়ে হলুদে রুই মাছ সাজিয়ে পাঠানো শুভাশিষের প্রতীক। অথবা ভাত কাপড়ের সময় একটি মাছের মুড়ো….অন্নপ্রাশন, পৈতে, বিয়ে, জন্মদিন বা আঁশপান্না মৎস ব্যতীত বঙ্গ জীবন অচল।
অর্থাৎ বাঙালীর যেকোন উৎসব মাছ ছাড়া অচল যেন। সাহিত্য-কবিতায়ও মাছের ছড়াছড়ি ছিল। ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন,
‘‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।”
মাছের জন্য কি নিদারুন আকাঙ্খা বাঙ্গালী জীবনে । এই আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ হল মাছ ধরবার বিভিন্ন কলা কৌশল ও যন্ত্র ইত্যাদির উদ্ভাবন। সেরমই একটি মাছ ধরার যন্ত্রের নাম #মুগরী। হ্যাঁ হ্যাঁ মশাই মুগরী। মুরগী নয়….এই যন্ত্র নির্মাণ ও ব্যবহার দুইতেই জেলে থেকে মাহিষ্য সম্প্রদায়ের মানুষ নিযুক্ত আছেন।
হম মুগরী একটি কুটির শিল্প। তবে সম্বৎসর এই শিল্প অন্যান্য কুটির শিল্পের ন্যায় চালু নয়। তাই এটি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সহায়কও নয়। এককথায় বলতে পারেন এই শিল্প অবসর আমি যাপনের একটি কাজ মাত্র।
মুগরী বোনা একটি কুটির শিল্প হলেও কিন্তু এর বিস্তার তেমন বিশেষ অঞ্চল জুড়ে নেই। চিরুনি, শঙ্খ, পুতুল, মাটির জিনিস ইত্যাদির ন্যায় এই শিল্পের ব্যাপক বাজার নেই। বিপুল চাহিদাও নেই। কেবল নিম্নাঞ্চলে মাছ ধরার জন্য মুগরীর চাহিদা দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া, হুগলী , মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এর চল বেশি। পাঁশকুড়া থানার মধ্যে কুলেমানুয়া, রামচন্দ্রপুর, মাধবপুর গ্রামেই এই শিল্প বেশি দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এর পাশাপাশি মুকাডাঙী , শূলনী, কাঞ্চনা ,কানাইচক ইত্যাদি গ্রামে উক্ত শিল্প লক্ষ্য করা গেলেও পূর্ব উল্লিখিত স্থানগুলির ন্যায় ব্যাপক হারে এর প্রচলন নেই।
মুগরী বাঁশ দ্বারা নির্মিত হয়।
তবে সব বাঁশ থেকে মুগরী নির্মাণ হয় না।কেবলমাত্র তরল বা তলতা বাঁশ থেকেই মুগরী তৈরি হয়। তবে অন্যান্য বাঁশ থেকে মুগরী হতেও মুগরী তৈরি হয়। জাবাল বাঁশ, বাঁশলী বাঁশ বা এই জাতীয় অন্য বাঁশ হতেও মুগরী নির্মাণ করা যায়। কিন্তু এগুলো দিয়ে বড় ও ভালো মানের মুগরী হয় না। বড় মুগরী নির্মাণের নিমিত্ত বাঁশের পাব বড় হওয়ার দরকার আছে। এছাড়া বাঁশের আঁশ বা চোঁচ যত কম হবে ততই মুগরী বানানোর কাঠি প্রস্তুত করা যায়।বাঁশনী , জাবাল অথবা এই জাতীয় বাঁশে চোঁচ বেশি হবার জন্য এই সব বাঁশ মুগরী বোনার কাজে সেভাবে ব্যবহার হয় না। তাছাড়া এসব বাঁশের পাব গুলি ছোট হয় সেহেতু এগুলো দিয়ে বড় মুগরী হয় না।
আচ্ছা , এবার বলি – মুগরী কিন্তু দু রকমের হয় , – বড় ও ছোট। মুগরীর ছোট বা বড় মাপ হয় #বান দিয়ে।অর্থাৎ, পাঁচ বান ও দশ বানের দুইটি মুগরী। তাহলে প্রথমটির আকার ,উচ্চতা ইত্যাদি দ্বিতীয়টির তুলনায় ছোট হবে। এখন বান বলতে কি বোঝায় জানতে হলে মুগরী কেমন করে তৈরি হয় সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমে তলতা বা তরল বাঁশ কেটে শুকনো করা হয় এবং পরে শুকনো বাঁশগুলোকে জলে পচিয়ে নিয়ে ফালি করে নেওয়া হয়।এর পর ওইসব ফালি বাঁশগুলোকে ধারাল বঁটিতে করে হাতের কৌশলে চাট ও চাট হতে সরু সরু কাঠি তোলা হয়। এই কাজে অন্যমনস্ক হলেই আঘাত প্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা থাকে একশ ভাগ।
এবার সরু সরু ঝাঁটার কাঠির থেকে কিছু মোটা কাঠি গুলো হতে চোঁচ তুলে ফেলার জন্য বেশ কিছু কাঠিকে একটা থলের মধ্যে ঘষে নেওয়ার পালা চলে। এইভাবে ঘষে নিলে কাঠি গুলো আঁশ মুক্ত হয় এবং গোল হয়ে যায়। এরপর মুগরী তৈরির পালা।
কিন্তু মুগরী বানাবো বললেই বানানো যায় না। বোনবার জন্য চাই নানান জিনিষ পত্র। কাঠি তো প্রস্তুত হল। কিন্তু বোনা হবে কি দিয়ে? শুরু হয় #মাড় বা #বেগো সংগ্রহের পালা। কোথায় পাবে সেই মাড়? যেতে হয় তালগাছের কাছে….
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায়;
কোথা পাবে পাখা সে?
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে' তার,--
মনে মনে ভাবে, বুঝি ডানা এই,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার।
হ্যাঁ , সেই তালগাছের গোল গোল পাতা নিয়ে তালগাছ উড়তে না পারলেও ,তার গোল গোল পাতার ডাঁটার গোড়ার দিকে থাকে সেই মাড়। গাঁয়ের ঘরে সেখান হতে উপযুক্ত ভাবে মাড়কে প্রস্তুত করা হয়। অবশ্য আফলা গাছে মানে যে তাল গাছ ফল দেয় নি তার ডাঁটার গোড়ার মাড় সবথেকে ভালো হয়। আরো একটা জিনিষ উল্লেখযোগ্য যে আফলা গাছের সঙ্গে পাকা ডাঁটাও খুঁজতে হয়। কাঁচা ডাঁটায় মাড় হয় না এমনটি নয়। কিন্তু কাঁচা মাড় দিয়ে মুগরী বানালে টেকসই হয় না। শুধু তাই নয় এই কাঁচা মাড়ে কাজ করার সময় দ্রুত কাজ করা যায় না ।
তাল ডাঁটা গুলোকে মুগুর দিয়ে মোটামুটি থেঁতলে নেওয়ার পর জলে ২/৩ দিন পচিয়ে নিয়ে একটি কঞ্চির কিছুটা দুফেলা করে তার ভিতরে মাড়ের কিছুটা দিয়ে অপর দিকে টান দিলে এবং পরে হাতের দিকটা ওই কঞ্চিতে ঢুকিয়ে টানলে হাতে মাড় চলে আসে।মাড় গুলি যেহেতু ভেজা থাকে তাই এরপর রোদে শুকিয়ে নিতে হয়।
এসব সাঙ্গ হলে মুগরী বোনা শুরু হয়। মুগরীর কাঠি গুলো বিনুনি টেকনিকে বোনা হয়।বোনটা এমন কিছু কঠিন নয় শিল্পীদের নিকট। তবে বোনার সময় আঙ্গুলের টিপের প্রোয়জন হয়। বুনন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু মাড় খাইয়ে নিতে হয়। এইভাবে একটা লাইন প্রথম থেকে শেষ অবধি বুনে গেলে তাকে বান বলে।এইভাবেই মুগরীর চট বা বাড় বোনার কাজ হবে।
মুগরীর কাঠিটি যতটা লম্বা তার ৮ কাঠি বা ৮ গুন হবে মুগরীর বাড়। বাড়ে প্রথম বান অর্থাৎ প্রথম বুনন হয়ে গেলে দুপাশে দুইটি কাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর পুনরায় চারকড়া বাদ দিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ওই বিনুনি পদ্ধতিতে আবার বান বোনা চলে। এককথায় বলা যেতে পারে, কোনো কাঠি যদি ৩৬ কড়া লম্বা হয় তাহলে ৪ কড়া বান দিলে ৯ টি বান দেওয়া যায়।
বাড় বা চট বোনার কাজ এবার শেষ। এবার তৈরি করা হয় মুগরীর চাঁদা বা কাঠামো। এই চাঁদা বাঁশ থেকে তোলা সরু বাতাকে হিসাব মতো ভেঙে দু’খানা করা হয়। এই দু’খানা একই রকম চাঁদা মুগরীর উপরে ও নীচে থাকে এবং উপরের চাঁদায় থাকে মুখ। এই তৈরির ব্যাপারেও একটি হিসেব আছে। তবে এই হিসেবের চেয়ে বাড়টা যতটা লম্বা হয় সেই অনুসারে চাঁদার ফরমা করে কাঠি দিয়ে তার উপর বুনে শেষকালে বাড়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
উক্ত প্রক্রিয়ায় জুড়ে নেওয়ার জন্যে #পাতাশে নেওয়ার পালা শুরু হয় সুতলী দড়ির সাহায্যে। এবার কি শেষ হল মুগরী বোনার কাজ?
নাঃ আরো কিছু বাকি…. এবার পালা দুটি কুলি মুগরীর সাথে জুড়ে নেওয়ার।এর জন্য বাড় বোনার ধাঁচে কুলি দুটি বোনা হয়। এবার কাঠিগুলোকে কেটে ছোট ছোট এবং মুখগুলোকে সরু সরু করে নেওয়া হয়। এখন এই কুলি দুটি জুড়ে দেওয়া হয়। ব্যাস মুগরী প্রস্তুত।
কিন্তু আয় কেমন ? কেবলই কি বেগার ঠেলা বা শখের বসে মুগরী বানানো? রোজ কেমন?
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কোলাঘাট : ইতিহাস ও সংস্কৃতি