১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুন্দুভি বেজে গেছে। রণাঙ্গনে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের যুদ্ধবিমানের ককপিটে এক আঠারোর তরুণ। সদ্য যৌবনের রক্ত গরম তেজ তাঁর শিরায় উপশিরায়। পেলব মুখের চোয়াল শক্ত। কঠোর-কোমলের এমন সংমিশ্রণ সচরাচর দেখা যায় না। গতি বাড়িয়ে সেই তরুণ ধাওয়া করেছেন একটি জার্মান ফাইটার জেটকে। নিপুণ তাঁর নিশানা। বেশিদূর পালাতে পারেননি জার্মান যোদ্ধা। মাঝআকাশেই ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল জার্মানির ফক্কার ডি-৭ কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দশ দিনে ন’টি জার্মান বিমানকে ধরাশায়ী করেছিলেন। মৃত্যুও তাঁকে ছুঁতে ভয় পেয়েছিল। ‘ফ্লায়িং এস’, রয়্যাল এয়ার ফোর্সের এই কমব্যাট পাইলট এক বঙ্গসন্তান। কলকাতায় তাঁর জন্ম। ইন্দ্রলাল রায়। বিদেশের মাটিতে এই ভারতীয় যোদ্ধার বীরত্বের কাহিনী আজ বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ে গেছে। আজ ২ ডিসেম্বর জন্মবার্ষিকীতে সেই বীর তরুণের অসম সাহসের স্মৃতিচারণ করা যাক আরও একবার।
কলকাতার নামী আইনজীবী প্যারীলাল ব্রিটিশ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত, ছেলেদের মধ্যেও সেই বীজ বুনেছিলেন শৈশবেই
২ ডিসেম্বর, ১৮৯৮ সাল। প্যারীলাল ও ললিতা রায়ের ঘরে জন্ম ইন্দ্রলালের। বরিশালের ধনী পরিবারের ছেলে প্যারীলাল ব্রিটিশ ভাবধারায় অনুরক্ত ছিলেন। ছেলেদেরও ছোট থেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। এমনকি এও শোনা যায় কলকাতার বাড়িতে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য একজন ইংরেজ গভর্নেসও নিয়োগ করেছিলেন। কঠোর অনুশাসনে বিশ্বাসী প্যারীলাল শিক্ষার পাশাপাশি ছেলেদের স্বাস্থ্য গঠনের দিকেও জোর দেন।
তদানীন্তন বাঙালি পরিবারের আদবকায়দার সঙ্গে প্যারীলালের সংসারের নিয়মকানুন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। পরেশ ও ইন্দ্রলাল কৈশোর থেকেই সাঁতার, ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলেন। পরেশলাল রায় পরবর্তীকালে ভারতীয় বক্সিং-এর জনক হিসেবে পরিচিতি পান।
১৯০১ সাল। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুরক্ত প্যারীলাল স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে নিয়ে লন্ডনে পাড়ি দেন।
কিশোর ইন্দ্রলালের নতুন ঠিকানা হয় হ্যামারস্মিথের ৭৭ নম্বর ব্রুক গ্রিনে। হ্যামারস্মিথের নামী স্কুল সেন্ট পলস বয়েজে ভর্তি হন ইন্দ্রলাল ও তার দুই ভাই পরেশ ও ললিত। তিন মেয়ে লীলাবতী, মীরাবতী এবং হীরাবতী ভর্তি হন সেন্ট পলস গার্লস স্কুলে। লন্ডনের মাটিতে এক নতুন স্বপ্নে বড় হতে থাকেন ইন্দ্রলাল।
স্কুলের সাঁতার চ্যাম্পিয়ন , পড়াশোনায় তুখোড়, আকাশে ওড়ার স্বপ্ন অসীম। বাবা প্যারীলাল চাইতেন ছেলে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করুক। কিন্তু ইন্দ্রলালের লক্ষ্য ছিল অন্য। যুদ্ধবিমান উড়িয়ে আকাশজয়ের স্বপ্ন দেখতেন এই বঙ্গসন্তান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরেশ যোগ দিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে, যোদ্ধা হওয়ার জেদ চনমন করে উঠল ইন্দ্রলালের
১৯১৪ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল গোটা ইউরোপে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন পরেশ। তখন তাঁর বয়স ২১ বছর। বিদেশি সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধের মাটিতে গর্জে উঠলেন এক বাঙালি তরুণ। ইন্দ্রলালের বয়স তখন ১৫ বছর। দাদাকে দেখে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা আরও দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। যোগ দিলেন স্কুলের ক্যাডার ফোর্সে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষার বৃত্তি পেয়ে গেলেন ইন্দ্রলাল। কলেজে পড়তেই বানিয়েছিলেন ‘ট্রেঞ্চ মর্টার’-এর নকশা। এই অভিনব ডিজাইনের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তিও পেয়েছিলেন ইন্দ্রলাল। গতি ভালবাসতেন। স্পোর্টস কার চালাতেন দুরন্ত গতিতে, মোটরবাইক ছুটিয়ে নিজের গতির পরীক্ষা করতেন। স্বপ্ন ছিল একদিন যুদ্ধবিমান উড়িয়ে শত্রুদের ধরাশায়ী করবেন। কলেজে পাঠের মাঝেই ‘রয়্যাল ফ্লায়িং কোর’-এ যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু দুর্বল দৃষ্টিশক্তির জন্য সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়।
হার মানার ছেলে নন ইন্দ্রলাল। নিজের সাধের মোটরবাইক বেচে টাকা জোগাড় করে ব্রিটেনের সবচেয়ে নামী চোখের ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা শুরু করলেন। পরে দৃষ্টিশক্তির শংসাপত্র নিয়ে বুক ফুলিয়ে হাজির হলেন রয়্যাল এয়ার ফোর্সে। এবার আর দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষায় পিছু হটতে হল না তাঁকে। যোগ দিলেন রয়্যাল ফ্লায়িং কোর-এর ৫৬ নম্বর স্কোয়াড্রনে। ১৯১৭ সালের ৫ জুলাই। ৫৬ নম্বর স্কোয়াড্রনে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদের দায়িত্ব পেলেন ইন্দ্রলাল। পোস্টিং হল ফ্রান্সের ভাদোমে।
জার্মান ফাইটার জেটের গুলি প্রাণ নিতে পারেনি, মর্গে জেগে উঠেছিলেন ‘ল্যাডি
ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সে ইন্দ্রলাল তখন সহকর্মীদের প্রিয় ‘ল্যাডি।’ কার্জিস, বি ই টু, সপউইথ ক্যামেল, আভরো এবং এস ই ফাইভ-এর মতো যুদ্ধবিমান চালাতে পারদর্শী। আঠারো বছরের তরুণের সাহস ও দক্ষতা দেখে মুগ্ধ এয়ার ফোর্সের বাকি সেনারাও। বাংলার ছেলে তখন রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ‘হিরো।’
১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধের আকাশে জার্মান ফাইটার জেটকে ধাওয়া করল ইন্দ্রলালের বিমান। কিন্তু পারলেন না। চারপাশে ঘিরে ধরে জার্মান ফাইটার জেটের গুলিতে ধরাশায়ী হল ইন্দ্রলালের যুদ্ধবিমান। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ থেকে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁর যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ। ক্ষতবিক্ষত ইন্দ্রলালের দেহ পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা বললেন, দেহে আর প্রাণ নেই। চোখের জলে ল্যাডিকে শুইয়ে দেওয়া হল মর্গে। কয়েক ঘণ্টা। মর্গের দরজায় ভিতর থেকে ধাক্কা শুনে চমকে উঠেছিলেন সকলে। দরজা খুলে দেখা যায় হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তরুণ। প্রাণ নিতে পারেনি শত্রুর আক্রমণ। শরীরের দুর্বলতা কাটল কয়েক মাসে। সুস্থ হয়ে উঠলেও আর বিমান চালানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি তাঁকে। কিন্তু বঙ্গতনয়ের জেদ অদম্য। হার মানতে বাধ্য হলেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। মৃত্যুর মুখ থকে ফিরে আসা তরুণ তখন অনেক পরিণত। পেলব মুখে দেখা দিয়েছে কাঠিন্য। একবারের পরাজয় জেতার খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। ফের শুরু করেন প্রশিক্ষণ। দক্ষতায় শান দিয়ে ১৯১৮ সালের ২২ জুন যোগ দেন ৪০ নম্বর স্কোয়াড্রনে।
দশ দিনে শত্রুপক্ষের ন’টি ফাইটার জেট খতম, প্রথম ভারতীয় এয়ার কমব্যাট পাইলট কাঁপিয়ে দিলেন যুদ্ধক্ষেত্র
১৯১৮ সালের ৬ জুলাই। ফের যুদ্ধবিমান ওড়ালেন ইন্দ্রলাল ওরফে ‘ল্যাডি।’ বাঙালি ছেলে হলেন রয়্যাল ফ্লাইং কোরের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। সিঙ্গল সিটার ‘সপউইথ ক্যামেল’ বিমান নিয়ে ফের শত্রুপক্ষকে প্রবল বিক্রমে ধাওয়া করলেন ইন্দ্রলাল। ৯ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই, টানা দশ দিনে ন’টি জার্মান যুদ্ধবিমানকে ধরাশায়ী করলেন।
২২ জুলাই, ১৯১৮। সেদিনও একই ভাবে যুদ্ধের আকাশে ইন্দ্রলাল। আচমকা পিছন থেকে চারটে জার্মান ফাইটার উড়ে এসে মাঝআকাশে ঘিরে ফেলল তাঁকে। ইন্দ্রলালও অপ্রতিরোধী। নাকানিচোবানি খাওয়ালেন শত্রুপক্ষকে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন দু’টি জার্মান ফাইটার জেট। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা একটি জার্মান ফাইটারের গুলিতে আগুন লেগে গেল ইন্দ্রলালের বিমানের ট্যাঙ্কে। দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে সেটি আছড়ে পড়ল মাটিতে। এবার আর উঠতে পারলেন না ল্যাডি। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিল ২০ বছরের একটি তাজা প্রাণ। আকাশযুদ্ধে প্রথম বীরত্বের সম্মান বা ‘ফ্লাইং ক্রস’ পেলেন এক ভারতীয়।
ইন্দ্রলালের বিমান যেখানে আছড়ে পড়েছিল, তিন দিন পরে আকাশে উড়তে উড়তে বিমান থেকে সেই জায়গাটায় পুষ্পস্তবক ছুড়ে দেন জার্মান বায়ুসেনার অফিসার ম্যানফ্রেড ফন রিখটোফেন। হোক না শত্রুপক্ষ, এই তরুণ এই বাঙালি বীরকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারেননি তিনি। উত্তর ফ্রান্সের এসতেভেলেস কমিউনাল সেমেটরির যেখানে ইন্দ্রলাললে সমাহিত করা হয়েছিল তার উপরে আজও বাংলা ও ফরাসি ভাষায় খোদাই করা আছে, ‘মহাবীরের সমাধি। সম্ভ্রম দেখাও, স্পর্শ কোরো না।’
বাঙালির ইতিহাসে ইন্দ্রলাল রায় এক বীর শহিদ। সোনার হরফে লেখা এক ইতিহাস। বাঙালির গর্বের আখ্যানে ইন্দ্রলাল রায় এখন এক রাস্তার নাম হয়েই রয়ে গেছেন। ভবানীপুরে ইন্দিরা সিনেমার রাস্তার নাম ইন্দ্র রায় রোড। বিশ্বের মহাযুদ্ধের ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া এক বাঙালি সৈনিক। স্বদেশের জন্য নয়, বিদেশি রাজার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন ওই সৈন্যরা। তাই কি সেই বীরত্বের কাহিনী অধরাই রয়ে গেছে?