আরজি কর-কাণ্ডে সাত দিনে দু’বার মুখ খুললেন সৌরভ, আবার বঙ্গ-রাজনীতির জল মাপছেন মহারাজ!

আরজি কর-কাণ্ডে এক সপ্তাহের মধ্যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দু’টি প্রতিক্রিয়া। তার পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়কের চোখ কি আবার বাংলার রাজনীতিতে?

গত ৯ অগস্ট, শুক্রবার আরজি কর হাসপাতাল থেকে এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। হাসপাতালের মধ্যেই তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এর দু’দিন পর, রবিবার সৌরভ তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ছেলে হোক বা মেয়ে, কারও সঙ্গেই এমন হওয়া উচিত নয়।” এর পর সৌরভ যা বলেন, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। তিনি বলেন, ভারতকে সাধারণত একটি নিরাপদ দেশ হিসাবেই গোটা বিশ্ব চেনে। বাংলাও নিরাপদ। সেখানে এ ধরনের ঘটনা হওয়া উচিত নয়। তাঁর মতে, কোনও একটি নির্দিষ্ট ঘটনা থেকে সামগ্রিক চিত্র বিচার করা উচিত নয়। পাশাপাশি এটাও জানান, প্রতিটি হাসপাতালে সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রশ্ন ওঠে, সমালোচনা করেও আরজি করের ঘটনাকে ‘একটি নির্দিষ্ট ঘটনা’ বলে সৌরভ কি রাজ্য সরকারের সুনজরে থাকতে চাইলেন?

এক সপ্তাহ পর শনিবার দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়ায় সৌরভ বলেন, ‘‘এই ঘটনা ভয়ঙ্কর। দোষীদের এমন শাস্তি হোক, যাতে ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা কেউ ঘটাতে না পারে। সিবিআই তদন্ত করছে। আশা করব দোষী চিহ্নিত হবে।’’ এমনকি যে রাস্তা দখলের কর্মসূচিকে শাসক দল তৃণমূলের অনেকেই কটাক্ষ করেছেন, সেখানেও শামিল হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি তিনি। যে হেতু অতীতে সৌরভকে নিয়ে বার বার জল্পনা হয়েছে, তাই নতুন করে আবার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তিনি কি আবার বাংলার রাজনীতির গন্ধটা শুঁকতে শুরু করলেন?

এটা সকলেরই জানা, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সৌরভের সঙ্গে কথাবার্তা বহু দূর এগিয়েছিল বিজেপির। অনেকে বলেন, বিধানসভা ভোটে সৌরভ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী ‘মুখ’ হবেন, সেই বোঝাপড়াতেই একেবারে শেষ মুহূর্তে সব অঙ্ক ওলটপালট করে ‘দাদা’কে বিসিসিআই সভাপতি করেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেই অঙ্কে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের।

Amit Shah and Sourav Ganguly

কিন্তু বিজেপির পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে সৌরভ বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত আগে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সৌরভ-বিজেপি সম্পর্কে খানিকটা শৈত্য এসেছিল। বিজেপি মনে করেছিল, সৌরভ তাদের ‘বিশ্বাস’ ভঙ্গ করেছেন। তিনি ‘দান’ নিয়েছেন। কিন্তু ‘প্রতিদান’ দেননি। তবে সৌরভের সঙ্গে বিজেপির তথা অমিতের সম্পর্ক কখনওই পুরোপুরি নষ্ট হয়নি। কারণ, ওই ঘটনার পরেও কলকাতায় এসে অমিত সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজে গিয়েছিলেন।

এর পরে ২০২৩ সালে হঠাৎই বিজেপি শাসিত ত্রিপুরা সৌরভকে তাদের পর্যটনের ব্র্যান্ডদূত নিয়োগ করে। যা থেকে অনেকেই মনে করেছিলেন, বিজেপির তরফে সৌরভকে আবার বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে, দরজা খোলা আছে। পাশাপাশি ব্র্যান্ডদূতের পদ গ্রহণ করে সৌরভও বুঝিয়েছিলেন, তাঁর দরজাও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ঘটনা হল, এর ছ’মাসের মধ্যে মমতা পশ্চিমবঙ্গের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর পদের দায়িত্ব দিয়ে দেন সৌরভকে। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনী মঞ্চে এই ঘোষণা করেছিলেন মমতা। সেখানে উপস্থিত সৌরভের হাতে সঙ্গে সঙ্গেই একটি চিঠিও তুলে দিয়েছিলেন মমতা। নিজের বক্তৃতায় সে দিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করে সৌরভ বলেছিলেন, ‘‘আমায় টেলিভিশনে দেখলেই উনি এসএমএস করেন। আমি এসএমএস করলে এক মিনিটে জবাব দেন। এ রকম খুব কম হয় যে দিদি এসএমএসের জবাব দিতে দেরি করেন।’’ রাজ্যের শিল্প নিয়ে সৌরভ বলেছিলেন, ‘‘রাজ্যে সত্যিই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আপনারা আসুন।’’

Sourav Ganguly and Mamata Banerjee

অনেকের মতে, সৌরভ-বিজেপি সম্পর্ক যে বরাবরই ভাল, তার আরও একটা প্রমাণ, কলকাতাকে গত বছর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ পাইয়ে দেওয়া। অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য হয়েও (বিশেষত, দিদির শাসিত রাজ্য হয়েও) বাংলা তথা কলকাতা বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ পেয়েছিল। তার মধ্যে একটি আবার সেমিফাইনাল ছিল! অনেকেই তখন মনে করেছিলেন, এই সিদ্ধান্তের পিছনেও বিজেপির তরফে সৌরভকে ‘বার্তা’ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। অনেকের ধারণা, ইডেনের ম্যাচ পাওয়ার পিছনে সৌরভেরও ‘উদ্যোগ’ রয়েছে। যদিও এই ধারণার কোনও আনুষ্ঠানিক সত্যতা কখনোই মেলেনি। সৌরভ নিজেও কখনও কিছু বলেননি। কিন্তু বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ দিয়ে সিএবিকে ‘পুরস্কৃত’ করা যে সৌরভের সামনে বিজেপির আরও একটা ‘টোপ’ ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। বিশেষত, যখন সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় তখন (এবং এখনও) সিএবির সভাপতি। তাঁর অধীনেই সিএবি বিশ্বকাপের সমস্ত ম্যাচের আয়োজন করেছিল।

তার আগে সেই বছরই সেপ্টেম্বরে স্পেন সফরে গিয়েছিলেন মমতা। সঙ্গে ছিলেন সৌরভ। স্পেন থেকেই সৌরভ ঘোষণা করেছিলেন, মেদিনীপুরে তাঁর দ্বিতীয় ইস্পাত কারখানাটি তৈরি হতে চলেছে। সৌরভ বলেছিলেন, ‘‘নতুন স্টিল প্ল্যান্টটি মেদিনীপুরে তৈরি হচ্ছে। ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার কাজে আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আশা করি, আগামী এক বছরের মধ্যেই তা চালু হয়ে যাবে।’’ তখন নিন্দকেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, বাংলার শিল্পের ঘোষণা কেন বিদেশ থেকে করা হল? সৌরভ তার জবাবে বলেছিলেন, “আমি একজন স্বাধীন ব্যক্তি। কোনও বিধায়ক, সাংসদ নই। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। যেখানে ইচ্ছা হবে সেখানে যাব। অনেকেই অনেক জায়গায় যায়। আমার কাছে কলকাতা, দিল্লি, স্পেন সব এক। আমরা পশুদের সমাজে বাস করি না। আমরা মানুষ, একে অপরের সঙ্গে মতের আদানপ্রদান করি। আমার কোনও রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। আমি কারও কাছে উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার সৌরভের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন সৌরভ। তবে বাইপাসের ধারের ওই একই হাসপাতালে তখন ভর্তি ছিলেন সৌরভের মা। বাংলার মহারাজের সুকান্ত-সাক্ষাৎ সেই সূত্রেও হতে পারে বলে একটি সূত্রের মত ছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটের মুখে ওই সাক্ষাৎ ঘিরে সৌরভের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে জল্পনা উস্কে দিতেও অনেকেই পিছপা হননি তখন।

Sukanta Majumder and Sourav Ganguly

এর পর এই প্রথম সৌরভ এমন একটা বিষয়ে মুখ খুললেন, যার সঙ্গে রাজ্যের মানুষের আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে গিয়েছে। সর্বোপরি জড়িয়ে গিয়েছে রাজনীতি। তাই অতীতের নিদর্শন মাথায় রেখেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, সৌরভ কি আবার রাজনীতির আঙিনায় জল মাপতে নামলেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.