আরও এক বার বিশ্বকাপের ফাইনালে, কোচ দ্রাবিড় কি এ বার পারবেন ২০ বছর আগের হারের বদলা নিতে?

রাহুল দ্রাবিড়ের কাছে একটি রুপোর পদক আছে। সেটা কি তিনি এই বিশ্বকাপে নিয়ে ঘুরছেন নিজের সঙ্গে? ২০ বছর পর সুযোগ এসেছে সেই পদকটির রং বদলে নেওয়ার। ক্রিকেটার দ্রাবিড় ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। কোচ দ্রাবিড়ের সামনে সেই সুযোগ এসে গিয়েছে। রবিবার আমদাবাদে ভারত যদি বিশ্বকাপ জিততে পারে তাহলে দ্রাবিড়ের কাছে সেটি হবে সুমধুর প্রতিশোধ।

২০ বছর আগে জোহেনেসবার্গের সেই রাতটা দ্রাবিড় এখনও ভুলতে পারেননি নিশ্চয়ই। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতকে যে ম্যাচে রিকি পন্টিং একাই মেরে পাট পাট করে দিয়েছিলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মের আগে পন্টিংয়ের সেই ১২১ বলে ১৪০ রানের অপরাজিত ইনিংস ছিল বিধ্বংসী। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক যখন সেই ম্যাচে একের পর এক ছক্কাগুলি হাকাচ্ছিলেন দ্রাবিড় দাঁড়িয়েছিলেন উইকেটের পিছনে। ভারতীয় দলের উইকেটরক্ষার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। এ বারের বিশ্বকাপে যেমন লোকেশ রাহুলকে উইকেটরক্ষক হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দলে কোনও নিয়মিত উইকেটরক্ষক না থাকায়, তেমনই ঘটেছিল সে বার। সৌরভের সেই দলে ছিলেন তরুণ পার্থিব পটেল। যিনি উইকেটরক্ষক হলেও দস্তানার দায়িত্ব ছিল দ্রাবিড়ের কাঁধে। এ বারের বিশ্বকাপেও তেমনই দলে রয়েছেন ঈশান কিশন। কিন্তু দায়িত্ব রাহুলের কাঁধে।

বিশ্বকাপে দ্রাবিড় খেলোয়াড় হিসাবে খেলেছেন, অধিনায়ক হিসাবে খেলেছেন। এ বারের বিশ্বকাপে তিনি কোচ। এখনও পর্যন্ত ট্রফি ছুঁতে পারেননি দ্রাবিড়। এ বারে তাঁর দায়িত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। মাঠে নেমে ব্যাট ধরতে পারবেন না। দ্রাবিড়ের মস্তিষ্ক থাকবে ভারতের জন্য। তাঁর পরিকল্পনা মাঠে নেমে বাস্তবায়িত করবেন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, মহম্মদ শামিরা। ২০০৩ সালে ফাইনাল খেলা দ্রাবিড়ের কাছে সুযোগ কবির খান হয়ে ওঠার। খেলোয়াড় হিসাবে হেরে যাওয়া ম্যাচ কোচ হিসাবে জিতে নিতে পারেন দ্রাবিড়।

rahul dravid

২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ভারত টানা আটটি ম্যাচ জিতেছিল। সে বারের ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে ৩৫৯ রান তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। ভারতীয় সমর্থকেরা এখনও ভুলতে পারবেন না ৪৮ বলে ৫৭ রান করে যাওয়া অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে। যিনি ম্যাথু হেডেনকে সঙ্গী করে ১০৫ রানের জুটি গড়েছিলেন মাত্র ১৪ ওভারে। এখনকার সময় দাঁড়িয়ে যা খুব অবাক করে দেওয়ার মতো না হলেও ২০ বছর আগের ক্রিকেটে এমন ইনিংস যথেষ্ট ভয়ঙ্কর ছিল। তার পরেই শুরু হয়েছিল পন্টিংয়ের সেই ইনিংস। যা কোনও ভাবেই থামাতে পারেনি ভারত। সেই ম্যাচে নিজে না বল করলেও আট জন বোলারকে ব্যবহার করেছিলেন সৌরভ। কিন্তু পন্টিংকে থামাতে পারেননি।

অস্ট্রেলিয়ার রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ৪ রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। ভারতীয় সমর্থকেরা হয়তো তখনই ম্যাচটা দেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাহুল দ্রাবিড়ের ৫৭ বলে ৪৭ রান তাঁদের আর মনে নেই। ১২৫ রানে হেরে গিয়েছিল ভারত। দ্রাবিড়ের লড়াই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। ২০ বছর পর ভারতীয় সাজঘরে কমলা রঙের জার্সিটা পরে বসে থাকা দ্রাবিড় হয়তো শোনাবেন সেই দিনের কাহিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের হারের কথা মনে করিয়ে দেবেন। কখনও বিশ্বকাপের ফাইনাল না খেলা রোহিত, শামি, বুমরাদের বোঝাবেন কী ভাবে এই ম্যাচের প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতের এই ১৫ জনের দলে বিরাট কোহলি এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন ২০১১ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। তাঁদের কাঁধে চেপে সচিন বিশ্বকাপ জিতে মাঠ প্রদক্ষিন করেছিলেন। দ্রাবিড়ের সেই সুযোগ এত দিন আসেনি। কোচ হিসাবে এ বার তিনি চাইবেন বিরাট, রোহিতদের হাত ধরে বিশ্বকাপ জিততে।

দ্রাবিড় ক্রিকেট বিশ্বে এমন এক জন মানুষ, যিনি সব সময় দ্বিতীয় হয়ে থেকে গিয়েছেন। ভারতের হয়ে অভিষেক হয়েছিল লর্ডসে। সেই ম্যাচে সৌরভেরও অভিষেক হয়েছিল। সৌরভ শতরান করে রেকর্ড বুকে নাম তুলে ফেলেছিলেন। দ্রাবিড়কে থেমে যেতে হয়েছিল ৯৫ রানে। মাত্র পাঁচ রানের জন্য শতরান পাননি তিনি। দেশের নেতৃত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন সৌরভ। বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়ে সৌরভ যেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ফাইনালে, দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে ২০০৭ সালে লজ্জার বিদায় ঘটেছিল ভারতের। সব কিছুতেই কোথাও গিয়ে একটা না পাওয়া রয়ে গিয়েছে দ্রাবিড়ের। অথচ দ্রাবিড় মানেই ভারতীয় ক্রিকেটের এক নিশ্ছিদ্র দেওয়াল। যেখানে সব আক্রমণের ঝাপটা ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়। ২০০১ সালে ইডেনে ভিভিএস লক্ষ্মণকে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস কি ভোলা সম্ভব? দেশে, বিদেশে টেস্টে তিন নম্বর জায়গাটা ছিল দ্রাবিড়ের। তিনি নামা মানেই এক দিকে উইকেট আটকে পড়ে থাকা। সারা দিন ধরে ক্লান্তিহীন ব্যাটিং করে যাওয়া।

ক্রিকেটার দ্রাবিড় বহু বছরই অতীতের খাতায়। তাঁর ক্রিকেট জীবনের সব পরিশ্রম এক সময় ভাগ করে নিয়েছেন ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে। অনূর্ধ্ব-১৯ দল, জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির দায়িত্ব সামলানো, এই সব কিছুতেই ছিল দ্রাবিড়ের নিপুণ দক্ষতা। সেটার ফল ভারতীয় ক্রিকেট পাচ্ছে। গত দু’বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দাদা’দের সামলাতে হচ্ছে দ্রাবিড়কে। বিরাট, রোহিতেরা প্রচারের যে আলোকদ্যুতি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ান, দ্রাবিড় সে সবের থেকে বরাবরই বহু দূরে। ভারতীয় ক্রিকেটের জ্যামিকে (বাবা জ্যাম তৈরি কম্পানিতে চাকরি করতেন বলে সতীর্থেরা এই নামেই ডাকতেন দ্রাবিড়কে) তাই কিছু দিন আগে একটি সংস্থার বিজ্ঞাপনে ‘ইন্দিরানগর কা গুন্ডা’ রূপে দেখে চমকে গিয়েছিলেন সমর্থকেরা। দ্রাবিড় এটাও করতে পারেন! হ্যাঁ তিনি পারেন। দ্রাবিড় প্রচারমুখী না হলেও বিপক্ষের মুখের গ্রাস কাড়তে জানেন। তিনি আগ্রাসী নন। দ্রাবিড় ২২ বলে ৫০ রান করেছেন বললে চমকে উঠবেন অনেকেই। কিন্তু দ্রাবিড় করেছেন। ব্যাট হাতে এমন ইনিংস দ্রাবিড়ের আছে। তিনি পারেন এমন সকলকে অবাক করে দিতে।

ভারতীয় সমর্থকেরা ১২ বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের। দ্রাবিড়ের অপেক্ষা আরও বেশি। ২০ বছর আগে ছুঁতে গিয়েও পারেননি। ১৯ নভেম্বর পারবেন কি রুপোর পদকটির রং বদলে নিতে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.