তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ স্বামী অভেদানন্দ। ২ রা অক্টোবর তাঁর জন্মদিন। অক্টোবরের দুই তারিখ নিয়ে বঙ্গবাসী তথা ভারতবাসীর একটি সম্ভ্রমের অন্তঃকরণ ও ইতিহাসও আছে; যেখানে বিতর্ক নেই, যেখানে রাজনৈতিক চালাকি নেই, যেখানে কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক নেই। আছে কেবল আধ্যাত্মিক শান্তি, সৌভদ্র, ত্যাগ এবং ভালোবাসা। প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর একবার বলেছিলেন, “ভদ্রকে বিগ্রহ কহে।” তাঁরই পরম্পরা পরম শ্রদ্ধেয় মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ১৯৩৩ সালের আর এক শিকাগো ধর্মমহাসভায় বলেছিলেন, হিন্দুধর্ম ভদ্রলোকের ধর্ম। এই ধর্মপ্রচারের জন্য স্বামী অভেদানন্দ বহুবছর বিদেশে অতিবাহিত করে ভারতীয় সংস্কৃতির সুখ ও গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। আজ যে সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থা ও ভরসার আবহ দেখতে পাচ্ছি, তা যারা আপন সৌকর্যে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, তাদেরই অন্যতম স্বামী অভেদানন্দ।
গড্ডালিকা প্রবাহে চলা মানুষের কথা বলছি না, কিন্তু সচেতন মানুষ জীবনের চলার পথে প্রেরণাদায়ী মানুষের মূর্তিই কেবল নিজের মতো করে নিজের মধ্যে গড়ে নেন; তাঁকে অনুসরণ করেন, স্মরণ-মনন করেন৷ বছরের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন মহাপুরুষের জীবনী পাঠ করি আমরা করে থাকি। সেই অনুষঙ্গে ২ রা অক্টোবরের দিনটি পবিত্রতার নিরিখে, আত্মোপলব্ধিতে ভেতর থেকেই বেছে নিই শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ স্বামী অভেদানন্দজীর জীবনচর্যা ও মানসচর্চায়, তাতে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। আর এক ব্যাক্তিত্বের কথা বলবো, তিনি প্রাক্তন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় লালবাহাদুর শাস্ত্রী। এর বাইরে এদিন কেউই হয়তো চিরশ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠান করেন না। তবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এক বড় বালাই!
এবার নিজের কথা বলি। অন্য আরও কারো জন্মদিন ২ রা অক্টোবর থাকলেও, তাঁর প্রতি আমার অশ্রদ্ধা কিছু নেই, তবে হয়তো স্বাভাবিক উদাসীনতা থাকতে পারে। এই উদাসীনতাকে অশ্রদ্ধার লক্ষণ বলা চলে না। না কঠিন, না তরল — সান্দ্র অবস্থা।
স্বামী অভেদানন্দের সন্ন্যাস-পূর্ব নাম শ্রী কালীপ্রসাদ চন্দ্র। ১৮৬৬ সালের ২ রা অক্টোবর কলকাতার আহিরীটোলায় তাঁর জন্ম। পিতা রসিকলাল ছিলেন কলকাতার একটি নামী ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার কৃতবিদ্য শিক্ষক। তাঁর পিতার ছাত্র ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত, শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ নাটকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। ১৮৮৩ সালে কলকাতায় সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দু ষড়দর্শন সম্বন্ধে বক্তব্য শুনে তাঁর হৃদয়পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়৷ ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, নিজেকে যোগী করে তোলবার চাহাদ যেন পেয়ে বসে! যোগ শিক্ষার উপযুক্ত গুরুর সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠলে একদিন দক্ষিণশ্বরের ভবতারিণী মায়ের সাধক পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নাম জানতে পারলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের যোগসূত্র ছিলেন তাঁর সহপাঠী যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য এবং পরে শশী মহারাজ বা স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। প্রথম রাতেই তিনি গুরুকে আপনার মতো করে পেলেন। কালীপ্রসাদকে গুরুদেব যোগাসনে বসিয়ে জিভে ও বুকে লিখে দিলেন মূলমন্ত্র। “তুই পূর্বজন্মে একজন খুব বড় যোগী ছিলি; সিদ্ধিলাভ করবার একটু বাকি ছিল — এই তোর শেষ জন্ম — আয় তোকে যোগ সাধনের উপায় শিখিয়ে দিই।” গুরুর স্পর্শে সেদিন শিষ্যের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি উর্ধমুখে উত্থিত হল, শিষ্য ধানমগ্ন হলেন, আর গুরুদেবের মধ্যে দেখলেন সকল দর্শনের সমুন্নত আদর্শ। সেদিনই কালীপ্রসাদের ‘অভেদ’ মন্ত্রে দীক্ষালাভ। তিনিই পরে হয়ে উঠবেন স্বামী অভেদানন্দ, স্বামীজির পর আধ্যাত্ম ভাবনায় পাশ্চাত্য দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলবেন এবং ভারতাত্মাকে প্রকাশ করবেন দেশে-বিদেশে।
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে স্বামী অভেদানন্দ-র সামীপ্য কেমন ছিল তা জানা যায় তাঁর জীবনকথা থেকে —
“১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে যে সকল ঘটনা শ্রীম-লিখিত ‘কথামৃত’-গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে তাহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি উপস্থিত ছিলাম, কিন্তু আমি অল্পবয়স্ক (স্বামী অভেদানন্দের জন্ম ২ রা অক্টোবর, ১৮৬৬, এই সময় তাঁর বয়স ১৮) ছিলাম বলিয়া বোধহয় কথামৃতের সকল জায়গায় আমার নাম উল্লেখ করা হয় নাই, ফলে আমি ‘ইত্যাদি’-র মধ্যে পড়িয়া গিয়াছি। এই কথা অবশ্য আমি ‘শ্রীম’-র জীবদ্দশায় তাঁহাকে বহুবারই বলিয়াছি, কিন্তু কিজন্য জানি না মাষ্টার-মহাশয় ‘ইত্যাদি’ গণ্ডীতেই আমাকে ফেলিয়া রাখিয়াছিলেন।”
এ প্রসঙ্গে বলা যায় ১৮৮১ সালের নভেম্বরে নরেন্দ্রনাথ সিমুলিয়ায় সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম দর্শন পান।
১৮৮২ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম/মাস্টার মশায়) দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন।
১৮৮৪ সালে স্বামী অভেদানন্দ (পূর্ব নাম কালীপ্রসাদ চন্দ্র) শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম দর্শন লাভ করেন।
এবার জানাই স্বামী অভেদানন্দের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকটি বিশেষ মুহূর্তে উপস্থিতির কথা :
১. ১৮৮৪ সালের ৩০ শে জুন যেদিন সুরেশচন্দ্র মিত্রের উদ্যোগে কলকাতার রাধাবাজারে বেঙ্গল ফটোগ্রাফ কোম্পানির স্টুডিওতে শ্রীরামকৃষ্ণের ফটো তোলা হয়, সেদিন অভেদানন্দ উপস্থিত ছিলেন।
২. ১৮৮৪ সালের ৩ রা জুলাই রথের দিন বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে আনন্দে নৃত্য করেছিলেন।
৩. ১৮৮৪ সালের ১৫ ই জুলাই সুরেশচন্দ্র মিত্রের বাগান বাড়ীর মহোৎসবে স্বামী অভেদানন্দ উপস্থিত ছিলেন।
৪. দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ কর্তৃক গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বকলমা’ নেবার দিন অভেদানন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
৫. শশধর তর্কচূড়ামণি যেদিন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন, সেদিনও অভেদানন্দ উপস্থিত ছিলেন।
৬. কলকাতার হাটখোলায় বারোয়ারীতলায় যেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ নীলকন্ঠের কৃষ্ণযাত্রা শুনতে গিয়েছিলেন সেদিন উপস্থিত ছিলেন অভেদানন্দ।
৭. ১৮৮৫ সালের ২৪ শে এপ্রিল গলরোগের চিকিৎসার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতার দুর্গাচরণ ডাক্তারের কাছে দেখাতে গেলে সঙ্গে যান অভেদানন্দ।
৮. ১৮৮৫ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে পানিহাটির চিড়া মহোৎসবে যোগদানের যাত্রায় শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে অভেদানন্দ উপস্থিত ছিলেন।
৯. ১৮৮৫ সালের ৩১ শে অক্টোবর শ্যামপুকুরের বাড়িতে কোয়েকার সম্প্রদায়ের এক খ্রীষ্টান পরমহংসদেবকে দেখতে এলে সেদিনও অভেদানন্দ উপস্থিত ছিলেন।
১০. ১৮৮৫ সালের ১১ ই ডিসেম্বর শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে শ্যামপুকুর থেকে কাশীপুর বাগানবাটিতে আনা হলে উপস্থিত ছিলেন অভেদানন্দ।
১১. ১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি কল্পতরু হয়েছিলেন ঠাকুর। সেদিনও অভেদানন্দ উপস্থিত।
১২. ১৮৮৬ সালের ১৬ ই আগষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহাসমাধির দিন অভেদানন্দ সেখানে ছিলেন।
স্বামী অভেদানন্দ রচিত ‘আমার জীবনকথা’ গ্রন্থের বিবরণ কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন গলায় দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত। সেদিন অফিস ছুটি। বিকেলে বাগানবাটিতে এসেছেন গিরিশ ঘোষ সহ গৃহস্থ ভক্তরা। সেবক-পার্ষদরাও রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এদিন কিছুটা সুস্থ অনুভব করে দোতালা থেকে নীচে নেমে বাগানে হাঁটছেন। এরই মধ্যে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে কথা হল। ঐশী সংলাপে ঠাকুর বাহ্যজ্ঞানশূণ্য হলেন। ভাবাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। সংজ্ঞালাভ করে সবাইকে আশীর্বাণী দিলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক্’। সকলকে স্পর্শ করলেন, তাদের অধ্যাত্ম-আঁখি খুলে দিলেন, সকলের সকল প্রার্থনা পূরণ করলেন। “ভাই ভূপতি সমাধি প্রার্থনা করিয়াছিল। তাহাকে শ্রীশ্রীঠাকুর কৃপা করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তোর সমাধি হবে’। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত গরীব অবস্থায় অর্থাভাবে কষ্ট পাইতেছিলেন বলিয়া অর্থ প্রার্থনা করিয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাহাকে কৃপা করিয়া বলিলেন, ‘তোর অর্থ হবে।’ রামলালদাদা, বৈকুন্ঠ সান্যাল প্রভৃতি গৃহস্থ-ভক্তদিগকে তাহাদের যাহা যাহা প্রার্থনা ছিল, তাহা তিনি আশ্বাস দিয়া ‘পূর্ণ হবে’ বলিয়া কৃপা করিলেন।”
স্বামী অভেদানন্দের আত্মজীবনী মূলক লেখায় পাওয়া যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ তখন কর্কট রোগাক্রান্ত; কাশীপুর বাগান-বাড়িতে অবস্থান করছেন। পার্ষদ কালীপ্রসাদ চন্দ (স্বামী অভেদানন্দ) ঠাকুরের সেবক হিসাবে সেখানে রয়েছেন; রয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ সহ অন্যান্য গুরুভাই ও সহধর্মিণী সারদা দেবী। ঠাকুরের গলার ব্যথা বাড়ছে, তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন, ঠিকমতো পদচারণা করতে পারছেন না। চিকিৎসকেরা তাঁকে বলকারক পথ্য খেতে নির্দেশ দিয়েছেন, বলেছেন কচিপাঁঠার মাংসের স্যুপ খেতে হবে; তাহলেই শরীরে শক্তি পাওয়া যাবে। কালী মহারাজের লেখনী থেকে জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ সেবকদের বলছেন, “দ্যাখ্, তোরা যে দোকান থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনবি, দেখবি — সেখানে কষাই-কালীমূর্তি যদি না থাকে তাহলে মাংস কিনিস্ নি। যে দোকানে কষাই-কালীর প্রতিমা থাকবে সেই দোকান থেকে মাংস আনবি।” ভক্তেরা ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করেছিলেন। হিন্দুর দোকান থেকেই মাংস এনে শ্রীমার কাছে প্রদান করেছেন। শ্রীমা সেই মাংস অনেক সময় ধরে সিদ্ধ করে, ছেঁকে কাথ্বটুকু ঠাকুরকে খেতে দিয়েছেন। তখন তাঁর শক্ত জিনিস গলাধঃকরণ করার সামর্থ্য ছিল না। অর্থাৎ স্বামী অভেদানন্দের লেখা থেকে জানতে পারি, হিন্দুর দোকানে বিক্রি হওয়া ঝটকা মাংসই শ্রীরামকৃষ্ণদেন গ্রহণ করতেন এবং করেছেন।
স্বামী অভেদানন্দের মতো বৈদান্তিক সন্ন্যাসী খুব কমই জন্মেছেন। শ্রীমা সারদাকে নিয়ে বিখ্যাত স্তোস্ত্রটি তিনি লিখেছিলেন — “প্রকৃতিং পরমামভয়াং বরদাং…”। গানটি যখন গাওয়া হল, মা সারদা বললেন, ” এই ছেলেটির জিহ্বায় সরস্বতী বসবেন।” সত্যিই তাই, দেবী সরস্বতীর বরপুত্র তিনি। আমেরিকার তিনি যে শতশত বক্তৃতা দিয়েছেন, লিখেছেন, আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অনন্য বাগ্মিতা, এবং চিরন্তন জ্ঞান। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন, রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ৷ ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে স্বামী অভেদানন্দ এক অমোচ্য নাম। তাঁর জন্মের পর দেড়শো বছর পেরিয়ে গেছে। তাঁর রচনাসম্ভারে যে অগুনতি উপহার বিশ্ববাসীর জন্য দিয়ে গেছেন, তা যেন আমরা পড়ে দেখি এবং অনুভব করি।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।