স্বামীজী বলছেন, “This world is the great gymnasium where we come to make ourselves strong.” রাজযোগ গ্রন্থে আছে, এই দেহই আমার শ্রেষ্ঠ যন্ত্র, শ্রেষ্ঠ সহায়, চিন্তা করিবে — ইহা বজ্রের ন্যায় দৃঢ়,…. দুর্বল ব্যক্তি কখনও মুক্তিলাভ করিতে পারে না। সর্বপ্রকার দুর্বলতা পরিত্যাগ কর। শরীরকে বলো — তুমি বলিষ্ঠ। মনকে বলো — তুমি শক্তিধর ; এবং নিজের উপর অসীম বিশ্বাস ও ভরসা রাখো।
স্বামীজী বলছেন, “Strength is life; weakness is death.” বলছেন, “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।”
“You will understand the Gita better with your biceps, your muscles, a little stronger.” বলছেন, “আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংসপেশী লোহা দিয়ে তৈরি, স্নায়ুগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরি আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা বজ্রের উপাদানে গঠিত।” স্বামীজি মনে করতেন দুর্বলতাই পাপ। শুভঙ্করী কাজে শক্তির প্রয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। জগতের কল্যাণের জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য শক্তির প্রয়োগই হচ্ছে ধর্ম। তাই তাড়াতে হবে অলসতা, অকর্মণ্যতা। শরীর মনকে সতেজ রাখতে, জীবনকে গতিময় ছন্দে আনতে খেলাধূলা করতে হবে, শরীর চর্চা করতে হবে। এবং এই কাজ সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই করা দরকার।
স্বামীজী মনে করতেন শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের এক তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ। আমরা যে একসঙ্গে মিলতে পারিনা, পরস্পরকে ভালোবাসিনা, তোতাপাখির মত কথা বলে যাই, আচরণে পশ্চাৎপদতা দেখাই — তার আসল কারণ হল আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল। প্রথমে সবল হতে হবে, তারপর ধর্ম। বেদের প্রার্থনায় বলের উপাসনা, সামর্থ্যের উপাসনা, শক্তির উপাসনার কথা পাই — “তেজেহসি তেজো ময়ি ধেহি। বীর্যমসি বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি। বলমসি বলং ময়ি ধেহি। ওজোহস্যোজি ময়ি ধেহি।” হে তেজস্বরূপ, আমায় তেজস্বী কর; হে বীর্যস্বরূপ, আমায় বীর্যবান কর; হে বলস্বরূপ, আমায় বলবান কর; হে ওজঃস্বরূপ, আমায় ওজস্বী কর।
স্বামীজি ইচ্ছাশক্তির একত্র সম্মিলন, এককেন্দ্রিকরণের কথা বলেছেন। বলছেন, ভারতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে হলে এই সংহতি, শক্তিসংগ্রহ ও বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তির একত্র মিলন ঘটাতে হবে। উদাহরণ দিচ্ছেন — চার কোটি ইংরাজ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর উপর কীরূপে প্রভুত্ব করিতেছে? ইহার উত্তর কি? এই চার কোটি ইংরাজ তাহাদের সমুদয় ইচ্ছাশক্তি একযোগে প্রয়োগ করিতে পারেন, এবং উহার দ্বারাই তাঁহাদের অসীম শক্তিলাভ হইয়া থাকে; তোমাদের ত্রিশ কোটি লোকের প্রত্যেকের ভাব ভিন্ন ভিন্ন। ঋগ্বেদ সংহিতা উদ্বৃত করে বলছেন একচিত্ত হওয়াই সমাজ গঠনের রহস্য। “সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।” তোমরা মিলিত হও, বিরোধ কোরো না। তোমরা সকলে এক অন্তঃকরণ বিশিষ্ট হও। দেবতারা একমনা হয়েই যজ্ঞভাগ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দেবতারা একচিত্ত বলেই মানুষের উপাসনার যোগ্য।
স্বামীজী ভারতবর্ষ বলতে হিন্দুদের ভারতবর্ষ বুঝতেন। মনে করতেন খ্রীষ্টান মিশনারি ও নানান সংস্কার সভাগুলির হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা ও হিংসার পরিমাণ এত বেশী যে, সে বিষয়ে তাদের কাছে কোন রকম প্রশ্ন করা অর্থহীন। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন — এরা কেন হিন্দুদের সংস্কার-চেষ্টার বিরোধী হবেন? এরা কেন এইসব আন্দোলনের প্রবল শত্রু হয়ে দাঁড়াবেন? (আমার সমরনীতি, বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র) বিবেকানন্দের স্বাজাত্য বোধের উৎস ছিল হিন্দুত্ব — “হিন্দুজাতি সমগ্র জগত জয় করিবে।” তিনি বলেছেন হিন্দুসমাজে যে সমস্ত বিশেষ দোষ রয়েছে, তা বৌদ্ধধর্মজাত; তার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতি। প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে তিনি ‘বেশ্যাবৃত্তি’-র সাথে তুলনা করে তিরস্কার করেছেন। হিন্দু সমাজত্যাগী মুসলিমদের স্বামীজী ‘দেশের শত্রু’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, কোনো লোক হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে অন্যধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়, একটি করে শত্রু বৃদ্ধি হয়। তিনি বেদান্ত দর্শনকে মহাসত্য বলে মনে করেছেন। “বেদান্ত — কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোনো ধর্মই নয়।”
ভারতবর্ষ হিন্দুপ্রধান দেশ। হিন্দুধর্মের এই জল হাওয়া পছন্দ না হলে তিনি তাকে প্রকারান্তরে দেশ ত্যাগ করবার পরামর্শ দিয়েছেন — “এ দেশে সেই বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালি পাঁঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন এ দেশে চিরকাল।যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন।”
১৮৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্মমহাসভায় খ্রীষ্টানদের উদ্দেশ্য করে আরেকটি ভাষণে বলেন, “তোমরা খ্রীষ্টানেরা পৌত্তলিকদের আত্মাকে উদ্ধার করবার জন্য তাদের কাছে ধর্মপ্রচারক পাঠাতে খুবই উৎসাহী; কিন্তু বল দেখি অনাহার ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেহগুলো বাঁচাবার জন্য কোনো চেষ্টা কর না কেন? ভারতবর্ষে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় হাজার হাজার মানুষ খিদেয় মৃত্যুমুখে পড়ে, কিন্তু তোমরা খ্রীষ্টানেরা কিছুই করনি। তারা ভাত চাইছে আর আমরা তাদের পাথরের টুকরো তুলে দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র পড়ানো হল তাকে অপমান করা।” তিনি পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছেন যদি কোন সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপাসনায় আপত্তি থাকে, তবে তাহার নিজেকে হিন্দু বলিবার অধিকার নাই। মনে করেছেন কেবল তখনই কেউ প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য যখন ঐ নামটিতে তার ভেতরে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হবে। যখন যেকোনো দেশীয়, যেকোনো ভাষাভাষী হিন্দু নামধারী হলেই পরমাত্মীয় বোধ হবে।যখন হিন্দুনামধারী যে কোন ব্যক্তির দুঃখকষ্ট তার হৃদয় স্পর্শ করবে, নিজের সন্তান বিপদে পড়লে যেরকম উদ্বিগ্ন হয় তার কষ্টেও সেরকম উদ্বিগ্ন হবে। তিনি তাই হিন্দুদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ ভুলে, চারিদিকে প্রেমের প্রবাহ বিস্তার করতে বলেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দ বৌদ্ধদের অজ্ঞেয়বাদ, জৈনদের নিরীশ্বরবাদ, গুরুগোবিন্দ সিংহের মতবাদের জায়গা হিন্দুধর্মে আছে বলে মনে করতেন।
১৮৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম মহাসভার ষোড়শতম দিনের অধিবেশনে তিনি বললেন, “Hinduism cannot live without Buddhism, nor Buddhism without Hinduism…the Buddhists cannot stand without the brain and philosophy of the Brahmins, nor the Brahmin without the heart of the Buddhist. This separation between the Buddhists and the Brahmins is the cause of the downfall of India.” বৌদ্ধধর্ম ছাড়া হিন্দুধর্ম বাঁচতে পারে না। হিন্দুধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধধর্মও বাঁচতে পারে না। ব্রাহ্মণের ধীশক্তি ও দর্শনের সাহায্য না নিয়ে বৌদ্ধরা দাঁড়াতে পারে না। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যের এই বিচ্ছেদই ভারতবর্ষের অবনতির কারণ। তিনি তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “Let us then join the wonderful intellect of the Brahmin with the heart, the noble soul, the wonderful humanising power of the Great Master.” তাই তিনি ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণের অভিনব ধীশক্তির সঙ্গে লোকগুরু বুদ্ধের হৃদয়, মহান আত্মা ও অসাধারণ লোককল্যাণশক্তি যোগ করতে।বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্মের সাথে একই ছায়ার নিচে আনতে চেয়েছিলেন। ‘প্রবুদ্ধ’ কথাটির মধ্যে রয়েছেন হিন্দুদের দশাবতারের অন্যতম শেষ অবতার বুদ্ধ (প্র+বুদ্ধ = প্রবুদ্ধ)। তিনি মনে করতেন গৌতমবুদ্ধের সঙ্গে ভারত জুড়লে হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন ঘটবে। “I repeat, Shakya Muni came not to destroy, but he was the fulfilment, the logical conclusion, the logical development of the religion of the Hindus.” হিন্দুদের মনে কোন আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে ‘প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি —
“আবার প্রবুদ্ধ হও!
এ নিদ্রা, মৃত্যুতে নয়, জীবনেই ফিরাতে আবার,
এ শুধু বিশ্রাম, যাতে চোখে ভাসে নতুন স্বপ্নের
অদম্য সাহস। দেখো, হে সত্য, পৃথিবী চায় তোমাকেই,
তুমি মৃত্যুহীন।”
স্বামীজী উপনিষদের ঋষির মত আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন আমরা অমৃতের পুত্র, আমরা অমৃতের অধিকারী। “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা…. ।” হে অমৃতের পুত্রেরা, শোন — আমি এই অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার রাস্তা পেয়েছি। আমি সেই প্রাচীন মহান পুরুষকে জেনেছি, যিনি সকল আঁধারের ওপারে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে। এই প্রাচীন বাণী শুনিয়ে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন হিন্দুধর্মে আমাদের পাপী বলতে চাওয়া হয় না। আমরা পবিত্র ঈশ্বরের সন্তান, আমরা মর্ত্যভূমির দেবতা। মানুষকে পাপী বলার মত মহাপাপ আর নেই। এ যে মনুষ্যত্বের স্বরূপের ওপর একটা মিথ্যের কলঙ্ক আরোপের প্রচেষ্টা। স্বামীজী এই ভুল বদলে দিতে চেয়েছেন। আমাদের মেষ বলে মনে করতে মানা করেছেন, বলেছেন সিংহের মত হয়ে যেতে। “Come up, O lions, and shake off the delusion that you are sheep; you are souls immortal, spirits free, blest and eternal.”
স্বামীজী রাষ্ট্রের আত্মার কথা বলেছেন। বলেছেন এই আত্মাতে যতদিন না ঘা পড়ে, ততদিন সেই রাষ্ট্রের মৃত্যু নেই। স্বামীজী উদাহরণদান দিচ্ছেন রাষ্ট্রের আত্মা বা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয়ত্ব যেন সাপের মাথার মণি, যেন রূপকথার জগতে রাক্ষসীর প্রাণভোমরা। যতক্ষণ রূপকথার সাপের মাথায় মণি থাকবে ততক্ষণ তাকে মারা যাবে না। যতক্ষণ রাক্ষসীর প্রাণভোমরা-রূপ ক্ষুদ্র পাখির ভিতর তার প্রাণ ততক্ষণ তাকে মারা যাবে না। সাপ বা রাক্ষসীকে মারতে হলে মাথার মণি সরাতে হবে, সেই প্রাণপাখিকে টুকরো করে কেটে ফেলতে হবে। স্বামীজী বলছেন, ভারতবর্ষের যে রাষ্ট্রীয় সৌধ, ভারত রাষ্ট্রের যে মেরুদণ্ড তার আত্মা রয়েছে ধর্মে। ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন নিহিত অাছে হিন্দুধর্মে। তিনি ভারত রাষ্ট্রের মন ও প্রাণপ্রবাহের স্বরূপ চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন ধর্ম অনুসরণ করলেই দেশ গৌরবান্বিত হবে। ধর্ম পরিত্যাগ করলে রাষ্ট্রীয় মৃত্যু অনিবার্য। বৈদেশিক আগ্রাসনকারীর অত্যাচারে মন্দিরের পর মন্দির ধবংস হয়েছে, নেমে এসেছে নানাবিধ আক্রমণ, ধ্বংসলীলা। কিন্তু অত্যাচারের স্রোত সামান্য বন্ধ হওয়ামাত্র পুনরায় উঁকি মেরেছে মন্দিরের চূড়া, স্পষ্টতর হয়েছে পুনরাভ্যুত্থানের চিহ্ন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত হয়েছে নতুন জীবন, সে জীবন অটল-অচল ভাবে বিরাজ করেছে আগের মতই।
রাক্ষসীর প্রাণ-পাখির মত ভারতবর্ষের ধর্ম-রূপ প্রাণ-পাখিকে বিনাশ করা যায়নি বলেই এত সয়ে এ জাতটা বেঁচে গেল। হাজার হাজার বছরের স্বভাব — তা মরবেই বা কী করে? স্বামীজী ভারতবর্ষের এই জাতীয় চরিত্র বদলের কথা বলেন নি। তাঁর মতে যে নদী পাহাড় থেকে হাজার ক্রোশ নেমে আসে তাকে ফের পাহাড়ে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। বলছেন, যদি এ দশ হাজার বৎসরের জাতীয় জীবনটা ভুল হয়ে থাকে তো এখন উপায় নেই, এখন একটা নূতন চরিত্র গড়তে গেলেই মরে যাবে বই তো নয়। বলছেন, যে দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম সে দেশকে ধর্মের মধ্য দিয়েই সব করতে হবে। “রাস্তা ঝেঁটানো, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান, এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের মধ্য দিয়ে হয় তো হবে, নইলে ঘোড়ার ডিম, তোমার চেঁচামিচিই সার..।” ভারতবর্ষের পক্ষে ধর্মের মধ্য দিয়ে ছাড়া কাজ করবার যে অন্য উপায় নেই তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বামীজী জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সতর্ক করে তিনি বলেছেন ধর্ম ছেড়ে জড়বাদসর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হলে ভারতবর্ষের সুবিশাল রাষ্ট্রীয় সৌধ তিনপুরুষ যেতে না যেতেই বিনষ্ট হবে, হিন্দুর মেরদন্ড ভেঙ্গে যাবে। এ প্রসঙ্গে স্বামীজীর পরামর্শ হল, যে অমূল্য ধর্মসম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি তা প্রাণপণে ধরে রাখতে হবে। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। বলেছেন, তোমরা ধর্মে বিশ্বাস কর বা নাই কর, যদি জাতীয় জীবনকে অব্যাহত রাখতে চাও, তবে তোমাদিগকে এই ধর্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হইবে।
স্বামীজি একহাতে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে ধরে অন্য হাত প্রসারিত করতে বলেছেন শেখবার জন্য, বলেছেন সেই শিক্ষণীয় বিষয় যেন হিন্দুজীবনের মূল আদর্শের অনুগত হয়। “What we want are western science coupled with Vedanta and Brahmacharya as the guiding motto.” এটিই হচ্ছে নতুন যুগের বিশ্বায়নের মূলমন্ত্র। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদান্তের সমন্বয়, যার মূলে থাকবে ব্রহ্মচর্য।
স্বামীজী বলেছেন, “Education is the manifestation of the perfection already in man.” শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ। “Knowledge is inherent in man; no knowledge comes from outside; it is all inside.” ঋষি অরবিন্দও মনে করতেন, কিছুই শেখানো যায় না এটাই হবে শিক্ষার প্রথম তত্ত্ব। শিক্ষক নির্দেশদাতা বা শাসনকর্তা নন, তিনি সহায়ক ও পথ প্রদশর্ক। স্বামীজী শিক্ষা ও ধর্মকে ভিন্ন ভিন্ন করে দেখাননি। ধর্ম হচ্ছে শিক্ষার ভেতরকার সার জিনিস। শিক্ষার লক্ষ্য মানুষ গড়া, ধর্মের লক্ষ্যও তাই। ধর্ম ও শিক্ষা একে অপরের পরিপূরক, বিকাশ ধারার দুই পথ। উভয়ের উদ্দেশ্যই মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিকাশ। “Religion is the idea which is raising the brute unto man, and man unto God.”
স্বামীজীর শিক্ষাভাবনায় ধর্মের একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি বলেছেন, যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী ও পরহিতরত হয় এই প্রকার শিক্ষা দিবে। ইহারই নাম ধর্ম।… ধর্মের যাহা সার্বজনীন সাধারণ ভাব তাহা শিখাইবে। দেশের শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে শিক্ষার ভাবসামঞ্জস্য থাকার কথা বলেছেন। শিক্ষা যেন জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অনুগামী হয়। স্বামীজী পূর্বের মত ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, ব্রহ্মচর্যকে শিক্ষার বিশেষ সহায়ক বলে অভিহিত করেছেন। ব্রহ্মচর্য একাগ্রতার সহায়ক ও অসীমশক্তি দায়ক যা বিদ্যার্থীর বিদ্যা অর্জনে একান্ন প্রয়োজনীয়। এতে আত্ম সংযমের অনুশীলন হয়, প্রবল সক্রিয়তা আর ইচ্ছাশক্তি জাগরূক হয়।
স্বামীজি মনে করেছেন, ছাত্র জীবন ভোগের জীবন নয়, প্রস্তুতির জীবন। সৎকর্ম, সৎসঙ্গ, সৎচিন্তা, সদাভ্যাসে মনের শুচিতা রক্ষিত হয়। প্রায় একই উক্তি উক্তি রবীন্দ্রনাথেরও, “জীবনের আরম্ভকালে বিকৃতির সমস্ত কৃত্রিম কারণ হইতে স্বভাবকে প্রকৃতিস্থ রাখা নিতান্তই আবশ্যক। প্রবৃত্তির অকালবোধন এবং বিলাসিতার উগ্র উত্তেজনা হইতে মনুষ্যত্বের নবদ্গমের অবস্থাকে স্নিগ্ধ করিয়া রক্ষা করাই ব্রহ্মচর্য পালনের উদ্দেশ্য।” স্বামীজী বলছেন, একমাত্র ব্রহ্মচর্য পালন ঠিক ঠিক করতে পারলে সমস্ত বিদ্যা মুহূর্তে আয়ত্ত হয়ে যায় — শ্রুতিধর স্মৃতিধর হয়। “Do you see, simply by the observance of strict brahmacarya (continence), all learning can be mastered in a very short time — one has an unfailing memory of what one hears or knows but once.” স্বামীজীর ‘গুরুগৃহবাসম’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘তপোবনের কেন্দ্রস্থলে গুরু’-র মধ্যে যে তফাৎ তা হল: বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন সন্ন্যাসীর দ্বারা পরিচালিত আশ্রম আর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন গৃহী-গুরু। তবে বিদ্যা অাদান প্রদানের পরিবেশটুকু দু’জনের ক্ষেত্রেই প্রায় এক।
স্বামীজীর রচনাবলীর মধ্যে যা খুব বেশী করে পাই তা হল শূদ্র-জাগরণের কথা। তাঁর ‘স্বদেশ মন্ত্র’ সেই বার্তার আবিষ্ট মনের আত্মপ্রকাশ, সর্বতন্ময়ীভূত সম্বিতের বিদ্যুৎপ্রবাহ — যা শ্রোতার অন্তরকেই শুধু স্পর্শ করে না, সমগ্র মনঃপ্রকৃতিকেই পরম আশ্বাসে ভরে তোলে। “ভুলিও না — নিচ জাতি মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।” বলেছিলেন, খুব নীচু চন্ডাল হলেও আরও বেশী আনন্দ হত; কারণ তিনি যাঁর শিষ্য, শ্রী রামকৃষ্ণ একজন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হলেও এক অস্পৃশ্য মেথরের বাড়ি পরিষ্কার করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। লোকটি তাতে সম্মত হয় না। একে ব্রাহ্মণ, তায় আবার সন্ন্যাসী; তার ঘর পরিষ্কার করবেন, তাতে সম্মত হবেন বা কি করে? তাই শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর রাত্রে অজ্ঞাতসারে তার ঢুকে তিনি পায়খানা পরিষ্কার করতেন এবং বড় বড় চুল দিয়ে সেই জায়গা মুছতেন। দিনের পর দিন এরকম করতেন তিনি, নিজেকে সকলের চাকর ও সেবক করে তোলার এক অনবদ্য সাধনা।স্বামীজী বলেছেন এমন লোকের শ্রীচরণ তিনি মাথায় ধরে আছেন।
স্বামীজি আশা প্রকাশ করেছেন নতুন ভারত বেরোবে লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালা, মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে থেকে। নতুন ভারত বেরোবে মুদির দোকান থেকে, ভুট্টাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। এরা হাজার হাজার বছরের অত্যাচার নীরবে সয়েছে, সনাতন দুঃখ ভোগ করেছে, কিন্তু পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা, অটল জীবনীশক্তি। যারা একমুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়াটা উল্টে দিতে পারে, তারা আধখানা রুটি ত্রৈলোক্যকে তেজে ভরিয়ে দেবে। তাই উদাত্ত কন্ঠে স্বামীজীর আহ্বান, “হে বীর! সাহস অবলম্বন কর; সদর্পে বল — আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।” বলেছেন শিবজ্ঞানে জীবসেবার কথা। উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “আত্মনোমোক্ষার্থাং জগদ্ধিতায়চ।”
তথ্যপঞ্জি:
১. বিবেকানন্দ রচনাসমগ্র, অখন্ড বাংলা সংস্করণ, ১৯৯৩ (২১ তম মুদ্রণ), নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা।
২.স্বামীজীর হিন্দুরাষ্ট্রচিন্তা, ২০১২ ( চতুর্থ সংস্করণ), বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা।
৩. উত্তিষ্ঠ, চতুশ্চত্বারিংশত্তম সংখ্যা, ২০১০-২০১২, রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক), রহড়া।
৪. Vivekananda : His call to the Nation, 1997 (Sixteenth Impression), Advaita Ashrama, Calcutta.
৫. শুভমনকথা, মুখ্যভাবনা: সার্ধশত জন্মবর্ষে স্বামী বিবেকানন্দ
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী