কারগারে যখন কৃষ্ণ নিজেই আগলে রাখেন। — কল্যাণ চক্রবর্তী।

কারাগারে যেমন অপরাধীকে বন্দী রাখা হয়, তেমন অনেক অপরাধীই থাকেন বাইরে, আর কারাগারে পচেন আলোকময় পুরুষ ৷ যুগেযুগে এই দ্বিবিধ রূপ কারাগারে বা তার বাইরে দেখতে পাওয়া যায়। কৃষ্ণের সঙ্গে কারাগারের প্রাচীন যোগ। তবে কৃষ্ণের মতো নাম হলেই তিনি সুকৃতির অধিকারী হন না। “কানাছেলের নামও পদ্মলোচন” হয়। ‘আসল’ আর ‘ভেজাল’; বহু বৈচিত্র্য মহামায়ার লীলা।

কৃষ্ণের জন্ম কংসের কারাগারে। আর ইংরেজদের কারাগারে শ্রীঅরবিন্দের কৃষ্ণ দর্শন। কারাগারের নির্জনতায়, একাকিত্বে এবং অখণ্ড অবসরে আত্মোপলব্ধি ও আত্মবোধনের যে সুযোগ ঘটে, তা অস্বীকার করেন নি রাষ্ট্রবাদী মানুষ। বহু বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ তাদের কারাজীবনেই তৈরি করে ফেলেছিলেন দেশগঠনের পরিকল্পনা। ভারতীয় দর্শনে এক অভূতপূর্ব স্থান দখল করে আছে কারাগার।

শ্রীঅরবিন্দকে কারাগারে বন্দী করেছিলেন ইংরেজ শাসক। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘কারাকাহিনী’ গ্রন্থে অরবিন্দ লিখলেন, “কারাবাসের পূর্বে আমার সকালে এক ঘন্টা ও সন্ধ্যাবেলায় এক ঘন্টা ধ্যান করিবার অভ্যাস ছিল। এই নির্জন কারাবাসে আর কোনও কার্য না থাকায় অধিককাল ধ্যানে থাকিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু মানুষের সহস্র-পথ-ধাবিত চঞ্চল মনকে ধ্যানার্থে অনেকটা সংযত ও এক লক্ষ্যগত রাখা অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে সহজ নয়। কোনও মতে দেড়ঘণ্টা দুইঘণ্টা একভাবে রাখিতে পারিতাম, শেষে মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিত, দেহও অবসন্ন হইয়া পড়িত।… এমন অবস্থা হইতে লাগিল যেন সহস্র অস্পষ্ট চিন্তা মনের দ্বার সকলের চারিদিকে ঘুরিতেছে অথচ প্রবেশ পথ নিরুদ্ধ; দুয়েকটি প্রবেশ করিতে সমর্থ হইয়াও সেই নিস্তব্ধ মনোরাজ্যের নীরবতায় ভীত হইয়া নিঃশব্দে পলায়ন করিতেছে। এই অনিশ্চিত অবশ অবস্থায় অতিশয় মানসিক কষ্ট পাইতে লাগিলাম।…জেলের ঘরের সেই নির্জীব সাদা দেওয়াল দর্শনে যেন মন আরও নিরুপায় হইয়া কেবল বদ্ধাবস্থার যন্ত্রণাই উপলব্ধি করিয়া মস্তিষ্ক পিঞ্জরে ছটফট করিতে লাগিল। আবার ধ্যানে বসিলাম, ধ্যান কিছুতেই হইল না বরং সেই তীব্র বিফল চেষ্টায় মন আরও শ্রান্ত, অকর্মণ্য ও দগ্ধ হইতে লাগিল। ..কাল যেন তাহার (বিদ্রোহী মন) উপর অসহ্য ভার হইয়া পীড়ন করিতেছে, সেই চাপে চূর্ণ হইয়া সে হাঁপ ছাড়িবার শক্তিও পাইতেছে না, যেন স্বপ্নে শত্রুদ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি গলাপীড়নে মরিয়া যাইতেছে অথচ হাত পা থাকিয়াও নড়িবার শক্তি রহিত। তখন বুঝিতে পারি নাই যে ভগবান আমার সহিত খেলা করিতেছেন, ক্রীড়াচ্ছলে আমাকে কয়েকটি প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতেছেন। প্রথমতঃ, কিরূপ মনের গতিতে নির্জন কারাবাসের কয়েদী উন্মত্ততার দিকে ধাবিত হয়, তিনি তাহা দেখাইয়া এইরূপ কারাবাসের অমানুষিক নিষ্ঠুরতা বুঝাইয়া আমাকে য়ুরোপীয় জেলপ্রণালীর ঘোর বিরোধী করিলেন, এবং যাহাতে আমার সাধ্যমত আমি দেশের লোককে ও জগৎকে এই বর্বরতা হইতে ফিরাইয়া দয়ানুমোদিত জেলপ্রণালীর পক্ষপাতী করিবার চেষ্টা করি তিনি সেই শিক্ষা আমাকে দিলেন।

ভগবানের দ্বিতীয় অভিসন্ধি বুঝিলাম, আমার মনের এই দুর্বলতা মনের সম্মুখে তুলিয়া তাহা চিরকালের জন্য বিনাশ করা। যে যোগাবস্থাপ্রার্থী তাহার পক্ষে জনতা ও নির্জনতা সমান হওয়া উচিত। বাস্তবিক অতি অল্পদিনের মধ্যে এই দুর্বলতা ঘুচিয়া গেল, এখন বোধহয় দশ বৎসর একাকী থাকিলেও মন টলিবে না।… তৃতীয় অভিসন্ধি, আমাকে এই শিক্ষা দেওয়া যে আমার যোগাভ্যাস স্বচেষ্টায় কিছু হইবে না, শ্রদ্ধা ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই সিদ্ধিলাভের পন্থা, ভগবান স্বয়ং প্রসন্ন হইয়া যে শক্তি সিদ্ধি বা আনন্দ দিবেন, তাহাই গ্রহণ করিয়া তাঁহার কার্যে লাগান আমার যোগলিপ্সার একমাত্র উদ্দেশ্য। যেদিন হইতে অজ্ঞানের প্রগাঢ় অন্ধকার লঘীভূত হইতে লাগিল, সেদিন হইতে আমি জগতের ঘটনা-সকল নিরীক্ষণ করিতে করিতে মঙ্গলময় শ্রীহরির আশ্চর্য অনন্ত মঙ্গল স্বরূপত্ব উপলব্ধি করিতেছি। “

ক্রমে যোগাভ্যাস করে শ্রীঅরবিন্দ কারাজীবনে পেলেন এক পরমানন্দের সন্ধান। তখন আর মনে হত না, কারার উচ্চ দেওয়ালে তিনি বন্দী। সর্বত্রই দেখতেন বাসুদেবের দিব্য উপস্থিতি। কয়েদীদের দেহের মধ্যে যেন পরিলক্ষিত হচ্ছিল ভগবান নারায়ণ। সাধু পুরুষ আর ছোটোলোকের মধ্যে ভেদ খুঁজে পেলেন না। উত্তরপাড়া অভিভাষণে তিনি বলছেন, “যে জেল আমাকে মানবজগৎ থেকে আড়াল করে রেখেছে সেই দিকে আমি তাকালাম, কিন্তু দেখলাম আমি আর জেলের উচ্চ দেওয়ালের মধ্যে বন্দী নই; আমাকে ঘিরে রয়েছেন বাসুদেব। আমার সেলের সম্মুখবর্তী বৃক্ষের ছায়ার তলে আমি বেড়াতাম, কিন্তু আমি যা দেখলাম তা বৃক্ষ নয়, জানলাম তা বাসুদেব, দেখলাম শ্রীকৃষ্ণ সেখানে দণ্ডা রয়েছেন এবং আমার উপর তাঁর ছায়া ধরে রয়েছেন। আমার সেলের দরজার গরাদের দিকে চাইলাম, আবার বাসুদেবকে দেখতে পেলাম। নারায়ণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার উপর পাহারা দিচ্ছিলেন। আমার পালঙ্ক-স্বরূপ যে মোটা কম্বল আমাকে দেওয়া হয়েছিল তার উপরে শুয়ে আমি উপলব্ধি করলাম শ্রীকৃষ্ণ আমাকে বাহু দিয়ে জড়িয়ে রয়েছেন; সে বাহু আমার বন্ধুর, আমার প্রেমাস্পদের। তিনি আমার যে গভীরতর দৃষ্টি খুলে দিয়েছিলেন, এইটিই হয়েছিল তার প্রথম ফল। জেলের কয়েদিদের দিকে আমি চাইলাম — চোর, খুনি, জুয়াচোর এদের দিকে যেমন চাইলাম আমি বাসুদেবকেই দেখতে পেলাম, সেই সব তমসাচ্ছন্ন আত্মা ও অপব্যবহৃত দেহের মধ্যে আমি নারায়ণকেই দেখতে পেলাম।…. ভগবান আমাকে বললেন, দেখ, কি সব লোকের মাঝে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি আমার একটু কাজ করবার জন্যে। যে-জাতকে আমি তুলতে চাই এই হচ্ছে তার স্বরূপ এবং এই কারণেই আমি তাদের তুলতে চাই।

পরিশেষে বলি, আসলে-নকলে জেল-জীবনে নিত্য-নাটের খেলা। কেউ মতাদর্শের জন্য কঠিন কারাজীবন ভোগ করেছেন, কেউ চুরি, রাহাজানি, খুনজখম করে কারান্তরালে দিনগত পাপক্ষয় করেছেন। কারাবাস কখনও কখনও সত্যবাদিকেও গ্রহণ করতে হয়, আদর্শবাদীর গন্তব্য হয়ে ওঠে কারাগার। দেশের উন্নয়ন-বিকাশের পুণ্য লড়াইয়ে জেল-খাটিয়ে মারে অপশাসনের কালোহাত। সেই হাত, সেই প্রাচীর মনের জোরে ভেঙে ফেলার নামই কৃষ্ণাশিস। এমন কারাগার জীবনের জয়গান গাওয়া রাষ্ট্রবাদীর আনন্দ নিকেতন হয়ে উঠেছে কখনও কখনও।

কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.