দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গাড়ি শিল্পের অংশগ্রহণ বেশ কিছুটা নিম্নমুখী। সামগ্রিক জিডিপি-র ঊর্ধ্বগতি স্তিমিত হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে অনেকেই গাড়ি কেনার বিষয়টি বিবেচনাধীন রেখেছেন। কিন্তু এই শিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে যে অনুসারী শিল্প সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব কিন্তু বিরাট। গাড়ি শিল্প ধাক্কা খেলেই টায়ার, রং, স্টিলের মতো শিল্পে প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অজস্র ছোটোখাটো ডাউনস্ট্রিম যেমন যন্ত্রপাতি তৈরি, আসনের রেক্সিনের সঙ্গে বিক্রির খুচরো বিক্রয়কেন্দ্র অর্থাৎ শোরুমগুলির কারবারেও বিপদ সংকেত চলে যাবে।
এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধি ৫ শতাংশে নামার পর গাড়ি শিল্পের এই সংকট অর্থনীতিকে আরও গভীর গাড়ার দিকে ঠেলতে পারার ক্ষমতা ধরে। উৎপাদকদের জমে থাকা inventory-র কারণে তাদের তরফে বিক্রি ফেরাতে নানা কর কমানো বা নানাবিধ ছাড় চাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সব রকমের শিল্পক্ষেত্রেই কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর ঘোষণায় শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষমতা বাড়বে। তবুও জিএসটি-র চড়া হারও বড়ো রকমের ‘সেস’ বলবৎ থাকায় গাড়ি শিল্পের খুব একটা সুবিধে হচ্ছে না। জিএসটি-র হার কমানোয় গাড়ির চড়া দাম থেকেই যাচ্ছে। এর ফলে চাহিদার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। ব্যক্তিগত আয়করের হারেও ছাঁটাই না করলে হাতে বাড়তি টাকা থাকার আশা কম, তারপর তো গাড়ি!
জিডিপির হিসেবের সময় তাতে উৎপাদন শিল্পের যে ভাগ থাকে তার মধ্যে আবার গাড়ি শিল্পের ভাগ ৪৯ শতাংশ। এই ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কম নিযুক্ত আছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ। সোসাইটি অব ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স-এর তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যে চুক্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে সাড়ে তিন লক্ষ লোক কাজ হারিয়েছেন। আরও দশ লক্ষের ভবিষ্যৎও এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে নিরাপদ নয়। কেননা অনেক জায়গায় ডিলাররা দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছেন। চাহিদা না থাকায় যেহেতু বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে অনেক ছোটোখাটো যন্ত্রাংশ নির্মাণকারীরা ইতিমধ্যেই কারবার গোটাতে বাধ্য হয়েছে।
গত বছরের তুলনায় এ বছরের টানা দশ মাসে গাড়ি বিক্রি ভয়ংকরভাবে পড়ে গেছে। আগস্টে তাবিপজ্জনকভাবে ৩১.৫৭ শতাংশ কমার মাত্রা ছুঁয়েছে।নিশ্চয়ই, সারা বিশ্বব্যাপীই গাড়ি শিল্পে ভাটার টান। এর মধ্যে ভারতে কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ও এর জন্য দায়ী যেমন কিছু ক্ষতিকারক নিয়ম কানুন। ভারত সরকার বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা লাগু করে নিশ্চিতভাবে দেশীয় গাড়ি শিল্পকে সংরক্ষণ দিয়েছে যাতে তার বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু সরকারের নিজস্ব কর আদায় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি মেটাতে তারা এই শিল্পটিকে কিছুটা কোষাগার হিসেবে ভাবতে শুরু করে। সামগ্রিক ভাবে জিএসটি বাবদ যে আদায় হয় তার শতকরা ১৫ শতাংশ হয় গাড়ি শিল্প খাতে। গাড়ি বিক্রির ওপর করের হার সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ-এর ওপর সেস রয়েছে। সব মিলিয়ে বিশাল ৫০ শতাংশ মোট কর হার দাঁড়াল। ভারতে ইস্পাত শিল্পকে নিরাপত্তা দেওয়ার একটা বরাবরের প্রবণতা থাকায় তাতে কৃত্রিমভাবে সুবিধে দিতে গাড়ি শিল্পই আদতে মার খায়। কেননা এখানে প্রচুর পরিমাণ ইস্পাত ব্যবহৃত হয়।
বহু রাজ্যে গাড়ির নথিবদ্ধকরণ ও পথচলতি কর বিপুল হারে বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে লোকের গাড়ি পোষা একটা বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভ্রান্ত সত্য কথাটি বলেছেন মারুতি উদ্যোগের চেয়ারম্যান। এত কিছুর পরও বাকি আছে ইরান থেকে তেল না কেনার সিদ্ধান্ত ও সৌদি আরবের তেল ভাণ্ডারের ওপর আক্রমণের পরিণতিতে তেলের দাম বাড়ার প্রভূত সম্ভাবনার দিকটি। সেটি হবে গাড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া।
সরকার বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ওপর কর হার ৫ শতাংশে নামিয়ে এনে চিরাচরিত তেলচালিত গাড়ির কর হার অপরিবর্তিত রাখার ফলে উভয়ের মধ্যে ব্যাপক ফারাক দেখা দেবে। এর পরিণতিতে বিদ্যুৎ ও তেল চালিত গাড়ির ক্ষেত্রে তুলনামূলক আকর্ষণ বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির অনুকুলেই যাবে। গাড়ি শিল্পেরমুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের চাকরি হারানো নিশ্চিত করবে। এর পরও বর্তমানে লাগু থাকা গাড়ির দূষণ সংক্রান্ত স্টেজ চার থেকে স্টেজ ছয়ে উত্তরণ বাধ্যতামূলক করায় বড়ো সমস্যা ডেকে আনবে। এই শর্ত পালন না হলে এপ্রিল ২০২০ থেকে সেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশনই হবে না। এই বিষয়টি মাথায় রেখে যেহেতু ৬ মাস পর থেকে স্টেজ ফোর-এর গাড়ি নথিভুক্ত হবে না। সে কারণে ডিলাররা মজুত গাড়ি বেচে দিতে বিশাল ছাড়ের ব্যবস্থা করবে। এমনটা ধরে নিয়ে সম্ভাব্য ভবিষ্যতে স্টেজ ফোর গাড়ির রি-সেল দামই প্রায় থাকবে না। কিন্তু এই স্টেজ সিক্স করতে যে প্রযুক্তি লাগবে তার জন্য গাড়ির দাম আবার বাড়বে ফলে দুষ্টচক্রের মতো চাহিদা বৃদ্ধির আগেই ঘাটতিতে পড়ে যাবে।
বড়ো বড়োশহরগুলিতে মেট্রো রেলের ব্যাপক প্রসারণ মানুষকে গাড়ি কেনা থেকে নিরস্ত করছে। শুধু তাই নয় যারা কেবল গাড়িতেই সফর করতে চান তারা আজকাল ওলা উবেরের সাহায্য নিচ্ছেন। নিজের গাড়ি ব্যাপক ভিড়ের মধ্যে দিয়ে টেনশন নিয়ে চালানোর পর পার্কিং করার স্থানাভাব একটা বাড়তি হ্যাপা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে গাড়ির বিমা কোম্পানিগুলি তাদের সালিয়ানা মাশুল বড়ো বৃদ্ধি ঘটিয়েছে যা প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। ব্যাঙ্কের বাইরেও যারা নগদে গাড়ির ঋণ দিত তাদের রাস্তা বন্ধ হওয়ায় গাড়ির চাহিদার টান পড়েছে।
রাজ্যগুলিতে স্বচ্ছতা আনতে অনুৎপাদক সম্পদ চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত। নিয়মকানুনের সংস্কার চলায় বাজারে নগদের জোগানে খামতি রয়েছে। কৃষিপণ্যের দামের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। অধিকাংশ প্রধান কৃষিপণ্যের দাম ভয়ংকর ভাবে কমে গেছে। কৃষি অর্থনীতিও কিছুটা মন্দার ধাক্কায় পড়েছে। দু চাকার গাড়ি, ট্রাক্টর প্রভৃতি বিক্রি কমে যাওয়া এর মূল কারণ। খুব তাড়াতাড়ি এই পরিস্থিতিতে শুধার আনা দরকার।
অর্থমন্ত্রীর কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে। যে উন্নত প্রযুক্তির চটজলদি প্রয়োগে আজকালকার তরুণ সম্প্রদায় ওলা উবের গাড়ি মিনিটের মধ্যে হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। গাড়ির বিক্রি কমার সেটি যে অন্যতম কারণ তা ঠিকই। এর থেকে বেরোবার যে চতুর্মুখী দাওয়াই আছে সরকার তার প্রয়োগে দ্রুত তৎপর হোক। ইস্পাতের দামের ক্ষেত্রে অন্যান্য সুবিধে তুলে নিয়ে দাম কমাক। আইন কানুন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার (নথিবদ্ধকরণ খরচা কমানো পার্কিং-এর জায়গা বাড়ানো) ঠিক করুন। তেলের দামের স্থিতিশীলতা ফেরানো ও অতি উচ্চ জিএসটি ও সেস হারে সংশোধনই গাড়ি শিল্পের হাল ফেরানোর ওষধি। আর এগুলি কেবলমাত্র সরকারই করতে পারে অন্য কেউ নয়।
জিএসটির হারে কিছুটা হ্রাস করার যে দাবি গাড়ি উৎপাদকরা করেছেন তার মধ্যে যে যুক্তি আছে তা আলোচনা হলো। কিন্তু সরকারের মাসিক জিএসটি আদায়ের পরিমাণ যতটা আন্দাজ করা গিয়েছিল তা সব মাসে পরিকল্পিত মাত্রা ছুঁতে না পারায় নগদ সংগ্রহ কম হচ্ছে। সরকার সদ্য কোম্পানি করের হার কমিয়েছে। এর প্রভাব কর আদায়ের মাত্রার ওপর কতটা পড়ে সেটাও আগামীদিনে বোঝা যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গাড়ি শিল্পে জিএসটি-হার ঝপ করে নামিয়ে দিতে সরকার প্রস্তুত নয়। তবুও পুনরাবৃত্তি করছিসরকারের তরফে উল্লেখিত নানাবিধ নিদান বেছে নেওয়ার মধ্যে জিএসটির হার কমানো সর্বাপেক্ষা জরুরি। বাস্তবে কমে যাওয়া জিএসটি হারের ফলে আদায়ের পরিমাণে স্বল্পমেয়াদি ঘাটতি দেখা দিলেও গাড়ি বিক্রির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অচিরেই জিএসটি আদায়ও বেড়ে যাবে। ফলে পুষিয়ে যাবে। এই কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতেও এসইউভি গাড়ির যে নতুন মডেল এমজি ও কিয়া মোটরস্ বাজারে এনেছে ক্রেতারা তাতে অত্যন্ত ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলির মধ্যে কেউ কেউ মন্দের ভালো করছে। রূপালি রেখা দেখাচ্ছে। তারা দামের ক্ষেত্রে অতি সচেতন ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে। আধুনিক গাড়ি ক্রেতা সবচেয়ে কমে সবচেয়ে ভালোটা চাইছে। গাড়ি প্রস্তুতকারকদের সর্বাধুনিক ক্রেতাদের চাহিদা মতো তাদের পণ্যেরও বিশ্বমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মডেলকে পরিমার্জন করতে হবে। গ্রাহক চাহিদার বিশ্লেষণও তাই বিক্রি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকাটা কিন্তু সরকারের আওতাধীন নয়।
রীতেশ কুমার সিংহ
(লেখক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং নিবন্ধ লেখক)
2019-10-18