অফ স্টাম্পের লাইনে বল করছেন অমিত শাহ, সৌরভ আপাতত ব্যাট তুলে ছেড়ে দিচ্ছেন, কিন্তু কত দিন?

কলকাতাকে বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ পাইয়ে দেওয়া কি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বিজেপির আরও একটি ‘পুরস্কার’? এটা কি বিজেপির তরফে সৌরভকে বার্তা যে, আপনি আর একটু এগোলে আরও বড় ‘পুরস্কার’ মিলতে পারে? না কি এটা অফ স্টাম্পের বাইরে একটা আউটসুইং দিয়ে দেখা যে, সৌরভ ব্যাট বাড়ান কি না। দেশ এবং রাজ্যের রাজনীতি আপাতত সেই প্রশ্ন এবং জল্পনায় মশগুল।

এটা সকলেরই জানা যে, গত বিধানসভা ভোটের আগে সৌরভের সঙ্গে কথাবার্তা বহু দূর এগিয়েছিল বিজেপির। অনেকে বলেন, বিধানসভা ভোটে সৌরভ ‘দিদি’র বিরোধী ‘মুখ’ হবেন, সেই বোঝাপড়াতেই সব অঙ্ক ওলটপালট করে ‘দাদা’কে বিসিসিআই সভাপতি করেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেই অঙ্কে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল অমিত শাহের।

কিন্তু বিজেপির পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে সৌরভ বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত আগে পিছিয়ে যান। তখন সৌরভ-বিজেপি সম্পর্কে খানিকটা শৈত্য এসেছিল। বিজেপি মনে করেছিল, সৌরভ তাদের ‘বিশ্বাস’ ভঙ্গ করেছেন। তিনি ‘দান’ নিয়েছেন। কিন্তু ‘প্রতিদান’ দেননি। তবে সৌরভের সঙ্গে বিজেপির তথা অমিতের সম্পর্ক কখনওই পুরোপুরি নষ্ট হয়নি। কারণ, ওই ঘটনার পরেও কলকাতায় এসে অমিত সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজে গিয়েছেন।

এর পরে সম্প্রতি বিজেপি শাসিত ত্রিপুরা সৌরভকে তাদের পর্যটনের ব্র্যান্ডদূত নিয়োগ করে। যা থেকে অনেকেই মনে করেছিলেন, বিজেপির তরফে সৌরভকে আবার বার্তা দেওয়া হল যে, দরজা খোলা আছে। পাশাপাশি ব্র্যান্ডদূতের পদ গ্রহণ করে সৌরভও বুঝিয়েছিলেন, তাঁর দরজাও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

মাসখানেক আগের সেই ঘটনার পর পরই এসে পড়েছে ভারতে বিশ্বকাপের সূচি প্রকাশ। যাতে দেখা গিয়েছে, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য হয়েও (বিশেষত, দিদির শাসিত রাজ্য হয়েও) বাংলা তথা কলকাতা বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ পেয়েছে। তার মধ্যে একটি আবার সেমিফাইনাল!

অনেকেই মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের পিছনেও বিজেপির তরফে সৌরভকে ‘বার্তা’ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অনেকের ধারণা, ইডেনের ম্যাচ পাওয়ার পিছনে সৌরভেরও ‘উদ্যোগ’ রয়েছে। যদিও এই ধারণার কোনও আনুষ্ঠানিক সত্যতা মেলেনি। সৌরভ নিজেও কিছু বলেননি। তবে বিজেপি তরফে পুরস্কার সূচক এই বার্তা বলছে, আরও এগোলে সৌরভের জন্য আরও বড় পুরস্কার রয়েছে। সৌরভ কতটা সাড়া দেবেন বা আদৌ দেবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ দিয়ে সিএবিকে ‘পুরস্কৃত’ করা যে সৌরভের সামনে আরও একটা ‘টোপ’, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষত, যখন সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় এখন সিএবির সভাপতি। তাঁর অধীনেই সিএবি বিশ্বকাপের সমস্ত ম্যাচের আয়োজন করবে।

প্রশ্ন হল— বিধানসভা ভোটের সময় সৌরভ বিজেপিকে গাছে তুলে মই কেড়ে নিলেও তাঁকে কেন এমন ‘পুরস্কার’ দিচ্ছেন অমিত শাহ?

এর আনুষ্ঠানিক কোনও জবাব এখনও পর্যন্ত নেই। কিন্তু জল্পনা আছে। প্রথমত, সামনে লোকসভা ভোট। তার আগে বাংলাকে তুষ্ট করার চেষ্টা। অমিত আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ততটা ভাবিত নয়। তিনি এই ভোটকেও লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্ব হিসেবেই দেখছেন। এ বার বিজেপির শাসনাধীন রাজ্যগুলিতে আসন বাড়ানোর সুযোগ বিশেষ নেই। অনেক রাজ্যেই সব আসনই বিজেপির দখলে। ফলে নতুন কিছু রাজ্যে বিজেপিকে ভাল ফল করতেই হবে। তার মধ্যে অন্যতম বাংলা। কিন্তু বাংলায় সংগঠনের যা হাল, তাতে ৩৫টি আসন পাওয়া (অমিত রাজ্যে এসে সেই লক্ষ্যই বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন) সহজ নয়। ‘মোদী-হাওয়া’ তৈরির পরেও বাড়তি কিছু অক্সিজেনের প্রয়োজন। সেই ‘অক্সিজেন’ হয়ে দেখা দিতে পারেন বাংলার ‘আইকন’ সৌরভ।

দ্বিতীয়ত, ছোট ছোট পুরস্কার (অনেকের মতে ‘টোপ’) দিয়ে বোঝানো যে, সৌরভের জন্য দরজা এখনও খোলা। বিজেপির একাংশের মতে, অমিত পাকা দাবাড়ুর মতো চাল দিচ্ছেন। তিনি দেখে নিতে চাইছেন, সৌরভ কী করেন। তিনি কি আগের অবস্থানেই থাকতে চান? না কি খানিক এগোতে চান? সেই বুঝে অমিত পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন।

জল্পনা হল, সৌরভ একটু এগোলে এর পরে আইসিসি চেয়ারম্যানের পদের মতো বড় পুরস্কার জুটতে পারে তাঁর ভাগ্যে। সেটিই হবে বিজেপির তরফে ‘চূড়ান্ত’ পুরস্কার। যে পদটি নিয়ে সৌরভের আগ্রহও কম নয়। কিন্তু সৌরভ নিজের অবস্থান পাকাপাকি ভাবে জানাচ্ছেন না। কারণ, সৌরভ মমতার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চান না। বাংলায় থেকে শাসকদলের সঙ্গে কে-ই বা সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়! কিন্তু একই সঙ্গে সৌরভের ক্রিকেট প্রশাসনে থাকার ইচ্ছাও প্রচুর। যা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থন এবং অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। সৌরভের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, সেই কারণেই তিনি অমিতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি চান না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে। দিল্লি গেলে দেখা-টেখাও যে হয় না, তা নয়। কিন্তু তার বেশি এখনও বিষয়টি এগোয়নি। যদিও দরজা খুলে রাখার বার্তা দু’তরফেই রয়েছে।

উল্লেখ্য, যে সূচিতে কলকাতা তথা ইডেন বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচ পেয়েছে, সেই সূচিতেই বাদ পড়েছে দেশের একাধিক অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য। বামশাসিত কেরল বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ পায়নি। বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ পায়নি পঞ্জাবও। যেখানে কিছু দিন আগে বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি। প্রসঙ্গত, পঞ্জাবের মোহালি এর আগে বিশ্বকাপের ভারত-পাক ম্যাচের সফল আয়োজন করেছে। যে ম্যাচে অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং তদানীন্তন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ। ফলে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরের আয়োজনের ক্ষমতা মোহালির যে রয়েছে, তা প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও তারা বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ পায়নি। তেমনই বর্তমান বোর্ড সভাপতি রজার বিন্নী বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কর্ণাটকের রাজধানী এই শহর ভারতের যে ম্যাচটি পেয়েছে, সেটি ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’। ঘটনাচক্রে, কর্ণাটকে সদ্য ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। টিএসআর শাসিত তেলঙ্গানার হায়দরাবাদকে তিনটি ম্যাচ দেওয়া হয়েছে। সেই ম্যাচগুলিও গুরুত্বের বিচারে ‘ব্লকবাস্টার’ নয়।

কিন্তু সেখানে বিজেপির ঘোর বিরোধী তৃণমূলের শাসনাধীন বাংলা বাজিমাত করে বেরিয়ে গিয়েছে! ক্রিকেট রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের বক্তব্য, বিজেপির তরফে ‘বার্তা’ দেওয়ার চেষ্টা না থাকলে ইডেনের পক্ষে এতগুলি ম্যাচ পাওয়া সম্ভব হত না। বিশেষত বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো ম্যাচ। প্রথমে ঠিক ছিল দু’টি সেমিফাইনাল হবে মুম্বই এবং চেন্নাইয়ে। সেখানে শেষ মুহূর্তে বাজিমাত করে কলকাতা। চেন্নাইয়ের এম চিদম্বরম স্টেডিয়ামের বদলে ম্যাচ চলে আসে কলকাতার ইডেনে।

ঘটনাচক্রে, চেন্নাইয়ে সেমিফাইনাল ম্যাচ আয়োজন করার দাবিদার ছিলেন বোর্ডের প্রাক্তন সভাপতি এন শ্রীনিবাসন। যিনি তামিলনাড়ুর ভূমিপুত্র তো বটেই, চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক হওয়ার সুবাদে ভারতীয় ক্রিকেটে এখনও যথেষ্ট ‘প্রতিপত্তি’ রাখেন। সেই শ্রীনিবাসন তথা চেন্নাই লবিকে সরিয়ে রেখে সেমিফাইনাল কলকাতায় দেওয়া হয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের ‘হস্তক্ষেপ’ ছাড়া সেটা অসম্ভব বলেই অনেকের অভিমত। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ হলে কোন রাজ্যের কোন শহর কত ম্যাচ পাবে, তা নির্ধারণে কেন্দ্রীয় সরকারের (বিজেপির) ভূমিকা অনস্বীকার্য। অমিতের পুত্র জয় শাহ এখনও বিসিসিআইয়ের সচিব।

সৌরভ অবশ্য পুরো বিষয়টিকে এখনও রাজনীতির বাইরেই রাখছেন। ত্রিপুরার ব্র্যান্ডদূত হওয়া নিয়ে জল্পনার সময়েই তিনি বলেছিলেন, তিনি কিছু করলেই তাঁর সঙ্গে রাজনীতি টেনে আনা হয়। খানিকটা বিরক্তিও প্রকাশ করেছিলেন সৌরভ। তবে ঘটনা হল, রাজনীতিতে সৌরভের আগ্রহ অপরিসীম। তিনি এমন কখনও বলেননি যে, রাজনীতিতে কখনওই আসবেন না। যত বারই সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি অফ স্টাম্পের বাইরের বল দেখে ব্যাট তুলে নিয়ে সেটি ছেড়ে দিয়েছেন। কখনও সরাসরি জবাব দেননি। তবে ঘনিষ্ঠেরা জানেন, সৌরভের রাজনীতিতে মোটেই অনাগ্রহ নেই।

বস্তুত, সৌরভ এখনও সাবধানেই খেলছেন। অনেকের মতে, তা ছাড়া উপায়ও নেই। অমিতকে তাঁকে শোয়েব আখতারকে দেখে খেলার মতো খেলতে হচ্ছে। যিনি অফ স্টাম্প অথবা অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে, যাকে পরিভাষায় বলে ‘করিডর অফ আনসার্টেনটি’-তে পর পর ডেলিভারি করছেন। এখনও পর্যন্ত সৌরভ ব্যাট তুলে নিচ্ছেন এবং বল স্টাম্প এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও ডেলিভারি আচমকা ভিতরে ঢুকে এসে প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের স্টাম্প নড়িয়েও দিতে পারে।

প্রশ্ন হল— সৌরভ কোন বলটা ছাড়বেন? কোন বলটাই বা খেলবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.