এক গণিতবিদের স্মরণে চারটি ডাকটিকিট ভারতে। কে সেই গণিতবিদ? শ্রীনিবাস রামানুজনকে জন্মবার্ষিকীতে

হয়ে উঠলেন রয়েল সোসাইটির কনিষ্ঠতম ফেলো, ভারতের দ্বিতীয় ফেলো; আর্যভট্টের দেশে যোগ্য উত্তরাধিকারী এক বিস্ময়কর বালক। তামিলনাড়ুর ইরোডে এক গরীব ব্রাহ্মণের ছেলে; বাবা কাপড়ের দোকানের হিসেবরক্ষক। কাগজের দাম বাজারে একেবারেই চড়া, এত কাগজ রোজ রোজ যোগান দেওয়া পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। অথচ অঙ্কই যে ছেলেটির ধ্যানজ্ঞান! শ্লেটে, মেঝেতে খড়িমাটি দিয়ে দিনরাত অঙ্ক কষেন; আর কষেই যান। খড়িমাটির কলমে ফুটে ওঠে অপরূপ তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্য। তাই তুরীয়ানন্দে চয়ন করে করে সূত্রাকারে তুলে রাখেন প্রাণাধিক প্রিয় নিজের নোটখাতায়। খাতায় ক্ষুদ্র পরিসর, প্রতিপাদন লেখার স্থানাভাব; তাই লিখে রাখেন কেবলমাত্র গবেষণার ফলাফলটুকু এবং গাণিতিক তত্ত্বটুকু। এই সংক্ষিপ্ততায় কেউ কেউ হয়তো ভাবলেন, তিনি গণিতের তত্ত্বের প্রমাণ দিতে অপারগ। কেমব্রিজের বৌদ্ধিক সমাজের আমন্ত্রণে এবং ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ নিয়ে তিনি বিলেত গেলেন। নোটখাতার নিবিড় পাঠ করে বিলেতে তাঁরই মেন্টর বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ গডফ্রে হার্ডি বললেন, অসাধারণ! এই বাচ্চা ছেলেটি এক অত্যুচ্চ মানের গণিতবিদ। তাঁর সঙ্গে যৌথ গবেষণাও করলেন তিনি। ছিন্ন খাতার গাণিতিক উপস্থাপনা পরে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা শত বছর ধরে সমাধান করে এসেছেন, এখনও কিছু বাকি। এই মানুষটিই জীবনের অঙ্কের হিসেব মেলাতে না পেরে মাত্র ৩২ বছর বয়সে যক্ষা রোগ নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করলেন। এমনই কালান্তক যক্ষা যে কেম্ব্রিজের মতো হাসপাতালেও ভালো হতে পারেন নি তিনি, কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে তাঁর ফুসফুস। ফিরে এলেন ভারতে, নিজের দেশেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন।

২২ শে ডিসেম্বর জাতীয় গণিত দিবস, তাঁর জন্মদিন। দিনটি পালিত হয় এই তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন (২২ শে ডিসেম্বর, ১৮৮৭ — ২৬ শে এপ্রিল, ১৯২০)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, যিনি মাত্র ৩২ বছরে অকাল প্রয়াত হন। তাঁর সম্পত্তি বলতে ছিল কয়েক দিস্তা কাগজ আর তিনটি নোটবই, তারই একটি ‘Lost notebook’ নামেই গণিতের জগতে চির প্রচলিত। এখানে তাঁর কষা অঙ্ক, গাণিতিক বিশ্লেষণ, সংখ্যাতত্ত্ব, অসীমধারা, আবৃত্ত ভগ্নাংশে ভরা ছিন্নপাতাগুলিকে এক অসাধারণ গণিতবিদের সংজ্ঞা, স্বরূপ বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরেছে। কয়েকটি গবেষণালব্ধ পেপার প্রকাশিত হয়েছে গণিতের জার্নালেও।

নিবিড় গণিত চর্চার মাঝেও তাঁর ধর্ম জীবন ছিল বিশুদ্ধ এবং স্বকীয়। তিনি বিলেতেও স্বপাক নিরামিষভোজী ছিলেন। তাঁর মা ইরোডে স্থানীয় মন্দিরে গান গাইতেন। তাঁর মাতামহ নামাক্কল শহরের বিখ্যাত নামগিরি দেবীর দোর ধরে এই দৌহিত্রকে চেয়ে এনেছিলেন। দেবীর প্রভাব যেন রামানুজনের জীবনে সবসময়ই ছিল। তিনি বলতেন, নামগিরি দেবীই শয়নে স্বপনে তাঁকে প্রেরণা দিয়ে সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছেন। সত্যিই তো! ছোটোবেলা থেকে গণিত নিয়ে প্রচলিত শিক্ষা পাওয়া নেই, মেন্টর নেই, বইপত্রের রাশি নেই, সারস্বত সমাজের সান্নিধ্য নেই; অঙ্ক কষার কাগজটুকু নেই! তবুও কীভাবে বন্ধুর দেওয়া একটি গণিতের বইকে সম্বল করে এতটা এগোলেন তিনি? গণিত ভালোবাসেন, তাই অন্য বিষয়ে চর্চা না করে ফেল করলেন কলেজে, স্কলারশিপের টাকাও হাতছাড়া হয়ে গেলো। পড়া শেষ হলো না। তবুও অঙ্ক ছাড়েন নি তিনি। সে কোন প্রেরণা?

ভারতীয় ডাকবিভাগ তাঁর স্মরণে তিনিটি Commemorative Stamp বা স্মারক ডাকটিকিট এবং একটি Definitive Stamp বা নিয়মিত ডাক ব্যবহারের স্ট্যাম্প প্রকাশ করে। ১৯৬২ সালের ২২ শে ডিসেম্বর তাঁর জন্মের ৭৫ বর্ষকে মনে রেখে ১৫ নয়াপয়সার একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়, টিকিটের রঙ Raw Sienna.


এরপর ২০১১ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর ৫ টাকা মূল্যের স্মারক টিকিট; ২০১২ সালে ৫ টাকা মূল্যের আরও একটি ডাকটিকিট National Mathematics Day উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালের ১০ ই মার্চ ৪ টাকা মূল্যের গাঢ় জলপাই রঙের একটি ডেফিনিটিভ টিকিট প্রকাশ করে ভারত সরকার।

শ্রদ্ধা জানালেন অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.