বিপিনচন্দ্র পালের বহুমুখী প্রতিভার সাক্ষী ছিল সমকালীন রাজনীতি ও সমাজনীতির ইতিহাস। তিনি কেবলমাত্র রাষ্ট্রনীতিবিদ, দেশনায়ক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক ছিলেন না। তিনি একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদও ছিলেন, যার পরিচয় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বিপিনচন্দ্র পালের শিক্ষানীতি বুঝতে হলে তাঁর ব্যবহৃত ‘Spiritual Movement’ কথাটির অর্থ নিরূপণ করতে হবে, যে পন্থায় কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন লক্ষ্য নয়, কেবলমাত্র রাজনৈতিক পালাবদল লক্ষ্য নয়, ক্ষমতার রাজনৈতিক হস্তান্তর নয়; যথার্থ স্বাধীনতা পেতে প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মোপলব্ধি এবং অকুণ্ঠ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে৷ এই আত্মোপলব্ধি ও ত্যাগ আসে যথাযথ শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা থেকে৷ এই শিক্ষা আসবে জাতীয় শিক্ষার রূপায়ণে।
বিপিনচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখছেন, “ন্যাশানাল বা জাতীয় কথাটা আমাদের রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ-এর নিকট হইতে পাই নাই, আনন্দমোহন-এর নিকট হইতে পাই নাই, কেশবচন্দ্রের নিকট হইতেও পাই নাই। এ বিষয়ে আমাদের গুরু ছিলেন নবগোপাল মিত্র মহাশয় আর নবগোপাল মিত্র মহাশয়ের দীক্ষাগুরু ছিলেন পুণ্যশ্লোক রাজনারায়ণ বসু মহাশয়।” আমরা দেখতে পাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলছেন, ন্যাশানাল কথাটা সর্বপ্রথম প্রচলন করেন নবগোপাল মিত্র। সে সময় সবাই তাঁকে নাম দিয়েছিলেন ‘ন্যাশানাল মিত্র’। তিনি হিন্দু মেলা (১৮৬৭)-র গুরুত্বপূর্ণ আবেদক ছিলেন। বিপিনচন্দ্র পালকে আমরা দেখতে পাই এই নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত (১৮৬৮) ‘ন্যাশানাল জিমনাসিয়াম’-এর ছাত্র হিসাবে। যেখানে শারীরশিক্ষার সঙ্গে দেওয়া হত দেশভক্তি ও জাতীয়তাবাদের পাঠ। ছেলেরা যেমন দেশীয় লাঠিখেলা, কুস্তি, তলোয়ার যুদ্ধ শিখতেন, তেমনই ইউরোপীয় কসরতও সেখানে শিখতেন সমান তালে। ‘হিন্দুমেলা’-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিপিনচন্দ্রের শিক্ষা-ভাবনা আমাদের এক সুস্নাত বোধের জগতে নিয়ে যায়।
বিপিনচন্দ্রের মতে ভারতবর্ষের নবযুগের প্রবর্তক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন যে বীজ বপন করেছেন তা থেকেই ভারতবর্ষের নবজীবনের উৎপত্তি। সেই বীজই অঙ্কুরিত, পল্লবিত, পুষ্পিত ও ফলিত হয়ে আধুনিক ভারতবর্ষকে ছেয়ে দিয়েছে৷ যারা এই বীজে জলসিঞ্চন করেছিলেন, যাদের সেবা ও ত্যাগে সেই বীজ সতেজ বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল, তাদের প্রায় সকলকেই তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে তাঁর স্বল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠতাও ছিল। এখন নবজীবন যখন, তখন তার মধ্যে শিক্ষা দর্শনও বাদ থাকে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৮২৩ সালের ১১ ই ডিসেম্বর রামমোহন তদানিন্তন বড়লাটকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “আমাদের প্রয়োজন হল আবশ্যকীয় বিজ্ঞান (Useful Sciences), যেমন গণিত, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরবিদ্যা।”
১৯০৬ সালের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা পরিষদে বিপিনচন্দ্র ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ও প্রচারক। এই সংগঠন গড়ে ওঠার পূর্বে ১৯০৫ সালের ১৬ ই নভেম্বর শিক্ষা বিষয়ক যে প্রাসঙ্গিক সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এই সংগঠনের হয়ে তিনি শিক্ষা বিষয়ক বহু বক্তৃতা দেন এবং নিজের রচনায় শিক্ষা চিন্তার পরিচয় দিতে থাকেন। যদিও সংগঠন-নির্দিষ্ট শিক্ষা-ব্যবস্থাই প্রচার করতেন, কিন্তু সেই দর্শনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপন চিন্তাধারাকে বিশিষ্ট রূপ দিতেন। বিপিনচন্দ্রের কণ্ঠ জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করলো। তিনি বললেন, জাতীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে এবং জাতীয় ধারায় পরিচালিত শিক্ষাই হচ্ছে ‘জাতীয় শিক্ষা’। তার সঙ্গে সংযোজন করলেন, এ শিক্ষা আপন মাতৃভাষাতেই সম্ভব। বললেন, জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জাতীয় ভাগ্যের বাস্তব রূপায়ণ। পরবর্তীকালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি জাতীয় শিক্ষানীতিকে অনেকাংশে গ্রহণ করেছে৷
কর্মজীবনের শুরুতে কয়েকটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেও তাঁর শিক্ষক জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি৷ পরে তাঁকে সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও রাষ্ট্রনীতি চর্চা করতে হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি দেশের শিক্ষা সমস্যা নিয়ে উদাসীন ছিলেন না। তিনি শিক্ষার সংজ্ঞা নিরূপণ না করেও, শিক্ষা তত্ত্ব রচনা না করেও, তাঁর রচনায় এবং বক্তৃতায় মৌলিক শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক নানান কথা বলেছেন। শিক্ষা ছাড়াও ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক হিসাবে তিনি নানান জায়গায় লোকশিক্ষা দিয়েছেন, রাজনৈতিক মঞ্চেও শিক্ষণীয় কথাই বলেছেন; তাই তিনি একজন আদ্যন্ত শিক্ষাবিদ।
তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল নৈতিক শিক্ষার উপর। মনে করতেন, সেটাই সমস্ত শিক্ষার ভিত্তি। নীতি শিক্ষার জন্য আমাদের পঞ্চ মাধ্যম (দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, কর্মপ্রয়াস, আবেগ) -এর যথাযথ অনুশীলন ও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বলে মনে করতেন। মনে করতেন ব্রিটিশ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চরিত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ এরসঙ্গে জাতীয় জীবনের যোগাযোগ অল্প। তিনি ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখলেন শিক্ষা বিষয়ে এবং তৎকালীন শিক্ষা-নীতির সমালোচনাও করলেন৷ এইভাবে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসাবে শিক্ষাজগতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেন। তিনি বলতেন, শিক্ষায় বস্তুজ্ঞান জন্মাতে হবে, কেবল শব্দজ্ঞান নয়। ইংরেজরা তাদের শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করে রেখেছে, কাজেই সেই শিক্ষা ভারতবর্ষের এবং ভারতবাসীর উপযোগী হতে পারে না।
এবার আলোচনা করবো, বিপিনচন্দ্রের জবানবন্দিতে বলা কিছু কথা, যার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় প্রতিভাত হয়েছে৷ প্রথমে বলা যাক কর্মফল নিয়ে তাঁর অনুভবের কথা। তিনি বলছেন, বিশ্বের মুক্তি ভিন্ন ব্যক্তি মানুষের মুক্তি নেই। নিঃসঙ্গ একাকিত্বের কল্পনাও এই সৃষ্টিতে সম্ভব নয়। যতদিন না সমাজের সামগ্রিক প্রায়শ্চিত্তের শেষ হয়, ততদিন কারও মুক্তি নেই। মনুষ্য সমাজ এক সঙ্গবদ্ধতার ইতিহাস। এখানে মানুষ একা জন্মগ্রহণ করে না, একা নিজের সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল ভোগও করে না; মানুষ বিশাল বিশ্বের অনাদিকৃত কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে সংসারে জন্মায়। ইহজীবনে নিজের কর্ম দিয়ে বিশ্বের কর্মের বোঝাকে লাঘব করে অথবা বর্ধিত করে। সূতিকাগারের দরজায় দাঁড়িয়ে সেই ত্রিধারা-সঙ্গমের অনুভূতি পাওয়া সম্ভব, যেখানে সদ্যজাত শিশু তার পিতামাতার জীবন-ধারার মিলনে উৎপন্ন হয়ে প্রবাহের পথ পায়। জীবনস্রোতে বয়ে চলতে চলতেই অনুভূত হয়, বিশ্বের অনন্ত জীবন-স্রোতের ক্ষণিক তরঙ্গ। তিনি বলছেন (আত্মজীবনী ‘সত্তর বছর’), “মানুষের কর্মের দায় এক পুরুষ বা দুই পুরুষের নহে।… আমার জন্মে পিতামাতা তাঁহাদের কর্মবোঝা কেবল আমার মাথায় চাপাইয়া দেন নাই; তাঁহারাও পূর্ব-পুরুষদিগের কর্মের বোঝা মাথায় লইয়া এই পৃথিবীতে আসিয়াছিলেন।” মানুষ বিশ্বের কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। একা জন্মগ্রহণ করে না, একা নিজের সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফলভোগ করে না, একা নিজের কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে ইহলোকও ত্যাগ করে না। যাদের পেছনে রেখে যায়, তাদের মাথাতেই সেই বোঝা চাপিয়ে যায়।
তাঁর সমাজ ও ইতিহাস ভাবনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে। সমাজকে চিনতে হলে, সমাজের ইতিহাসকে জানতে হলে সেই সমাজের অন্তর্গত স্বতন্ত্র মানুষগুলিকে চিনতে হয়৷ তিনি বলছেন, প্রত্যেক মানুষের জীবনে সমগ্র মানব সমাজের ইতিহাস প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে সমসাময়িক সমাজ জীবনের ধারা মিলেমিশে থাকে। তাই সব মানুষের ভেতরে সমসাময়িক সমাজের জ্ঞান, ভাব ও কর্মচেষ্টা ফুটে ওঠার সুযোগ থাকে। এটি বলতে গিয়ে তিনি বস্ত্রবয়নের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। বললেন, টানা ও পোড়েন মিলে কাপড় বোনা হয়। তেমন প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন ও সামাজিক জীবন মিলে বিশ্বমানবের আত্মপ্রকাশের তাঁত উৎপাদিত হয়। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির বিভিন্ন কালপর্বের ইতিহাস রচিত হয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের গোড়ার কথা শোনাতে গিয়ে তিনি বলছেন, ব্যষ্টিরূপে ব্যক্তিকে ও সমষ্টিরূপে সমাজকে দেখতে হয়। ব্যষ্টিকে ছেড়ে সমষ্টির বাস্তবতা থাকে না। আবার সমষ্টিকে ছেড়প ব্যষ্টির সার্থকতা বোঝা যায় না৷ এদিক থেকে দেখতে গেলে আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের চিন্তাচেতনা-সম্ভূত যে ‘একাত্ম মানবতাবাদ’-এর ধারা গ্রহণ করেছে, তারও পূর্বসূত্র আমরা বিপিনচন্দ্র পালের দর্শনের মধ্যে দেখতে পাই।
আমরা দেখি তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট শিক্ষা-দর্শন লুকিয়ে আছে। সেখানে নানান প্রাসঙ্গিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জড়জগতের সঙ্গে মানবজীবনের পারস্পরিক মিথোষ্ক্রিয়তার কথা উপলব্ধি করাচ্ছেন। “এই সৃষ্টিতে জড় ও চেতন যাহা কিছু ছিল ও যাহা কিছু আছে, সকলের সঙ্গেই সদ্যজাত মানব শিশুর জীবন জড়াইয়া রহিয়াছে। আলো ও অন্ধকার, রৌদ্র এবং বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, দাবানল ও ভূকম্পন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পর্বত ও সমুদ্রের সৃষ্টি, সাগরের তরঙ্গ ও নদীর স্রোত, বিশাল বনস্পতির সমাচ্ছন্ন নিবির্ অরণ্যানী, প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় জীবজন্তুসকল, কীট, পতঙ্গ, পুষ্পলতা সকলে মিলিয়া সৃষ্টির আদি হইতে এই ক্ষুদ্র মানব শিশুর জীবনকে গড়িয়া পিটিয়া তুলিয়াছে।” অতএব আমরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আধুনিক বিজ্ঞান-ভাবনা তাঁর মধ্যে বিশেষভাবে ছড়িয়ে ছিল তা বুঝতে সক্ষম হই, যখন দেখি তিনি লিখছেন, “এই বিশ্বের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে সমগ্র সৃষ্টির ইতিহাসটি লুকাইয়া আছে। জড়-বিজ্ঞান সেই গোপন লিপিরই উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতেছে। বিশ্বের প্রত্যেক জীবকোষাণুর মধ্যে সৃষ্টির সমগ্র প্রাণীজগতের ইতিহাস অঙ্কিত রহিয়াছে। জীব-বিজ্ঞান তাহারই আলোচনা করিয়া জীবের প্রকৃতি ও অভিব্যক্তির তথ্য বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছে।”
তথ্যসূত্র
১. সত্তর বৎসর ।। আত্মজীবনী।। বিপিনচন্দ্র পাল (পুস্তকাকারে প্রকাশ ১৯৬২), যুগযাত্রী প্রকাশক লিমিটেড, কলকাতা।
২. বিপিনচন্দ্র পাল : জীবন, সাহিত্য ও সাধনা, ড. শিবদাস চক্রবর্তী, ১৯৬০, চলন্তিকা প্রকাশক, কলকাতা।
৩. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা, প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মণ্ডল।
৪. ভারতের জাতীয় আন্দোলন, অনাদিকুমার মহাপাত্র।
কল্যাণ চক্রবর্তী ও অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।