গণিতের কিংবদন্তি শিক্ষক অলোক নিয়োগী চলে গেলেন।

[Aloke Kumar Neogi, সংক্ষেপে A.K.N., তিনি নিজেই নিজেকে ব্যক্ত করলেন Amon Kichhu Na (এমন কিছু না, AKN), নিজের বহুল পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতাকে Dilute করে দিয়েছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন সাধারণ্যে মেশার, প্রতিভাকে ঢাকার। তবুও তাঁর গণিত চর্চার কিংবদন্তি লোকমুখে ছড়িয়ে গেল। ছাত্র থেকে ছাত্রের অঙ্গুলিতে গণিতের সৌন্দর্য গেল ছড়িয়ে।]

জীবনে একটা সময় থাকে, যখন কোনো কোনো মানুষকে পেয়ে তাদের গুণমুগ্ধদের মনে হয় – তিনি অপরিবর্তনীয়, অবিসংবাদিত, তিনি অমর। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রী অলোক নিয়োগী তেমনই উচ্চ মাপের একজন শিক্ষক। অসম্ভব মেধাবী, সৌম্যকান্তি পুরুষ, ঋজুদেহী, সদাহাস্যজ্বল, ঝকঝকে এক শিক্ষক। যারা তাঁকে শিক্ষক হিসাবে পান নি, তারা অনুভব করতে পারবেন না — গণিতের ঘোড়াকে একজন দ্রুতগামী, দক্ষ সওয়ারী দৈনন্দিনতায় কীভাবে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে আনন্দের আবহে সাবজেক্ট-সমেত ছুটিয়ে বেড়াতে পারেন! সেই সঙ্গে ছাত্রদেরও ডাক দিতে পারেন, “তোমরাও অঙ্কের সাদা তেজী ঘোড়ার সওয়ারী কিনা? অঙ্কের আলোর পথে নামো। জীবনটা নির্ভুল হোক অঙ্কের মতো।” হ্যাঁ, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে রহড়া মিশন থেকে যে অসংখ্য খ্যাতানামা ছাত্র বেরিয়েছেন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার প্রেরণা তিনি, সারস্বত সাধনার অঙ্কে গুরুর আসনে বসে রয়েছেন — শ্রী অলোক কুমার নিয়োগী। তাঁর জীবনচর্যা ও মানস চর্চা যেন অমলিন অঙ্কের নির্ভুল হিসাব। আমরাই মেলাতে পারলাম না তাঁর শেষ অঙ্ক! কেমন ভাবে মিলিয়ে গেলেন তিনি মহাশূন্যের অঙ্কের হিসাবে।

ছাত্রাবস্থায় তাঁকে দেখলে মনে হত, তিনি অমর, অপরিবর্তনীয়। একই রকম থাকবেন চিরকাল, একইভাবে প্রতিভাত হবেন সারাজীবন — চির তরুণের অঙ্গরাগে, চির সমাধানের রাস্তায়। তাঁকে স্কুলে যাবার পথে নিজের হাতঘড়িটি মিলিয়ে নেওয়া যেত — রহড়া পশ্চিমপাড়ায় সকাল ১০ টা ১৫, ভবনাথ স্কুলের কাছে ১০ টা ২০, স্কুল বাড়িতে ১০ টা ২৩ মিনিট। প্রাক্তন ছাত্র সামনে এসে দাঁড়ালেই অসম্ভব স্মৃতিশক্তিতে তিনি বলে দিতে পারেন, কোন ব্যাচ, নাইন-টেনে কোন সেকশন, এমনকি পুরো নামটিও। স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা আজীবন ছিল। তাঁর শেষ সময়ের সঙ্গী ও প্রিয় ছাত্র অ্যাপেলো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ভাস্কর উকিল জানাচ্ছেন, এক মাসাধিক কালে যতক্ষণ তিনি কথা বলতে পেরেছেন — সাল তারিখ সহ তিনি স্কুলের নানান ঘটনার মূল্যবান স্মৃতিচারণা করেছেন, যা ৮৪-৮৫ বছরের কোনো শিক্ষক রোগজর্জর শেষ জীবনে করতে পারেন না। ডা. উকিলকে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন, স্কুলের ধারাবাহিকতা ও গতিপ্রকৃতির কথা এবং আগামী দিনে কোন পথে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং আগামী প্রজন্ম।

শ্রী অলোক নিয়োগীর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে রহড়া সমেত রাজ্যের শিক্ষাঙ্গণে সময়ানুবর্তিতা, দায়িত্বশীলতা ও কৃতবিদ্যার এক অভূতপূর্ব শিক্ষাযোগের পরিসমাপ্তি ঘটল। ২৫ শে অক্টোবর সকাল ৯ টা ১০ মিনিটে এই গণিতসাধক কলকাতার মানিকতলার কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন তাঁর সহধর্মিণী এবং বিবাহিত এক পুত্র ও কন্যার পরিবার, সেই সঙ্গে গুণমুগ্ধ অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের। তিনি তাঁর দেহ ও চক্ষু দান করে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর সেই দেহের কার্যকরী অঙ্গ যথাস্থানে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ব্যবস্থা চলেছে বলে, ডা. উকিলের কাছে জানতে পেরেছি।

স্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলাম আমি – স্কুলে অঙ্ক করেছি, কোচিং ক্লাসে অঙ্ক-ভৌতবিজ্ঞান ও রসায়নের পাঠ নিয়েছি। স্কুলে আমার ছিল অ্যাডিশনাল ম্যাথামেটিক্স, সেটিও পড়াতেন তিনি অপরূপ সৌকর্যে। যখন এগারো-বারো ক্লাসে পড়ি সোম-বুধ-শুক্র, সপ্তাহের তিনটি দিন বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটায় তাঁর বাড়িতে পড়তে যেতাম, একদিনও কামাই ছিল না। স্কুলেও তিনি কামাই করতেন না, অধিকাংশ প্রাপ্ত ছুটিই তাই ‘জলে যেত’। কোচিং ক্লাসে রোজ যাবার জন্য তিনি একটি পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। সেটি গুটিকয় ছাত্রকে দিতে পেরে সবচেয়ে আনন্দ পেতেন। বলতেন, রোজ এলে পড়াশোনা তো হবেই, কিন্তু রোজ আসা দরকার, দৈনিক পড়াশোনা করা দরকার। ছাত্রজীবনে পড়াশোনার বিকল্প কিছু নেই। তিনি গুরুকূল প্রথাকে সমর্থন করতেন নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রেক্ষিতেই। আজ তার বড্ড অভাব, বড্ড ছড়িয়ে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়া। একমনা হওয়ার মধ্যেই যে সাফল্য — এই কথাটি তিনি মনে করিয়ে দিতেন নানান অনুষঙ্গে। তাঁর এক নিকটাত্মীয়া খড়দহে রেল লাইন পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনায় অকালে মারা যান। এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি, সন্তানসম সকল ছাত্রদের সবসময় রাস্তায় চলাফেরার সময় সজাগ হয়ে চলার পরামর্শ দিতেন।

তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন, বই উপহার দিতেও ভালোবাসতেন। বলতেন, বই মানুষের সেরা বন্ধু। কাউকে উপহার দেবার আগে অল্প সময়ের মধ্যে যত্ন করে নিজেই বইটি পড়ে নিতেন। এইভাবে বহু বই তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছিল। কেউ তাঁর সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করেছেন কিনা জানিনা। আমি যখন রহড়া খড়দায় ‘সোনাইবার্তা’ (নয়ের দশকের গোড়ায়) এবং ‘সংবাদ এখন’ ও ‘রোজনামচা’ (এই শতকের গোড়ায়) সম্পাদনা করেছি, তখন তাঁর বাড়িতে গিয়ে কিছুটা সময় সাহিত্য আলোচনার সুযোগ ঘটেছিল। তখন বুঝেছি, সমসাময়িক ও রবীন্দ্রিক সাহিত্য নিয়ে তিনি কতটা খোঁজখবর রাখতেন। সিনেমা দেখতেও ভালোবাসতেন। একবার তিনি আমাদের ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ সিনেমাটি দেখিয়েছিলেন।

তিনি রসায়ন নিয়ে উচ্চতর অধ্যয়ন করলেও, গণিত ছিল তাঁর প্রিয় সাবজেক্ট। একসময় রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ে তিনি রসায়নের অতিথি অধ্যাপক হিসাবে পড়িয়েছেন। হয়তো সেখানেই অধ্যাপক হিসাবে স্থায়ী চাকরি নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তখন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান গণিত শিক্ষক। কলেজে নিজের বিষয়ই পড়াতে হয়, স্কুলের ভালোবাসার সাবজেক্ট পড়ানো যায়। তাই তিনি স্কুলেই থেকে গেলেন। অঙ্ক থেকে ছুটি নেবেন না, এই পণ তিনি করেছিলেন, পণরক্ষাও করেছিলেন। শেষ হল তাঁর গণিত চর্চা, গণিত চর্যা, জীবনের গণিতও।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.