সময়োপযোগী চিন্তায় “মাস্টারদা” সূর্য সেনের প্রভাব।

“বাবা, কি দেখছো?” ছেলে জিজ্ঞেস করলো। ছাত্র পড়িয়ে এখনকার কোভিড সময়ের CBSE ও ICSE-র টার্ম-১এর ফাঁকা টাইমে ইউটিউবে দেশাত্মবোধক এটা সেটা সার্চ করতে করতে সূর্য সেন নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, আমার রিসার্চের সেম-টাইমফ্রেমের মধ্যেই পড়ছিল।
উত্তরে আমি বললাম যে, “আজকের দিনে আমরা যে স্বাধীন দেশটি অর্জন করতে পেরেছি, যাদের জন্য পেরেছি, তাদেরই মধ্যে একজনের স্বমন্ধে প্রতিবেদন। এই যেমন গতকাল বিনয়, বাদল, দিনেশ এর জন্য মনে রাখা উচিত…”। বলে দুইজনে হুজুগে দু-দুটি সহজপ্রাপ্য সিনেমাও দেখে ফেললাম সকাল থেকে। ছেলেরও এখন ছুটি, সদ্য অ্যানুয়াল শেষ হওয়ায়। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ও প্রতিবেদন দেখার পরে যে মুভি দুটি দেখলাম তা হল; ১: Chittagong (2012)
২: Khele Hum Jee Jaan Se (2010)

আপনারা আশা করি বুঝতেই পারছেন যে কোন বিপ্লবীর কথা আমরা বলাবলি করছিলাম। হ্যা, সূর্য সেন, ‘মাস্টার দা’ সূর্য সেন। তা ছেলের ইতিহাস বইতে সেও পড়েছে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’.. ব্যাস, ওর-ও বেশ ইচ্ছা চেপে বসল। ইতিহাসকে আরো জানার, আরো শেখার! স্বভাবতই প্রশ্ন এলো, “কে এই মাস্টার দা?” তার উত্তরে নিচের প্রতিবেদনটি লেখা রইল!

বাংলা তথা ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক হলেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মুখ্য নায়ক ‘মাস্টার দা’ সূর্য সেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যে সূর্য সেন তার ছাত্র ও সহযোগীদের নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ গড়ে তোলেন। ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল মধ্যরাত্রি অম্বিকা চক্রবর্তী, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ প্রমুখ ৬৫ জন সঙ্গীকে নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ ও লুন্ঠন করেন। তাঁরা টেলিফোন, টেলিগ্রাফের তার বিচ্ছিন্ন করে চট্টগ্রামে ‘স্বাধীন বিপ্লবী সরকার’ গঠন করেন। এরপর ইংরেজ সৈন্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করলে বিপ্লবীরা নিকটবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন এবং যুদ্ধ শুরু করেন। সশস্ত্র যুদ্ধে কয়েকজন বিপ্লবী নিহত হন ও অন্যান্যরা পলায়ন করে কিছুদিন ধরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যান। মাস্টারদার অন্যতম শিষ্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করেন এবং পুলিশের হাতে ধরা পরার আগে আত্মহত্যা করেন। অবশেষে ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সূর্যসেন ধরা পড়েন, বিচারে তাঁর ফাঁসি (১৯৩৪ খ্রীঃ ১৩ ফেব্রুয়ারী) হয়। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের এই যুব বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করে। চট্টগ্রামের ঘটনার গুরুত্ব বিচার করতে গিয়ে স্যার স্যামুয়ের হোয় একে ‘বিপ্লবীদের ইতিহাসে অভূতপূর্ব’ বলে অভিহিত করেছেন।
এই হল সারমর্ম, কিন্তু আমার ইতিহাস আর ক্লাস সিক্সে পড়ার ইতিহাস কিছু হলেও ভিন্ন তো হবে, তাই না? আসুন আরো গভীরে যাওয়া যাক।

একপাশে কালী অপরদিকে বিবেকানন্দের ছবি রেখে যুদ্ধের বার্তা দিতেন মাস্টারদা:

‘মৃত্যু কিংবা স্বাধীনতা’, এই মন্ত্রে বিশ্বাস করতেন মাস্টারদা, তিনি সবার মাস্টারদা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বড় মুখ। সেই মাস্টারদা তাঁর সহ যোদ্ধাদের প্রত্যেকের ঘরে স্বামীজির ছবি রাখার কথা বলেছিলেন। বিবেকানন্দের আদর্শে যেমন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন নেতাজী, তেমনই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনও। সেই তথ্য মেলে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে।

শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-এর ষষ্ঠ খণ্ডে ‘বিবেকানন্দ ও বিপ্লব আন্দোলন’ অধ্যায়ে বিপ্লবী অনন্ত সিংহের লেখা ‘সূর্য সেনের স্বপ্ন ও সাধনা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, সূর্য সেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে কতখানি প্রভাবিত ছিলেন সে সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিয়েছেন তাঁর আর এক সহকর্মী অনন্ত সিংহ। “মাস্টারদা… বিনয়ের সঙ্গে অথচ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে চারজন বিপ্লবী বন্ধুকে বললেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের বুকে বসে মাত্র এই পাঁচজনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের পরিকল্পনা করছি। আমার মনে হয় বর্তমানে মূলত আনন্দমঠের আদর্শে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের চলা উচিত এবং মা-কালী পূজা, স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগের বাণী ও গীতাপাঠ কর্তব্য হওয়া প্রয়োজনʼ, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবাই আলোচনার পরে মাস্টারদার এই সমস্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নিলেন। প্রত্যেকের নিজের ঘরে মা-কালীর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, ও একখানা গীতা রাখাটা নিয়মে পরিণত হল। আমাদের পরে যারা দলভুক্ত হয়েছে তারাও মা-কালী ও স্বামীজীর ছবি ঘরে রাখত এবং গীতা সঙ্গে রাখত।”

রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য স্বামী পূর্ণাত্মানন্দকে প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেছেনঃ “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক লোকনাথ বল মহাশয়ের অধীনস্থ কর্মচারী ছিলাম। তাঁর নিজের মুখ থেকেই শুনেছি, মাস্টারদা যেমন আমাদের গীতার মর্মকথা বুঝিয়েছিলেন, তেমনি স্বামী বিবেকানন্দের বীরবাণী, বর্তমান ভারত, কর্মযোগ ও স্বামীজীর উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতাবলী পড়তে উৎসাহ যোগাতেন।”

সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রাজমনি সেন এবং মায়ের নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। দুই ছেলের নাম সূর্য ও কমল। চার মেয়ের নাম বরদাসুন্দরী, সাবিত্রী, ভানুমতী এবং প্রমিলা। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হন। সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ও ভাল ছাত্র ছিলেন এবং ধর্মভাবাপন্ন ও গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।

১৯১৬ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি বলে প্রসিদ্ধ, অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে বিএ পাশের সাথে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন ও উমাতারা উচ্চ-বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক রুপে যোগদান করেন। সেই শুরু, বাকিটা ইতিহাস।

১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দির বিচার আরম্ভ হয়। সূর্য সেন মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সাথে তিনি আদালত ভবন ধ্বংস করারও উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কল্পনা দত্ত। হামলার দিন ধার্য করা হয়েছিল ৩রা জুন। শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাইনটি বসানোর সময় পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

সূর্য সেনের দলের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু সূর্য সেন ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন। এই সময় তাঁর গ্রেফতারের জন্য ৫০০০ টাকার পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়েছিল। এরই ভিতরে ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হন। এই বাড়িতে তখন ছিলেন সূর্য সেন, নির্মল সেন, প্রীতিলতা এবং অপূর্ব সেন। সেখানে আচম্বিতে গোর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। এখানকার যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। বিপ্লবীদের পক্ষে শহিদ হয়েছিলেন নির্মল সেন। পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন অপূর্ব সেন (ভোলা)।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর ডায়রি থেকে জানা যায়, এই সময় অপূর্ব সেন জ্বরে কাতর ছিলেন। দোতলার একটি ঘরে প্রীতিলতা, অপূর্ব সেন ও নির্মল সেন ছিলেন। সৈন্যদের আগমনের কথা সূর্য সেন এসে সবাইকে জানান। সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিচের তলার মেয়েদের ভিতর পাঠিয়ে দেন। আক্রমণের শুরুতেই ক্যামেরন নির্মল সেনের গুলিতে আহত হয়। এরপর আরও কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের ভিতর গুলি চলে। এক পর্যায়ে নির্মল সেন মৃত্যুবরণ করেন। পরে প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে সূর্য সেন সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। এই সময় সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যুবরণ করেন।

জুলাই মাসে সরকার সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িয়ে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়।
‘সূর্য সেনকে ধরিয়া দিতে পারিলে দশ হাজার টাকা পুরস্কার।’ এই ছিল শিরোনাম, নিচে বিস্তারিত খবরের বিবরণ দেওয়া হল।

খবরটি ছিল-
‘১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কার্যে বিপ্লবী দলের নেতা বলিয়া কথিত সূর্য সেনকে যে ধরিয়া দিতে পারিবে, বা এমন সংবাদ দিতে পারিবে যাহাতে সে ধরা পড়ে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে। বিগত ১৩ই জুন তারিখে পটিয়ার বিপ্লবীদের সহিত যে সংঘর্ষের ফলে ক্যাপ্টেন ক্যামেরণ নিহত হইয়াছেন, সূর্যসেনই নাকি সেই সংঘর্ষের পারিচালক।’
(আনন্দবাজার। ৩রা জুলাই ১৯৩২)

এরপর সূর্য সেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। এ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ করা হল ইউরোপীয়ান ক্লাব। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হলেন। ধরা না দেবার প্রত্যয়ে, সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দিলেন। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম নারী শহীদের নাম প্রীতিলতা।

‘ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি’…তখন সবার মুখে মুখে এই কথা!

সূর্য সেন ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সময় ইংরেজ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা। এখানে ব্রজেন সেন মাস্টারদাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য নিয়ে আসেন। এই গ্রামের বিশ্বাস-বাড়ির গৃহবধু ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে ছিলেন। ব্রজেন সেনের বাসা থেকে কার জন্য খাবার নিয়ে ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে যাচ্ছে, তা জানার জন্য ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেন বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে সূর্য সেনের অবস্থানের কথা জানতে পরে, পুলিশকে খবর দেয়। তারপর রাতের বেলা আলোর সংকেত দেখিয়ে নেত্র সেন সৈন্যদের পথ দেখায়। বিষয়টি ব্রজেন সেন বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেও সূর্য সেনকে রক্ষা করতে পারেননি। ক্যাপ্টেন ওয়ামস্‌লীর নেতৃত্বে একদল গোর্খা সৈন্য সূর্য সেনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি হয়।

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মূল লেখাটি ছিল ইংরেজিতে। নিচের তারই বাংলা তুলে ধরা হল –
‘আমার শেষ বাণী –আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো সময়।

কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো থেমো না, পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টারের দিনের সেই বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে যেনো বিভেদ না আসে কখনো– এটাই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

চট্টগ্রাম কারাগার
১১ই জানুয়ারি, ১৯৩৪
বন্দেমাতরম
সকাল ৭টা।

উশাষ চট্টোপাধ্যায়

তথ্যসূত্র :
• চিটাগং এন আপরাইসিং: মানিনি চ্যাটার্জি, কলকাতা ও সুবোধ রায়ের সাক্ষাৎকার ২০০৫

• চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন : চারুবিকাশ দত্ত, কলকাতা

• আমি সুভাষ বলছি। প্রথম খণ্ড । শৈলেশ দে। বিশ্ববাণী প্রকাশনী। কলকাতা-৯। অগ্রহায়ণ, ১৩৭৫
ও শঙ্করীপ্রসাদ বসুর বই এবং উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.