নতুন ভারতে বন্দে মাতরমের নবরূপ ‘জয় শ্রীরাম’

শব্দ ব্রহ্ম। স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে বন্দে মাতরম্ ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী শব্দ। দেশমাতৃকার পুজোর মন্ত্র। বন্দে মাতরম্ উচ্চারণ করে বিপ্লবীরা অনায়াসে ফঁসির মঞ্চে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতেন, সাধারণ মানুষের রক্তে খেলে যেতো‌ বিদ্যুৎ। ভীরু কাপুরুষও উঠে দাড়িয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়তেন, মায়েরা অক্লেশে নিজের শরীরের গহনা খুলে তুলে দিতেন বিপ্লবীদের হাতে, নিজের স্বামী- পুত্রকেও সমর্পণ করতেন ভারতমাতার চরণে। বন্দে মাতরম্ উচ্চারণ মাত্রই শৃঙ্খলমুক্ত ভারতমাতার ছবি ভেসে। উঠতো‌ ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায়। শয়নে-স্বপনে, আহারে-বিহারে বলে মাতরম্‌ই ছিল দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর জপের মন্ত্র, গানের কলি, বিপদের ইষ্টনাম, স্বদেশমন্ত্রের ধ্বনি।
কিন্তু এই বন্দে মাতরম শুনলে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কানে যেন গরম সিসা প্রবেশ করতো‌। এক অজানা আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা, গ্রাস করতো‌ সাম্রাজ্যবাদীদের। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতো‌ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের এক ভয়ংকর দৃশ্য। কিছু কট্টরপন্থী মুসলমান যাদের কাছে আগে নিজের মুসলমান সত্তা তারপর দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি, তাদের কাছে বন্দে মাতরম্ পৌত্তলিকতার নামান্তর। অতএব ইসলাম বিরো‌ধী। বন্দে মাতরমের বজ্রনির্ঘোষ পরম পরাক্রমশালী ব্রিটিশকে ভারত ছাড়া করলেও ওই কট্টরপন্থী ইসলামিক গো‌ষ্ঠী কিন্তু ভারতেই রয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতে এই কট্টরপন্থীদের তো‌ষণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বন্দে মাতরম্‌কে নবলব্ধ স্বাধীনতায় কাজে লাগিয়ে নতুন ভারত গড়ে তো‌লার মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ না করে একটি সাধারণ স্লোগানে পর্যবসিত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার প্রায় সাতদশক পরে ১৯১৪ সালে নরেন্দ্র মো‌দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে শক্তিশালী সরকার গঠনের পর প্রথমবার ‘নতুন ভারত’ গড়ার ভাবনাকে একটি বড় রাজনৈতিক সঙ্কল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই নতুন ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯-এর লো‌কসভা নির্বাচনে আরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়েছে বিজেপি সরকার। পারিবারিক শাসন মুক্ত,জাতপাত ইস্যুমুক্ত ভারতীয় রাজনীতির গুণাত্মক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বিদেশেও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির জোশ দেখে মনে হয় এ যেন সেই বন্দে মাতরম্ ধ্বনি নতুন সুরে, নতুন ভাবনায়, নবকলেবরে অবির্ভূত হয়েছে। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে যেন নতুন ভারত গঠনের প্রেরণার উৎসস্থলগুলি পুনরায় জেগে উঠছে। অপর দিকে ভারত-বিরো‌ধী অপশক্তি ও তার দোসররা। এই ধ্বনি শুনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, অস্থির হয়ে উঠছে। ফলে পরাধীন ভারতের মতো‌ যেন এক সম্মুখ সমরের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
জয় শ্রীরাম ধ্বনির উৎপত্তি কখন কোথায় হয়েছে এটা বলা সম্ভব না হলেও রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময় সুনামির ঢেউয়ের মতো‌ আছড়ে পড়েছিল এই ধ্বনি। বন্দে মাতরমের মতো‌ জয় শ্রীরামও যে মৃত্যুঞ্জয়ী ধ্বনি তা ১৯৯০ সালে প্রমাণ হয়ে গেছে। ওই বছর ঘো‌ষিত কর্মসূচি অনুসারে রামজন্মভূমিতে মন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্যে করসেবা হওয়ার কথা ছিল। এই উদ্দেশ্যে ২১ অক্টোবর থেকে অযো‌ধ্যায় করসেবকরা জমায়েত হতে শুরু করে। করসেবা রুখে দেওয়ার জন্য সেদিন অযো‌ধ্যায় নজিরবিহীন ভাবে ২৮০০ সশস্ত্র পুলিশ নিয়ো‌গ করা হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদব ঘো‌ষণা করেছিলেন যে ‘অযো‌ধ্যায় একটি পাখিও প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু এই সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে ৩০ অক্টোবর জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে রামভক্তরা অযো‌ধ্যায় প্রবেশ করেছিল। কলকাতার কোঠারী ভ্রাতৃদ্বয় সেদিন বিতর্কিত ধাঁচার উপরে গেরুয়া পতাকাও তুলে ধরেছিলেন। মুলায়ম সিংহের নির্দেশে সেদিন রামভক্তদের ওপর সরাসরি গুলি চালিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। দেখতে দেখতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল জয় শ্রীরাম। ধ্বনিতে উজ্জীবিত রামভক্তদের শব। সরযূর তীরে পদপিষ্ঠ হলেন অনেক রামভক্ত। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ৭২ ঘণ্টা পর ২ নভেম্বর আবার গুলি চলল রামভক্তদের উপর। আবার লুটিয়ে পড়লেন কিছুরামভক্ত। সরকারি হিসেবে এই দুদিনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১৬ হলেও বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা অনেক। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুসারে সেদিন রামভক্তদের দেহগুলি লো‌পাট করে দেওয়া হয়েছিল মৃতের সংখ্যা কম দেখানো‌র উদ্দেশ্যে।
স্বাভাবিক ভাবেই জয় শ্রীরাম ধ্বনির দাপটে সে সময় প্রমাদ গুনেছিলেন উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন মুলায়েম সিংহ যাদব সরকার। অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল এই ধ্বনির উপর। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠে ছিল যে শেষযাত্রায় ‘রামনাম সত্য হ্যায়’ ধ্বনি দিয়েও পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে- এমন সংবাদও তখন ছাপা হয়েছিল। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয় দেশের অন্যত্রও এই ধ্বনি দিয়ে সাধারণ মানুষ বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও প্রচুর।
হাল আমলে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি মমতা ব্যানার্জির মতো‌ মুখ্যমন্ত্রীর পদমর্যদার একজন মানুষকে কতটা রুষ্ট করে তুলতে পারে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে তা বিশ্ববাসী দেখেছে। এই ধ্বনি শুনে মেজাজ হারিয়ে বিশাল কনভয় থামিয়ে মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে নিজে তেড়ে যাচ্ছেন, অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছেন, শেষে পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছেন। শুধু মমতা ব্যানার্জি একা নন, ভারতে এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যাদের জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনলে কানে গরম। সিসে ঢুকে যাওয়ার মতো‌ অনুভূতি হয়। এদের অনুভূতি যেন সেই ব্রিটিশদের শাসকদের বন্দে মাতরম্ শো‌নার মতো‌।
অতি সম্প্রতি নো‌বেলজয়ী অমর্ত্য সেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন তিনি নাকি এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জয় শ্রীরাম ধ্বনি শো‌নেননি। বাংলার সংস্কৃতিতে ‘রাম’ নেই। এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে নাগরিক সমিতির নামে অমর্ত্য সেনের ছবি সংবলিত ‘রাম’ নিয়ে দেওয়া বার্তা লেখা ফ্লেক্স টাঙানো‌ হয়েছে। ফিরহাদ হাকিম আহ্লাদে আটখানা হয়ে শ্রী সেনের সমর্থনে সাংবাদিক সম্মেলন করে বললেন, ‘জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে নাকি এখন মানুষ মারা হচ্ছে, অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফিরহাদের গলায় আবার যেন বন্দে মাতরম্ নিয়ে ব্রিটিশ প্রভুদের সেই পুরো‌নো‌ সুর শো‌না যাচ্ছে।
একটু বিশ্লেষণ করলেই বো‌ঝা যাবে নো‌বেল জয়ী অমর্ত্য সেনের বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো‌ যো‌গ আছে কিনা। এখনো‌ বাঙ্গালি মৃতদেহ সৎকারের সময় রাম নাম সত্য হ্যায়’, ‘বল হরি হরি বল’ ধ্বনি দেয়। এখনো‌ গ্রামবাংলায় রামায়ণ কথা কিংবা রামমঙ্গল গান সবচেয়ে জনপ্রিয় লো‌ককলা। এখনো‌ রামায়ণের কাহিনি নিয়ে যাত্রাপালা সুপারহিট হয়। রামানন্দ সাগরের রামায়ণ সিরিয়াল যখন দূরদর্শনে দেখানো‌ হতো‌ সেসময় অমর্তবাবু দেশে থাকলে দেখতে পেতেন যে রামায়ণ দেখার জন্য রাজ্যের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতো‌, গাড়িঘো‌ড়াও দাঁড়িয়ে পড়তো‌। ভারতবর্ষে এমন কোনো‌ জনপদ নেই যেখানে রামের নামে নবজাতকের নাম রাখা হয় না। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গে রামকৃষ্ণ, রাম, রামগো‌পাল, রামনারায়ণ নামে প্রচুর বাঙ্গালি আছেন। আধুনিক বাঙ্গালি মা-বাবারাও রামের নামে নবজাতকের নাম রাখেন। গ্রামে এখনো‌ অনেক মানুষ আছেন যারা গণনার সময় এক, দুই, তিন চার না বলে রাম, দুই, তিন, চার অর্থাৎ এক’ এর । বদলে রাম বলেন। দুর্গাপূজো বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। বাঙ্গালিদের দুর্গাপুজো আসলে অকাল বো‌ধন। এই অকালবো‌ধন রামচন্দ্রই শুরু করেছিলেন। ভগবান রামচন্দ্রের অযো‌ধ্যা আগমন উপলক্ষ্যে দীপাবলি উৎসব পালন করেছিল অযো‌ধ্যাবাসী। সমস্ত ভারতের সঙ্গে বঙ্গদেশের মাটিতেও দীপাবলি সমান জনপ্রিয়। তুলসীদাস রামায়ণ রচনার অনেক আগে বাংলাভাষায় কৃত্তিবাসী। রামায়ণ রচিত হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, জয়। শ্রীরাম শুনলে এক শ্রেণীর মানুষ এতটা ক্ষেপে যান কেন?
একটু গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে যে এই ধ্বনি শুনলে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের চোখে ভেসে উঠে। হিন্দুত্বের পুনরুত্থানের দৃশ্য, অযো‌ধ্যায় বিরাট রামমন্দিরের দৃশ্য, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিম তো‌ষণের দোকানগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলো‌পের দৃশ্য, ভারতে ইউনিফর্ম সিভিল কোড কার্যকর হওয়ার দৃশ্য, জাতের নামে বজ্জাতির রাজনীতি বন্ধ হওয়ার দৃশ্য, রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রার দৃশ্য, সংস্কৃত ভাষার পুনরুত্থানের দৃশ্য, দুর্নীতি মুক্ত ভারতের দৃশ্য, সুইস ব্যাঙ্কের অবৈধ অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য, কালো‌টাকা ও বেনামি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার দৃশ্য, সারদা নারদা কাটমানি ইস্যুতে জেলে যাওয়ার দৃশ্য, এক জাগ্রত জনসমাজ তৈরি হওয়ার দৃশ্য। এক কথায় বলতে গেলে জয় শ্রীরাম শুনলেই সমস্ত ভারত জুড়ে ঔপনিবেশিক ভাবনা মুক্ত এক বিরাট নব ভারতবর্ষের দৃশ্য ফুটে উঠে। যে ভারতবর্ষে রাজনীতিকদের লুটেপুটে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, গণতন্ত্রের গলা টিপে বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার কুপ্রথা আর চালু রাখা যাবে না, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে মুসলমান ভো‌টব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে হিন্দুদের আর যা তা বলা যাবে না। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল যে জয় শ্রীরাম বললেই কারো‌ উপর সাম্প্রদায়িক তকমা লেগে যেতো‌। এখন আর সেদিন নেই। এখন আর সত্যকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। নব ভারতের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। সে জন্যই জয় শ্রীরামে এত আপত্তি, এত ক্রোধ।
সাধন কুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.