তৃণমূলের নির্বাচনী স্লোগান ‘খেলা হবে’র আদত অর্থ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ উপলব্ধি করছেন প্রাণ, মান, সম্পত্তি ও মহিলাদের সম্মানের বিনিময়ে। পশ্চিমবঙ্গ মানে কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী শহুরে ও আধাশহুরে এলাকা না। পশ্চিমবঙ্গ মানে বৃহত্তর এক রাজ্য যার জনসংখ্যা ২০২১ সালে দশকোটির বেশি। ‘খেলা হবে’ স্লোগানের বিপুল ‘বিক্রম’ ও ‘সাফল্য’ তৃণমূল এবার পালন করতে চলেছে ‘খেলা হবে দিবস’ পালন করার মধ্য দিয়ে। আগামী 16ই আগস্ট ‘খেলা দিবস’ / ‘খেলা হবে দিবস’ পালনার্থে বাচ্চাদের ফুটবল-আদি বিতরণ করা হবে— ঘোষিত হয়েছে ২১শে জুলাই, তৃণমূল সুপ্রিমোর তরফ থেকে। প্রশ্ন উঠেছে এমন দিবসের আদত তাৎপর্য কি? সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে নানাবিধ আন্দাজ ও অনুমান। কেউ কেউ বলছেন মুসলীম লীগের হিন্দু গনহত্যার ইতিহাস মুছতে চাইছে তৃণমূল। সোশ্যাল মিডিয়া জমানায় ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টে ঘটে যাওয়া গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নিয়ে প্রচুর লেখা লেখি, বক্তৃতা এবং ভয়াবহ সে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচারণা করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন ইতিমধ্যেই করা হয়েছে ২০২১এর ভোটে সংখ্যার বিচারে যার প্রভাবও পড়েছে। আসন সংখ্যায় বিজেপির চেয়ে ১৩৬টি আসন বেশি পেলেও সাত কোটি ভোটারের রাজ্যে ভোট সংখ্যায় মাত্র ৫৯ লক্ষ (প্রায়) ভোট বেশি পেয়ে তৃণমূল হারিয়েছে বিজেপিকে। এই কঠোর সত্যটিকে জোর করে অস্বীকার করতেই হয়ত বা ১৬ই আগস্ট গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’এর দুঃস্বপ্নের দিনে তৈরি করতে চাওয়া হচ্ছে এক অলীক সম্প্রীতির বাতাবরণ। সম্প্রীতি তাদের সঙ্গেই যারা শুধু ১৯৪৬ এ নয়, ২০২১ এও এ রাজ্যে চালিয়েছে হিন্দু মারণলীলা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি ইতিহাস বদল করতে চাইছেন? উঠছে প্রশ্ন। কিন্তু শুধু ইতিহাস বদলের উদ্দেশ্য যদি থাকত, তবে দিনটির অন্যতর নামকরণ হতে পারত, যেমন সম্প্রীতি দিবস বা অনুরূপ অন্য কিছু। তা না করে ‘খেলা হবে /খেলা দিবস’ নামকরণের গূঢ়তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বোধ করি অন্য। আন্দাজ করা কি ভুল হবে যে “খেলা হবে” স্লোগান দিয়ে 2 মে’র পর থেকে যে হিন্দুঘাতী হত্যালীলা চালানো হয়েছে রাজ্যজুড়ে, চাপের মুখে পড়ে দেখানোর প্রয়াস করা হচ্ছে যে ‘খেলা হবে’ স্লোগানের আদতে সেমত কোনো কদর্থ ছিল না এবং সেরকম জঘন্য কিছু হয়ও নি, যেমন বলতে চাইছেন তৃণমূলের রাজনৈতিক বিরোধীরা? ‘খেলা হবে’ বলতে নির্বিষ ভোটের খেলাই বোঝানো হয়েছিল সেইটি বোঝাতেই কি ‘খেলা হবে দিবস’এ ফুটবল বিতরণ করে বিষয়টিকে লঘু করে দেওয়ার প্রয়াস করা হচ্ছে? “খেলা হবে” স্লোগান দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত জেলায় অগুনতি মহিলাকে যে গণধর্ষণ করা হয়েছে, বাড়িঘরসম্পত্তি জমিজমা যে লুণ্ঠিত হয়েছে, অসংখ্য মানুষকে যে হত্যা করা হয়েছে, বহু সহস্র মানুষ যে আজও রাজ্যছাড়া, নিজেদের বাড়িতে ফেরার জন্য তাদেরকে যে এক্সটরশন মানি জমা দিয়ে কার্যতঃ নাকে খত দিয়ে নিজগৃহে ফেরার শর্ত দেওয়া হচ্ছে সে সকল তথ্যসম্বন্ধীয় যৎসামান্য সন্দেহ যা কিছু কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ মানুষের মনে (যারা তৃণমূলের ইন্টেলেকচুয়াল সাপোর্ট বেস) দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সে সন্দেহকে জনমানস থেকে নির্মূল করতেই কি ‘খেলা হবে দিবস’এ ফুটবল বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? এতদ্বারা কি বোঝাতে চাওয়া হবে যে ‘খেলা হবে’ স্লোগানের যে অর্থ এতদযাবৎ রাইট উইঙ্গাররা করেছেন তা ভুল ছিল?
16 আগস্ট দিনটি পছন্দ করার কারণও বোধ করি রাইট উইং রাজনীতিকদের বিভ্রান্ত করা যাতে তাঁরা আরও বেশি করে তৃণমূল সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে হিন্দুহত্যার অভিযোগ তোলেন এবং আদতে 16 আগস্ট যখন আসবে তখন যখন শুধুই ফুটবল ম্যাচ, ফুটবল ও খেলনা-আদি বিতরণ করা হবে, সেই সময় যাতে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণের মনে হয় যে রাইট উইং রাজনীতিকরাই বিষয়টিকে অযথা অতিরঞ্জিত করছিলেন। 16 আগস্ট দিনটিতে জনগণ ও রাইট উইং রাজনীতিকদের যদি এইপ্রকার রাজনৈতিক চালাকির দ্বারা ‘মাত করতে’ পারা যায়, তবে এতদযাবৎ পশ্চিমবঙ্গজুড়ে যে নারকীয় ‘খেলা’ আদতেই হয়েছে এবং এখনও চলছে, তাকেও পরোক্ষে ‘হয় নি’ করে দেওয়া যাবে। যে সব মানুষ ভুক্তভোগী নয়, এই সূত্রে সেই সব মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসটুকু অন্ততঃ করা যাবে।
‘খেলা হবে দিবস’ পালন করার জন্য 16 আগস্ট দিনটিকে বেছে নেওয়ার সম্ভাব্য কারণ দুইটি।
- —মানুষের মনে (বস্তুতঃ ইতিহাস-সচেতন মানুষের মনে) আরও ভয় ও আশঙ্কা তৈরি করা যাতে তাঁদের মনে হয় ঐতিহাসিকভাবে কুখ্যাত গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এর দিনে ‘খেলা হবে দিবস’এর নাম করে আরও না জানি কত রক্ত বইবে তৃণমূল সুপ্রিমোর অঙ্গুলিহেলনে, এবং এমত আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আক্রান্ত মানুষকে আরও করে বেশি তাঁবে আনতে চাওয়া? বুঝিয়ে দিতে চাওয়া যে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তিনিই? ফলে পূর্ণ ধ্বংসের জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা মানুষ যখন দেখবে যে 16 আগস্ট ঘটানো হল না তেমন কিছুই বরং বাচ্চাদের দেওয়া হল খেলনা আর ফুটবল, তখন আক্রান্ত, আতঙ্কিত মানুষ যেন নতুন করে যৎকিঞ্চিৎ ভরসা আবার ফিরে পাবেন তৃণমূল সুপ্রিমোর ওপর? একটি অ্যানালজি হয়ত প্রাসঙ্গিক হবে। ডাকাতের শাসনে থাকতে বাধ্য হলে নিরীহ মানুষের পক্ষে মাঝে মাঝে নিজের এঁটো রুটির টুকরো ছুঁড়ে দেওয়া হিংস্র, নৃশংস ডাকাতসর্দারকে ভালো, দয়ালু ভাবতে চাওয়া স্বাভাবিক। কারণ তেমন ভাবতে পারলে প্রাণটুকু অন্ততঃ রক্ষা পায়। কিন্তু তেমন ভাবতে না পারলে এবং ডাকাতের হাত থেকে শাসনভার কেড়ে নিতে চাইলে যে বাঁচার উপায়টুকুও আর থাকে না। মনে করা প্রয়োজন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সেই ভয়ার্ত উক্তি। “আবারও যদি পালাতে হয়, তবে কোথায় যাবো দিলীপবাবুরা বলে দিন।“ এই শ্রেণীর বাঙালী মানুষ পালাতে হওয়ার জন্য ডাকাতদেরকে নয়, বরং যাঁরা ডাকাতকে নির্দ্বিধায় ‘ডাকাত’ বলেন তাঁদেরকে দায়ী করেন। এবং এঁরা এ রাজ্যের ভোটারদের 10 — 12%. পূর্ণসংখ্যা হিসেবে সংখ্যাটি কম নয়।
- —16 আগস্ট দিনটির ঐতিহাসিক ভয়াবহতার কারণে ঐ দিনটিকে ‘খেলা হবে দিবস’ হিসেবে স্থির করলে রাইট উইঙ্গারদের আরও বেশি করে ক্ষেপিয়ে দেওয়া যাবে বলে ভেবেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তিনি সম্ভবতঃ আন্দাজ করেছেন যে ১৬ই আগস্ট দিনটির উল্লেখমাত্র করলে রাইট উইং রাজনীতিকরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তৃণমূল সুপ্রিমোর তুলনা করবেন এবং ‘খেলা হবে দিবস’ নিয়ে মানুষের মনে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য প্রচার-প্রসার করতে থাকবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতিবাচক প্রচার রাইট উইং রাজনীতিকরাই সাফল্যমণ্ডিত করবেন। তারপর যখন বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটবে না, শুধু ফুটবল বিলোনো হবে, তখন একযোগে সমস্ত রাইট উইঙ্গারদের ভুল, মিথ্যেবাদী ও দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য অপপ্রচারকারী দল হিসেবে প্রমাণ করে দেওয়া হবে তৃণমূল সুপ্রিমোর তরফ থেকে। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ‘সেক্যুলার’ জনগণও অতঃপর বিপুল আশ্বাস ও দৃঢ়তর বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন উদ্যমে “কা কা ছি ছি” শুরু করবেন কি?
অতএব ‘খেলা হবে দিবস’ নিয়ে অযথা মাতামাতি করে অন্যের হাতের ‘খেলনা’য় পরিণত হওয়া নিরর্থক। কর্তব্য হল ভোটপরবর্তী হিংসার যে সকল তথ্য ও স্ট্যাটিসটিক্স জমা পড়েছে, সেইগুলির যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশের আইনব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অত্যাচারিত, নিগৃহীত মানুষের জন্য সুবিচারের ব্যবস্থা করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় রত থাকা। পশ্চিমবঙ্গের হাড় হিম করা হিংসার চিত্র ভারতবর্ষের চিরন্তন ভাবমূর্তিতে ইতিমধ্যেই ঘন কালিমা লেপন করেছে। কেবল আবেগ দিয়ে তার দূরীকরণ সম্ভব নয়। (মতামত ব্যক্তিগত)
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya