হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল? প্রাথমিক সমীক্ষা – ৩

তৃতীয় অধ্যায় : কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন

ইসলামিক হানাদাররা কেন তাদের আধিপত্য চলাকালীন সময়েও হিন্দু মন্দিরগুলি ধ্বংস করে এবং কেনই বা হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তিগুলির অবমাননা করে? কেন তারা হিন্দু মন্দিরগুলির ভূমি অধিকার করে সেখানে মসজিদ বানিয়েছিল? ইসলামের সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আধুনিক কালে হিন্দু পণ্ডিতরা এই প্রশ্নগুলি সামনে এনেছেন। এই প্রশ্নটির দুটি উত্তর সামনে এসেছে, একটি ইসলাম ধর্মতত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় : কুরআন এবং নবীর সুন্নার উপর ভিত্তি করে। অন্যটি মার্ক্সবাদী অধ্যাপকরা প্রস্তাব করেছেন এবং ইসলামের ক্ষমাকারী ব্যক্তিদের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। আমরা এখানে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটির উপর প্রথমে আলোকপাত করবো।
হিন্দু মন্দির ধ্বংস সম্পর্কে মার্ক্সবাদী প্রস্তাবকে অগ্রণী করার প্রধান কৃতিত্ব আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবের। ১৯২৪ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর “সুলতান মামুদ অফ গজনী” গ্রন্থে তিনি এই তত্ত্বটির প্রস্তাবনা করেছিলেন: যে মামুদের হিন্দু মন্দির ধ্বংস ধর্মবিশ্বাসের জন্য নয়, বরং লুণ্ঠনের লালসা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তাঁর মতে, ভারত সেই সময় সমৃদ্ধ খনি এবং সমৃদ্ধ রফতানি বাণিজ্য থেকে যুগে যুগে জমা হওয়া সোনা ও রুপোর সম্ভারে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল। তিনি লিখেছেন যে বেশিরভাগ সম্পদ মন্দিরের কোষাগারে কেন্দ্রীভূত ছিল, যদিও তিনি তার এই অভিমতের কোনো প্রমাণ দেখাননি।

অধ্যাপক লিখেছেন যে ভারতীয় মন্দিরগুলির বিশাল ধনসম্পত্তির কারণে শক্তিশালী লুণ্ঠনকারীদের এইরকম বিবেকবর্জিত কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিল। মামুদের চরিত্রের মতো একজন মানুষকে যে ইসলামের সহনশীলতার আদর্শ অন্যের ধনসম্পত্তি হরণ করা থেকে বিরত করতে পারবে না এটা বলাই বাহুল্য। মামুদের কাজটি সহজ হয়ে গিয়েছিল কারণ ভারতীয়রা ধনসম্পদগুলিকে কয়েকটি জায়গায় কেন্দ্রীভূত করে জমা করেছিল (পৃষ্ঠা ৮২). অধ্যাপক হাবিব, মামুদের দ্বারা হিন্দু মন্দির ধ্বংস সম্পর্কিত কোনও স্পষ্ট তথ্য গোপন করেননি, যদিও তিনি যে বিবরণগুলি দিয়েছেন তা ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, কখনও কখনও কেবল পাদটীকাতে সীমাবদ্ধ। তিনি আরও বর্ণনা দিয়েছিলেন যে কীভাবে খলিফা এবং জনগণ বাগদাদে মামুদের লুঠের সম্পত্তিগুলি নিয়ে আনন্দ উপভোগ করেছিল। আরব, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানে একইভাবে বিজয়ী নবীর সঙ্গীদের সঙ্গে নায়ককে (মামুদ) তুলনা করা হয়েছিল।

তিনি (অধ্যাপক) যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তা মামুদের সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদ এবং ইসলামের ধর্মতত্ত্ববিদদের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তিনি লিখেছেন,

“ইসলাম” ভাঙচুরকে অনুমোদন করে না এবং আক্রমণকারীর লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যকেও প্রশ্রয় দেয় না। শরীয়তের কোনো নীতি অবাঞ্ছিতভাবে হিন্দু রাজাদের আক্রমণ করাটাকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে না, বিশেষতঃ যারা মামুদ ও তার প্রজাদের কোন ক্ষতি করেনি। উপাসনার স্থানসমূহের ইচ্ছাকৃত ধ্বংসকে প্রতিটি ধর্মের বিধি দ্বারা নিন্দা করা হয়। ইসলামও এক্ষেত্রে কোনো অনুপ্রেরণামূলক ভূমিকা পালন করেনি, লোভী শাসকরা ইসলামকে সুবিধামতো ব্যবহার করেছিলো। কোরানের নিয়মগুলি ভুল ব্যাখ্যা করা বা উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় খলিফার সহনশীলতার নীতিটি একদিকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল যাতে মামুদ ও তার সঙ্গীরা সুস্পষ্ট ও উদ্বেগহীন বিবেকের দ্বারা হিন্দু মন্দিরগুলি লুণ্ঠন করতে পারে” (পৃষ্ঠা ৮৩-৮৪)।

মামুদের অপরাধবোধ এবং ইসলামের নির্দোষতার এই ব্যাখ্যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার স্থপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ১৯৩২ সালের ১লা জুন তারিখে একটি চিঠিতে তিনি তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে লিখেছিলেন, মামুদ মোটেও কোনও ধর্মীয় মানুষ নন। যদিও, তিনি ঘটনাচক্রে মুসলমান ছিলেন, তবে তিনি যা করেছেন সেটা তিনি যে কোনো ধর্মাবলম্বী হলেই করতেন। (Glimpes of World History, ১৯৮২ পুনর্মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ১৫৫।)

প্রকৃতপক্ষে, পণ্ডিত নেহরু অধ্যাপক হাবিবের চেয়েও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক হাবিব লিখেছিলেন যে কীভাবে মামুদ মথুরায় কয়েক হাজার মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর প্রশংসার পরেও সেগুলি পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পণ্ডিত নেহরু লিখেছেন : কীভাবে মামুদ মন্দিরগুলির প্রশংসা করেছিলেন, মামুদ যে এগুলি ধ্বংসও করেছিলেন সেই বর্ণনা তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। (পৃষ্ঠা স্থান ১৫৫-১৫৬)

এইভাবে হিন্দু মন্দিরগুলির একজন দৃঢ়সংকল্প ধ্বংসকারী হিন্দু স্থাপত্যের একজন প্রগাঢ় প্রশংসকে রূপান্তরিত হয়েছিল! ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’তেও মামুদের এই চিত্রটি অপরিবর্তিত থেকে যায় ১৯৮২ পুনর্মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২৩৫)।

পরবর্তীকালে, অধ্যাপক হাবিবের গবেষণাপত্র, যেটি মামুদের লুণ্ঠনের জন্য তার ব্যক্তিগত লালসাকেই দায়ী করে, ইসলামধর্মের প্রতিমাধ্বংসী মতাদর্শকে নয়, সেটিই মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের কাছে প্রধান স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে থেকে যায়। কালক্রমে মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরা ভারতের ইতিহাস সংক্রান্ত সমস্ত গবেষণা, রচনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রকের আসনে উপনীত হন। সুতরাং এই তত্ত্বটি মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসে মুসলিম প্রতিমাধ্বংসী সমস্ত ক্রিয়াকলাপ আড়াল করার জন্য তৈরী হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ইসলাম বা এর ধর্মতত্ত্বের কোনোরকম উল্লেখ করাটাও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধে অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিকদের দ্বারা লিপিবদ্ধ তথ্য উদ্ধৃত করার মতো সাহস দেখানো যে কোনও ঐতিহাসিককে “হিন্দু সাম্প্রদায়িক” বলে নিন্দিত হতে হতো।

তিন মার্ক্সবাদী অধ্যাপক, ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারকে আক্রমণ করে একটি বই লিখেছিলেন, কারণ এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক, কমিউনিস্ট রাজনীতির বেদীতে সত্যকে বলিদান দিতে অস্বীকার করেছিলেন। বইটি একটি কমিউনিস্ট প্রকাশনা কর্তৃক ছাপা হয়েছিল এবং তা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমের জন্য নির্ধারিত ছিল। উপরন্তু মার্ক্সবাদী অধ্যাপকরা এই বিষয়টির একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন। হিন্দু মন্দিরগুলিকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে দেখার চেষ্টা হয়েছে যা মুসলিম সুলতানরা দমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় যদি মন্দিরগুলি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তার দায় কখনোই সুলতানদের নয়, তাঁরা গণশৃঙ্খলা ও শান্তির স্বার্থে কঠোর পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকতেন।

১৯৮৫ সালের ১ম অক্টোবরে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে বারো জন মার্ক্সবাদী অধ্যাপকরা আওরঙ্গজেবের হয়ে সওয়াল করেন; সেই আওরঙ্গজেব যিনি মথুরার কেশবদেব মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এবং তার জায়গায় একটি ঈদগাহ স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা লিখেছিলেন,

“ডেরা কেশবরাই মন্দির’টি, জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে রাজা বীরসিংহ বুন্দেলা কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এই বিশাল মন্দিরটি শীঘ্রই অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সম্পদশালী হয়ে ওঠে। আওরঙ্গজেব এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, এর সম্পদকে লুঠ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই স্থানে একটি ঈদগাহ তৈরি করেছিলেন। তাঁর এই পদক্ষেপটি সম্ভবতঃ রাজনৈতিকভাবেও উদ্বুদ্ধ ছিল, কারণ মন্দিরটি ধ্বংস হওয়ার সময় তিনি বুন্দেলা ও মথুরা অঞ্চলে জাঠ বিদ্রোহের সমস্যার সম্মুখীন হন।”

একই মার্ক্সবাদী অধ্যাপকরা এরপর ইসলামী প্রতিমাধ্বংসী মতবাদকে ব্যাখ্যা করার জন্য হিন্দু কর্তৃক বৌদ্ধ ও জৈন উপাসনামন্দির ধ্বংসের কথা বলেন। এ বিষয়ে তাঁরা মোটামুটি ছয়টি উদাহরণ প্রস্তুত করেছেন, যদিও সেগুলির বাস্তবিক ভিত্তি সন্দেহাতীত নয়। সংস্কৃত সাহিত্যের কয়েকটি অনুচ্ছেদ এবং কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নিয়ে জল্পনা দ্বারা গল্পগুলিকে সত্যতার ছাপ দেওয়ার চেষ্টা হয় এবং জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলিতে ব্যাপকাকারে প্রচার করা হয় যে হিন্দুরা বৌদ্ধ এবং জৈন মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করেছিল। এই ভাবেই প্রচারের মধ্যে দিয়ে সংখ্যাটি ছয় থেকে কয়েক সহস্র এবং তার পরে কয়েক লক্ষে পরিণত হয়। তাঁরা প্রাক-হিন্দু ভারতে সর্বপ্রাণবাদী (অ্যানিমিস্ট) উপাসনাগৃহগুলির ধ্বংসের কাহিনীর অবতারণা করেন এবং সেটিকে এই প্রসঙ্গটির সঙ্গে জুড়ে দেন। এবং এই তথ্যগুলি “সত্যের ভুল উপস্থাপনা দ্বারা মিথ্যার সৃষ্টি” একটি বিশাল পরিমাণের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। (“suppressio veri suggestio falsi”, “সাপ্রেসিও ভেরি সাজেসটিও ফলসির”- সত্যের ভুল উপস্থাপনা দ্বারা মিথ্যার সৃষ্টি)

কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় :

শ্রীলঙ্কার এক সাম্প্রতিক বৌদ্ধ বই খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর পুষ্যমিত্র বংশের রাজা শুঙ্গকে এই বলে অভিযুক্ত করেছেন যে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ছিন্ন মাথার পরিবর্তে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। কেবল এই একটি সূত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি ‘ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া’-র রূপকার রূপে পুষ্যমিত্রকে উপস্থাপিত করেন, গুপ্তদের যুগে যার অবসান হয়। ভারহুত এবং সাঁচির বিখ্যাত বৌদ্ধ স্তূপ এবং মঠগুলি যে পুষ্যমিত্রের সমসাময়িক কালে নির্মিত এবং প্রসার লাভ করেছিল, সেগুলির কোনো উল্লেখ সেখানে নেই, গুপ্ত রাজারা এবং রানীরা বোধগয়া, নালন্দা এবং সারনাথে ও অন্যান্য অনেক জায়গায় যে বৌদ্ধ বিহার তৈরি করেছিলেন সে বিষয়েও কোনো উল্লেখ নেই।

মাদুরার একজন পাণ্ড্য রাজা জৈনদের উপর অত্যাচার করে ছিলেন বলে জানা গেছে। এটি শৈব বিশ্বাসের একটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি তাঁর (পাণ্ড্য রাজার) ধর্মবিশ্বাস ছিল। তবে সেই একই উৎসটি আরো বলেছে যে, শৈববাদে রূপান্তরিত হবার আগে তিনি নিজে একজন জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন, এবং সে সময় তিনি শৈবদের উপর অত্যাচার করেন। বইয়ের এই অংশটি মার্ক্সবাদী অধ্যাপকরা জৈনদের উপর অত্যাচারের কথা লেখার সময়ে উল্লেখ করেননি।

কলহনের রাজতরঙ্গিণী অনুসারে, কাশ্মীরের রাজা হর্ষ তাঁর স্বর্ণ ও রৌপ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির লুণ্ঠন করেন যেগুলি প্রতিমা বা মূর্তি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সত্যটি মার্ক্সীয় অধ্যাপকরা খুব ধুমধাম করে প্রচার করেন। তবে তারা কখনই কলহনের নিম্নলিখিত এই মন্তব্যটির উল্লেখ করেননি :

“তিনি যা করেছিলেন তা করার ক্ষেত্রে হর্ষ অনেকাংশে একজন তুর্কীর (মুসলিম) মতো কাজ করেছিলেন এবং সেটা তাঁর অধীনস্থ এক তুর্কীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছিলেন।”

প্রতিমাধ্বংসী মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু রাজাদের এইভাবে মুসলিম আক্রমণকারীদের সমতুল্য করাতে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। এর প্রধান ত্রুটি হলো অনুপাতের অভাব।

প্রথমতঃ, এটি কয়েকজন হিন্দু রাজাদের দ্বারা বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের ধ্বংসের সঙ্গে (যা ঐতিহাসিকভাবে সন্দেহাতীত নয়) ইসলামিক হানাদার বাহিনী দ্বারা কয়েক হাজার ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ এবং জৈন মন্দিরের ধ্বংসকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।

দ্বিতীয়ত, এটি এখনও প্রমাণ দেয়নি যে হিন্দুদের কাছে প্রতিমাধ্বংসী একটি ধর্মতত্ত্ব ছিল যা এই ধরণের ধ্বংসকার্যে উৎসাহ দিয়েছে। কয়েক জন ধর্মান্ধদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন কাজগুলি, যেগুলি কোনও হিন্দু ঐতিহাসিক বা পণ্ডিত দ্বারাও কখনও প্রশংসিত হয়নি, একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। পক্ষান্তরে ইসলামিক প্রতিমাধ্বংসী মতবাদকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মতত্ত্ব। শেষতঃ এটি মার্ক্সীয় নীতির একটি খারাপ দিককে তুলে ধরে, এই পরিপ্রেক্ষিতে যার অর্থ হলো “একটি অন্যায়কে অন্য একটি অন্যায় দিয়ে ব্যাখ্যা করা।”

(পাদটীকা ১)
হিন্দু মন্দিরগুলির ধ্বংসের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলির দিকে মনোযোগ দিলে এগুলি বোঝার জন্য কোনো অসাধারণ কল্পনার দরকার নেই যেগুলি মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাকাররা প্রচুর কষ্টকল্পিতভাবে তৈরী করেছেন। মার্ক্সবাদীদের তত্ত্বটি, সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস থেকে জানতে পারা হিন্দু মন্দির ধ্বংস সম্পর্কিত কোনো ঘটনার একটি অংশও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। এমনকি যদি আমরা ধরেও নিই যে ভারতের হিন্দু মন্দিরগুলি এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে ছিল তথাপি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে কেন সেগুলি লুটপাট ও ধ্বংসের জন্য বেছে নেওয়া হলো। মুসলমানদের উপাসনালয়গুলির অভাব নেই; সেগুলিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ছিল।

হিন্দু মূর্তির অবমাননা এবং মন্দিরের জায়গাগুলিতে মসজিদ উত্থাপনের কাজগুলি যে কোনও অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করে তার ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এটি আশ্চর্যের বিষয় যে মার্ক্সবাদী গবেষণাপত্রগুলি ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে তথ্য আবিষ্কার করার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়।

অধ্যাপক হাবিবকে ইসলামের ধর্মতত্ত্ব বা ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না। তাঁর পক্ষে সর্বাধিক যেটা বলা যায় তা হল যে তিনি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ইসলামিক অসহিষ্ণুতার সর্বাধিক প্রতীক হয়ে ওঠা গজনীর মামুদের মর্যাদাকে বলি দিয়ে ইসলামকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন। এই প্রশ্নটা কারোর মনে আসাটা অস্বাভাবিক নয় যে মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের পরবর্তী সুলতানদের কাজের ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁর যুক্তি সম্প্রসারণের পরিণতি সম্পর্কে তিনি কি সত্যিই অবহিত ছিলেন? যাইহোক, এর ফলাফল ছিল ইসলামের জন্য বিপর্যয়কর। মামুদের এইরকম প্রতিকৃতি সৃষ্টি করে অধ্যাপক হাবিব ইসলামের নায়কদের যে ছবিটি এঁকেছেন তা সাধারণ ভারতবাসীর কাছে একজন লুটপাটকারী দস্যুর থেকে আলাদা নয়।

আশ্চর্যজনকভাবে ভারতে ইসলামের কৈফিয়তদানকারী তথাকথিত ঐতিহাসিকরা অধ্যাপক হাবিবের গবেষণাপত্র যা মার্ক্সবাদী লেখকদের দ্বারা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে, বারবার সেটির কথা লিখেছেন। তাঁরা যদি সত্যবাদী হয়ে স্বীকার করতেন যে প্রতিমাধ্বংসী মতবাদ ইসলামি ধর্মতত্ত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল তাহলে তা পরোক্ষভাবে ইসলামের সেবা হিসাবেই পরিগণিত হত। মধ্যযুগীয় ভারতে তাদের পূর্বসূরীরা এ ধরনের এই ধরনের স্বীকারোক্তি থেকে পিছপা হননি, ভারতের বাইরেও, বিশেষত পাকিস্তানেও একই জিনিস লক্ষ্য করা যায়।

আমাদের দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল একটি আন্তর্ধর্মীয় সংলাপ যাতে সমস্ত ধর্ম তাদের ত্রুটিগুলি এবং সীমাবদ্ধতাগুলি সম্পর্কে সৎ ও স্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য রাখতে পারে। আমরা যদি এই সীমাবদ্ধতাগুলি লুকিয়ে রাখি বা দমন করি বা তথ্য উদ্ভাবনের চেষ্টা করি এবং তথ্যের অসাধু ব্যাখ্যা করি তবে এই জাতীয় কথোপকথন অসম্ভব।

মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন যে ইসলামের জন্ম কেবল গতকালই হয়েছিল এবং এখনও তা ব্যাখ্যার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তথ্য গোপন করা এবং কল্পকাহিনীর নির্মাণ সেই প্রক্রিয়াটির পক্ষে ক্ষতিকর।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৬ এপ্রিল ১৯৮৯

উপসংহার ১

এটা মজার বিষয় যে মার্ক্সবাদী অধ্যাপকরা ট্রান্স-অক্সিয়ানা, সিনকিয়াং, সিস্তান এবং ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসের কথা কখনও উল্লেখ করেননি, যেগুলি ইসলামিক আগ্রাসনের প্রাক্কালে বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তৎকালীন ইতিহাসের চর্চাকারী প্রতিটি ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক জানেন যে বোখারা, সমরখন্দ, খোটান, বালখ, বামিয়ান, বেগম, জালালাবাদ, পেশোয়ার, তক্ষশীলা, মিরপুর-খাস, নগর-পার্কার, শ্রীনগর, শিয়ালকোট, অগ্রোহা, মথুরা, হস্তিনাপুর, কনৌজ, শ্রাবস্তী, অযোধ্যা, সারনাথ, নালন্দা, বিক্রমশীলা, বৈশালী, রাজগীর, ওদন্তপুরী, ভারহুত, পাহাড়পুর, জগদ্দল, জজনগর, নাগার্জুনকোণ্ড, অমরাবতী, কাঞ্চি, দ্বারসমুদ্র, ভারুচ, বলভী, পালিতানা, গর্জন, পাটনা, দিদওয়ানা, নাগৌড়, ওসিয়ান, বৈরাত, গোয়ালিয়র এবং মাণ্ডুতে বিপুল সংখ্যায় বৌদ্ধ, জৈন প্রতিষ্ঠানগুলি ইসলামের তরোয়াল দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। এর সঙ্গে আরো ছোট ছোটগুলি যোগ করলে সংখ্যা হয় কয়েক শতাধিক।

– সীতারাম গোয়েল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.