কোভিডে ‘মৃত্যুপুরী’ রাজধানী, জায়গা কুলোচ্ছে না শ্মশানে, লোকালয়েই গণচিতা

মাঝখানে সরু দেওয়াল। তার এক পাশে নিঝুম জনবসতি। আর এক পাশে জ্বলছে সারি সারি চিতা। ড্রোন থেকে তোলা অতিমারি-কালে রাজধানীর এমনই ছবি এ বার উঠে এল, যা নিউইয়র্কের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। গত বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এমন মৃত্যু মিছিলের দৃশ্য ধরা পড়েছিল নিউ ইয়র্কে। জায়গা কম পড়ায় থরে থরে কফিন সাজিয়ে ঠিক এ ভাবেই কোভিডে মৃতদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে। যদিও নিউইয়র্কে সেই সময়ে কোভিডে মৃতের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার। দিল্লিতে ইতিমধ্যেই কোভিডে মৃত্যু ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
শুক্রবারই দৈনিক সংক্রমণে ফের রেকর্ড গড়েছে ভারত। এক দিনে নতুন করে দেশে ৩ লক্ষ ৩২ হাজার ৭৩০ জন সংক্রমিত হয়েছেন। এর মধ্যে দিল্লিতেই নতুন করে আক্রান্ত ২৬ হাজার ১৬৯ জন। বৃহস্পতিবার রাতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক দিনে সেখানে ৩০৬ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতেই জনবসতিপূর্ণ এলাকার পাশে বহ্নিমান গণচিতার ওই ছবি সামনে এনেছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। তারা জানিয়েছে, শুধু শ্মশানই নয়, রাজধানীর কবরস্থানগুলির অবস্থাও এক। দেহ সমাহিত করার জায়গা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কোভিডে মৃতদের পরিবারকে।
এর আগে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশের মতো জেলায় শ্মশানের বাইরে দেহ নিয়ে সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তবে দিল্লিতে পরিস্থিতি এমন পৌঁছেছে যে, শ্মশানের বাইরে লাইনেও জায়গা পাচ্ছেন না অনেকে। বাধ্য হয়ে বাড়িতেই প্রিয়জনের মৃতদেহ রেখে দিতে হচ্ছে। চিতানির্গত ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে আসা চোখ মুছতে মুছতে সে কথাই বলছিলেন সীমাপুরীর বাসিন্দা নীতীশ কুমার। তিনি জানান, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দু’দিন আগে তাঁর মা মারা গিয়েছেন। কিন্তু কোনও শ্মশানে মায়ের দেহ দাহ করার জায়গা পাননি তিনি।


বাধ্য হয়ে দু’দিন বাড়িতেই মায়ের দেহ রেখে দিয়েছিলেন নীতীশ। নিজে এ দিক ও দিক চষে বেড়াচ্ছিলেন। কোথায় দাহ করা যায়, জায়গা খুঁজছিলেন। শেষমেশ একটি পার্কিং লটে গড়ে ওঠা অস্থায়ী শ্মশানে মা-কে চিতায় তোলার জায়গা মেলে। বৃহস্পতিবার সেখানেই মা-কে দাহ করেন তিনি। নীতীশ বলেন, ‘‘কোথায় না গিয়েছি। কিন্তু কিছু না কিছু কারণে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। চিতা জ্বালানোর জন্য কাঠ পাওয়া যাচ্ছে না বলেও শুনতে হয়েছে।’’
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শহিদ ভগৎ সিংহ সেবা দল’-এর প্রধান জিতেন্দ্র সিংহ শান্টি বলেন, ‘‘দিল্লিতে এমন দৃশ্য দেখতে হবে কেউ ভাবেনি। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কারও বয়স ৫, কারও ১৫, কারও ২৫। তাদের দাহ করতে হচ্ছে। সদ্য বিবাহিত অনেকের দেহও শ্মশানে আসছে। চোখে দেখা যাচ্ছে না।’’ তিনি জানিয়েছেন, সীমাপুরীর পার্কিং লটে গড়ে ওঠা অস্থায়ী শ্মশানে বৃহস্পতিবার বিকেলে ৬০টি দেহ দাহ করা হয়েছে। জায়গা না পেয়ে পড়েছিল আরও ১৫টি দেহ। কিন্তু গতবছর পরিস্থিতি এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না। সংক্রমণ যখন সর্বোচ্চে গিয়ে ঠেকে, সেই সময়ও একদিনে সর্বাধিক ১৮টি দেহ দাহ করতে হাত লাগিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
জিতেন্দ্র জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার একটি শ্মশানে ৭৮টি দেহ দাহ করা হয়েছে। জিতেন্দ্রর মা নিজে এক জন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী। ১০ দিন আগে কোভিডে সংক্রমিত হন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও হাসপাতালে জায়গা হয়নি বলে জানিয়েছেন জিতেন্দ্র। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সরকার কিছু করছে না। নিজের পরিবারকে নিজেকেই বাঁচাতে হবে। লড়াইটা যার যার একার।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.