বাম আমলের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হাল আমলে জেগেছে

২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিশেষ কিছু হোর্ডিংয়ে ছেয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজ্যটাকে। উত্তর কলকাতায় চোখে পড়ছিল বড়ো বড়ো হোর্ডিংগুলি। কেন্দ্রে তখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। উত্তর কলকাতায় বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই (এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিম। হোর্ডিংয়ের মূল বিষয় বাঙ্গলার সংস্কৃতির সঙ্গে এই আর এস এস-বিজেপিকে মেলানো যায় না। অতএব… বুঝতেই পারছেন, তথ্যাভিজ্ঞমহল সেদিন সেই হোর্ডিং দেখে মুচকি হেসেছিলেন। নেতাজী যাদের কাছে। ‘তেজোর কুকুর’, রবীন্দ্রনাথ ‘বুর্জোয় কবি, যারা ‘৬৭-তে নামমাত্র ক্ষমতায় এসেই রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালন বন্ধ করে দিয়েছিল গায়ের জোরে, যারা চিরটাকাল বিবেকানন্দকে ‘চাকরি না পেয়ে সন্ন্যাসী’, কিংবা রামকৃষ্ণদেবকে ‘মৃগীরোগী’ বলে এসেছে, যাদের সংস্কৃতির ধারক বাহকরা বিদ্যাসাগর, রামমোহনের মূর্তি ভেঙেছে। ‘বাঙ্গালি সংস্কৃতি নিয়ে তাদের প্রচার বিসদৃশ-ই লাগেনি, অশনি সংকেতটাও বাঙ্গালি সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল, যখন উর্দুভাষী মুসলমান এলাকায় গিয়ে সেলিম বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতেন।
কীরকম অশনি সংকেত জানেন? বাঙ্গলাকে, বাঙ্গলার মনীষীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে দেওয়া। বাম আমলে সান্ধ্যকালীন আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে অনেকে ‘রসুন’ সন্ধ্যা বলে অভিহিত করতেন। রসুন মানে রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত, নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে এরা হিন্দু, নজরলকে মুসলমান আর সুকান্তকে কমিউনিস্ট বলে দেগে দিতে চেয়েছিল। তিনটেই সত্যি, কিন্তু বাঙ্গলা ও বাঙ্গালির সংস্কৃতিকে বিভাজনের পন্থা এর মধ্যে দিয়েই দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল। পরবর্তীকালে মমতা ব্যানার্জির ‘হিন্দুদের রবীন্দ্রনাথ, মুসলমানদের নজরুল’-বাক্যবন্ধনীর প্রয়োগ স্রেফ বাঙ্গলায় বামপন্থীদের বিভাজনকামী সংস্কৃতির সাফল্যকেই তুলে ধরে। তাই আজ যখন বাম-তাত্ত্বিকেরা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার তত্ত্ব আনেন এবং বিজেপির বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি উসকে দেন, আর এস এসকে নিষিদ্ধ করার প্রাণপণ দাবি তোলেন ও এরাজ্যে বিজেপি- আর এস এসকে ‘ডেকে আনার জন্য তৃণমূলকে অহরহ গালি পাড়েন, তখন বোঝা যায় এদের নীতি—‘আক্রমণই আত্মরক্ষার মূল উপায়।
হ্যাঁ, আজকের বিলুপ্তপ্রায় রাজনৈতিক প্রজাতি বামেদের আত্মরক্ষার বর্মের প্রয়োজন nবৈকি! পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের এক মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির সম্বন্ধে বলেছিলেন :“অসভ্য, বর্বর দল। আরেক মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য : ‘দাঙ্গা করতে এলে বিজেপি আর এস এসের মাথা ভেঙে দেব। পশ্চিমবঙ্গে সেই মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বকালে দাঙ্গা- পরিস্থিতির আদৌ উদ্ভব হয়েছিল কি? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় গুজরাট দাঙ্গার জন্য এই মন্তব্য, তাহলে বলতে হয় গুজরাট তো গোধরার প্রতিক্রিয়া মাত্র। গোধরার নৃশংস হামলাবাজদের মাথা কী গুঁড়োতে চাইবেন তিনি? উত্তর হলো না।
এবার তবে কী বুঝলেন? ওই ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃত জনকদের চেনা গেল তো? ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পীঠস্থানকে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ বলতেন যিনি, তারই মুখে ‘বিজেপি অসভ্য, বর্বর’ শব্দগুলি গণতন্ত্রের পক্ষে কী নিদারুণ ভয়াবহতা সৃষ্টি করে, তা বোঝা যায়। আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত সেদিনও ছিল, তবে বামপন্থীদের সংগঠিত শক্তি তাকে সুপ্ত রেখেছিল, মমতার সংগঠন-হীনতা তাকে জাগিয়ে তুলেছে, এই যা! কেন্দ্র বিরোধী স্লোগানের ও জনক সিপিএম। তাদের রাজনীতির যুপকাষ্ঠে বলি হয়েছে বাঙ্গালিরা।
আজ বসিরহাটের সন্দেশখালির পরিস্থিতি সবাই দেখতে পাচ্ছেন। রাজনৈতিক সংঘর্ষ কিংবা ভেড়ি নিয়ে গোলমাল এইসব ছেলে ভুলানো কথা বলে মূল সমস্যা থেকে নজর ঘোরালে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হবে। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দুই চব্বিশ পরগনা, নদীয়ার বাংলাদেশ লাগোয়া বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে, বামফ্রন্টের ৩৪, তৃণমূলের ৮, এই বিয়াল্লিশ বছর ধরে হিন্দুদের ওপর চরম অত্যাচার হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা তাদের জমি জায়গা দখল করে তাদেরইনিজভূমে পরবাসী’করে ছেড়েছে। বাম আমলে হিন্দুদের ‘সেকুলারিজম’-এর ঠুলি পরিয়ে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। আজ তৃণমূল যে সংগঠিত মুসলমান ভোট পায়, বামেদেরও তাদের জমানায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এই ভোটে। কিন্তু আজকের সঙ্গে তফাতটা হলো সেদিন হিন্দুভোট সংগঠিত ছিল না। সেদিন হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক থাকলে তৃণমূলের থেকেও বামেদের শোচনীয় পরিস্থিতি হতো। আজ অবশ্য বামেরা অবলুপ্তির পথে, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত উভয় দিক দিয়েই।
বামেদের পাপের সীমারেখা অবশ্য টানা যায় না। সেই জন্মলগ্ন থেকে তারা মুসলিম লিগের দোসর, হবে না-ই বা কেন, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিচক্ষণতার অভাবে জন্মলগ্ন থেকেই পার্টির রাশ ভারত থেকে বিতাড়িত তাসখণ্ডের জেহাদিদের হাতে। স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা, চীন-পাকিস্তানের দালালি করা দলের হাতে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য শাসনের ভার পেলে, তাও দীর্ঘদিন ধরে দেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা যে বিপর্যস্ত হবে তা বলা বাহুল্য। তবে হ্যা, ন্যাৎসি-ফ্যাসিস্টদের মতোই এদের সংগঠিত অত্যাচারী শক্তি আগ্নেয়গিরির লাভা স্রোত সুকৌশলে সুপ্ত রাখতে পেরেছিল, মমতার জমানায় যা বেআব্রু হয়ে ভারতবর্ষের সবচেয়ে ক্ষতিকারক শক্তিটিকে চিনিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বামিত্রের কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.