ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে স্লোগান বিতর্ক নিয়ে পরিকল্পিতভাবে প্রচুর জলঘোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। যদিও সেকুলার প্রগতিশীলদের মূল অভিযোগ দুটি।
প্রথমত, “নেতাজী জন্মজয়ন্তীর সরকারি অনুষ্ঠানে কেন রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া হবে!” আমাদের রাজ্যে অতীতে যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, প্রায় প্রতিটি সরকারি অনুষ্ঠানে সরকারের পদাধিকারী বামপন্থীরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা লাল সেলামের মত রাজনৈতিক বাক্যবন্ধ ব্যবহার করতেন। বর্তমান আমলেও সরকারি অনুষ্ঠানে মা মাটি মানুষ জিন্দাবাদের মত রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহার করা হয়ে থাকে ঢালাওভাবে। মনে রাখতে হবে, গতকাল এই স্লোগান কোনো সরকারি কর্মসূচীর অংশ হিসেবে কোনো পদাধিকারী ব্যক্তি দেন নি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষ দিয়েছেন। রাজ্য সরকারের অন্যায় দুর্নীতি অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে যদি কিছু মানুষ গতকাল রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে থাকেন, বেশ করেছেন। অতীতে এভাবেই ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের প্রতিবাদে মানুষ বন্দে মাতরম স্লোগান দিত, অত্যাচারী প্রশাসনের প্রতিভূদের উত্যক্ত করা, সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই দিত। সেদিনও সরকারের দালালরা সেই স্লোগানের বিরুদ্ধে যুক্তি সাজাতো, আজও তাই করছে।
দ্বিতীয় অভিযোগ, সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে কেন ধর্মীয় স্লোগান দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে নাকি নেতাজীকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, বিগত এক দশক ধরে যে ব্যক্তি একাধিক সরকারি অনুষ্ঠানে, সরকারি পদাধিকারী হিসেবে বন্দে মাতরমের সঙ্গে এক নিশ্বাসে বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহার করে এসেছেন, এদিনের ঘটনায় তিনিই অপমানিত বোধ করছেন। আমরা জানি না এটা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মত একজন তুখোর ওরেটরের আগে একই মঞ্চে বক্তৃতা দিতে অস্বস্তিবোধ করার ইনসিকিওরিটির বহিঃপ্রকাশ কিনা। কারণ যুক্তি বলে, বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্লোগান প্রশাসনিক পদাধিকারী হিসেবে যত্রতত্র ব্যবহার করলে কারো সমস্যা যখন হয় না, তাহলে দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্লোগান জয় শ্রীরাম বললেও অপমানিত বোধ করাও উচিত নয়। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নেতাজী সেকিউলার তাতে সন্দেহ নেই, যদিও তিনি সেকুলারিজম বলতে আজকের সেকুলারদের মত বিশেষ সম্প্রদায়ের জুতো চাটাকে বুঝতেন না। ব্যক্তিজীবনে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন বিশ্বাসী হিন্দু। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ছিল, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতা নিয়ে তাঁর দীপ্ত মতামত আমরা সকলেই জানি। ইংরেজের জেলে বন্দী অবস্থাতেও তিনি হিন্দু উৎসব সরস্বতী পুজো পালন করেছেন, স্বাধীন পশ্চিমবাংলার স্কুলে স্কুলে যে সরস্বতী পুজো বন্ধ করার জন্য আজ কমিউনিস্টরা সদা উদগ্রীব। যদিও আজকের দিনে সুভাষচন্দ্রকে সেকুলার কমিউনিস্ট বানাবার জন্য একটা প্রোপাগাণ্ডা একাধিক মহল থেকে চালানো হয়। তাই এরকম প্রশ্ন কারো মনে আসতেই পারে: জন্মোৎসবে জয় শ্রীরাম স্লোগান শুনলে সুভাষচন্দ্র কী সত্যিই আপত্তি জানাতেন? আসুন দেখি।
“দেখ মা, ভারতে যাহা চাও সবই আছে– প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, দারুণ শীত, ভীষণ বৃষ্টি আবার মনোহর শরৎ ও বসন্তকাল, সবই আছে। দাক্ষিণাত্যে দেখি– স্বচ্ছসলিলা, পুণ্যতোয়া গোদাবরী দুই কূল ভরিয়া তর তর কল কল শব্দে নিরন্তর সাগরাভিমুখে চলিয়াছে– কী পবিত্র নদী! দেখিবামাত্র বা ভাবিবামাত্র রামায়ণে পঞ্চবটীর কথা মনে পড়ে, তখন মানসনেত্রে দেখি সেই তিনজন– রাম লক্ষ্মণ ও সীতা, সমস্ত রাজ্য ও সম্পদ ত্যাগ করিয়া, সুখে, মহাসুখে, স্বর্গীয় সুখের সহিত গোদাবরীতীরে কালহরণ করিতেছেন–আর এদিবে আমরা সাংসারিক দুঃখানলে নিরন্তর পুড়িতেছি।… দেখি, পুণ্যসলিলা জাহ্নবী সলিলভার বহন করিয়া চলিয়াছে– আবার রামায়ণের একটি দৃশ্য মনে পড়ে। তখন দেখি বাল্মীকির সেই পবিত্র তপোবন– দিবারাত্র মহর্ষির পবিত্র কণ্ঠোদ্ভূত পূত বেদমন্ত্রে শব্দায়িত– দেখি বৃদ্ধ মহর্ষি অজিনাসনে বসিয়া আছেন– তাঁহার পদতলে দুইটি শিষ্য– কুশ ও লব– মহর্ষি তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। পবিত্র বেদধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া ক্রূর সর্পও নিজের বিষ হারাইয়া, ফণা তুলিয়া নীরবে মন্ত্রপাঠ শুনিতেছে… রামায়ণে সমস্তই পবিত্র– সামান্য তৃণের বর্ণনা পর্য্যন্তও পবিত্র, কিন্তু হায়! সেই পবিত্রতা আমরা ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া আর এখন বুঝিতে পারি না।”
কটক থেকে মা প্রভাবতী দেবীকে চিঠিতে লিখছেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, সুভাষচন্দ্র বসু। এর পরেও যদি আপনার মনে হয় জয় শ্রীরাম বললে সুভাষ বোসকে “কলঙ্কিত” করা হয় তাহলে আপনি হয় আরবচাটা কমিউনিস্ট, অথবা “সেই পবিত্রতা ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া আর এখন বুঝিতে পারেন না”।
*
পৃ: ১৬-১৭। পত্রাবলী (১৯১২-৩২), সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড।
Diptarup Samyadarshi