আমাদের আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূলের সঙ্গে গভীর সম্বন্ধ স্থাপন করার মাধ্যমেই আমাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিভাকে পুনরায় প্রাপ্ত করা সুনিশ্চিত করা সম্ভব। ৫ আগস্ট ২০২০ অযোধ্যায় রামমন্দিরের আধারশিলা স্থাপিত হয়েছে। ভারতবাসী, ভারতীয় বংশজাত মানুষ এবং বিশ্বের সমস্ত ভারতপ্রেমিক এই চমকে দেওয়ার মত ঘটনাকে একটি সম্পদ রূপে দেখছেন। পুরুষ ও মহিলাদের একটি স্বপ্ন সত্য হল। কোন কিছু পাওয়ার ভাবনাটি স্পষ্ট ছিল, কারণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকা লড়াই সার্থক হল। সন্তোষ এবং আনন্দের অশ্রু অনেক মুখচ্ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অনেকের জন্য তো এটি একটি সিদ্ধিলাভের ঘটনা, কিন্তু, আসলে এর মাধ্যমে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল।
অনেকের কাছে মন্দির নির্মাণ কেবল একটি উদ্ঘাটন কার্যক্রম মাত্র। যদিও পরম্পরা এবং দর্শন বিষয়ে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ সামগ্রিক এবং অভিন্ন। ভারতে কখনও সামাজিক জীবন ও ধর্ম পৃথক ছিল না। বরং, ধর্মকে সমাজের পরিপূরক বলে মনে করা হয়েছে। ভারতীয় দৃষ্টিকোণে প্রত্যেক জীব স্বভাবতঃ দিব্য। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই দিব্যতাকে প্রকাশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, যার মাধ্যমে মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। প্রকৃতি, আন্তরিক ও বাহ্য সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে এই পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা ভারতীয়রা মানি যে, ব্যক্তির ক্ষমতা ও গুণ অনুসারে এই লক্ষ্য পূর্তির বিভিন্ন পদ্ধতি এবং সাধন হতে পারে এবং সমস্ত ধর্মকে প্রকাশ করার বহু পদ্ধতির মতই। আমরা এই পরম্পরার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, কারণ ভারত মাতার বিভিন্ন ধার্মিক পরম্পরা সম্বন্ধ বলা হয়। সেই সমস্ত পরম্পরা এখানে বিকশিত এবং সমুজ্জ্বল।
উবান্টু শব্দটি আফ্রিকার জুলু জনজাতির মধ্যে প্রচলিত একটি শব্দ যার অর্থ – ‘আমি আছি, কারণ, আমরা আছি’। এই বাক্যাংশ ভারতে ধর্মের অবধারণারও ভিত্তি। আমি, আমার পরিবার, গ্রাম, রাজ্য, দেশ, মানবজাতি এবং সমস্ত জীব, বৃহত্তর প্রকৃতির অংশ এবং সেই ভাবে পরস্পরের থেকে অভিন্ন। এই অংশগুলি মধ্যে পরস্পর সংঘর্ষ নেই, বরং সামঞ্জস্য রয়েছে। এদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা নেই, বরং এরা পরস্পরের পরিপূরক। মানবীয় জীবন সমস্ত শক্তির একটি সম্মিলিত রূপ। আমরা যা, আমরা তাই। মানবিক জীবনের অসংখ্য এককের মধ্যে একটি সমন্বয় প্রতিষ্ঠাই হল ধর্ম এবং এই সমন্বয়ের প্রয়াসই হল ধর্মের স্থাপনা।
প্রত্যেক দিন আর.এস.এস-এর লক্ষ লক্ষ স্বয়ংসেবকের হৃদয় থেকে উৎসারিত সঙ্ঘের প্রার্থনা আত্মা ও আধ্যাত্মিক আত্মার মধ্যে সমন্বয়ের মন্ত্র। জীবনের সামগ্রিক ভারতীয় দৃষ্টিকোণে লৌকিক এবং আধ্যাত্মিক পথে একই ভাবে এগিয়ে চলে। সবচেয়ে অধিক সময় ধরে সম্পন্নতাই ভারতীয় সভ্যতার পরিচয় ছিল। এখানকার সম্পদ ও আধ্যাত্মিক গৌরবের বিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাণিজ্য ও জ্ঞান লাভের আকাঙ্ক্ষায় বহু মানুষ দূর দূরান্তর থেকে ভারতবর্ষকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। অথচ ভারতের প্রচুর ধন, সম্পদ, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ভারত কখনও অন্য কোন মানব বসতি বা দেশের উপর আক্রমণ করেনি।
দীর্ঘ বাণিজ্যিক মার্গ অন্বেষণের পরে দূর দূরান্তর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে যুক্ত হয়ে আমরা কোথাও উপনিবেশ তৈরি করিনি। আমাদের বাণিজ্য জোর করে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, তাদের ধন সম্পত্তি লুটপাট করাও হয়নি। আমরা কখনও তাদেরকে পাল্টানোর বা তাদেরকে দাসত্ব শৃঙ্খলে বাঁধার চেষ্টা করিনি। বরং, সেই সমস্ত স্থানের আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির অনুঘটক রূপে কাজ করেছি। সেই সমুৎকৃষ্ট বিনিময়ের প্রমাণ আজও ভাষা, কলা, সাহিত্যের মধ্যে পাওয়া যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে মন্দির এবং সাংস্কৃতিক প্রথা দেখা যায়। সেই সমস্ত দেশের মানুষদের সক্ষম ও সমৃদ্ধ করে এমন বিনিময়ের মাধ্যমে দুই পক্ষেরই সমৃদ্ধি হয়েছে। এই বিনিময়কে ভারতীয় শাস্ত্রসমূহে মহালক্ষ্মী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা ‘ধনলক্ষ্মী’ ও ‘মহালক্ষ্মী’-র পূজা করি। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, আমাদের ঐহিক সম্পদ এবং উৎকৃষ্ট জীবনের গৌরবের মূল আমাদের ধর্ম বিষয়ক ধারণা। ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে সোমনাথ মন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার পূজার সময়ে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ উবান্টুর ধারণা স্পষ্ট করেছিলেন। তাঁর ভাষণের একটি অংশ প্রণিধানযোগ্য।
তিনি বলেছিলেন, “এই পবিত্র দিনে আমরা সোমনাথ মন্দিরের প্রাণ-প্রতিষ্ঠার থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং সমৃদ্ধিতে ভারতের প্রধানতা স্থাপনের ব্রত গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশ প্রাচীনকালে বাণিজ্যে অগ্রেসর ছিল। এখানে যা উৎপাদন হত তা সমস্ত জগতে রপ্তানি হত। আমাদের রপ্তানি আমদানির থেকে বেশি ছিল। এইভাবে ভারত ধনের দেশে রূপান্তরিত হয়েছিল। বিকশিত রাষ্ট্রে রাজ্যের কোষাগারে যে সোনা রূপা জমা আছে, ভারতে তেমন সোনা রূপা জমা হত মন্দিরে। সোমনাথ মন্দির তার উদাহরণ। আমার মতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা সেই দিন পূর্ণ হবে যেদিন আমরা সেই প্রাধান্য প্রাপ্ত করব এবং সোমনাথ মন্দিরকে ন্যায় প্রদান করতে পারব।”
রাম মন্দিরের ভূমি পূজনের অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্যে আর.এস.এস-এর সরসঙ্ঘচালক শ্রী মোহন জী ভাগবত তিনটি শব্দ উল্লেখ করেছেন, ‘আত্মনির্ভরতা/আত্মনির্ভর, আত্মবিশ্বাস, আত্মবোধন’ (অর্থাৎ আত্ম জাগরণ)। আত্মনির্ভরতা বিষয়টিকে আমাদের জ্ঞান (ভারতীয় জ্ঞান– বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ই) এবং অর্থব্যবস্থার প্রসঙ্গে বলেছেন। রাম মন্দির নির্মাণ একটি দীর্ঘ সংঘর্ষের উৎসব এবং এক নবীন যাত্রার সূচনা।
মনমোহন বৈদ্য
আর.এস.এস.-এর সহ সরকার্যবাহ
2020-09-05