নাইজেরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত মার্চে বলেছেন, “আমার দেশে কোনাে কোভিড-১৯ রুগি নেই। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, ‘হাউ ইট ইজ পসিবল?” তিনি সহজ উত্তর দিলেন, ‘আমাদের কোনাে টেস্টিং যন্ত্রপাতি নেই, তাই কোনাে রুগিও নেই?’বাংলাদেশে কোনাে হিন্দু হিন্দু নির্যাতন হয় না। কারণ বড়াে বড়াে মিডিয়া বা ইংরেজি কাগজগুলাে তা প্রকাশ করে না। ছােটো ছােটো পত্রিকায় নির্যাতনের খবর মাঝে মাঝে বের হয়, তা কেউ আমলে নিতে চায় না। তাই, প্রশাসন, ধর্মীয় গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপােষকতায় প্রতিনিয়ত, ক্রমবর্ধমান হিন্দু বা অন্য সংখ্যালঘু নির্যাতন হলেও বাংলাদেশ একটি চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
দেশে হিন্দুরা প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছেন বা দেশে প্রকট সংখ্যালঘু সমস্যা আছে, তা সরকার বা বেশিরভাগ মুসলমান স্বীকার করেন না বা করতে চান না। স্বীকার করুন বা না করুন, সমস্যা তাতে উবে যাবে না। বরং ঘনীভূত হবে। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মানুষ ছলে-বলেকৌশলে দেশ থেকে হিন্দু বা অন্য সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের জন্যে সর্বদা সচেষ্ট। সংখ্যালঘুরা আগে ভাবতাে আওয়ামি লিগ বা শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় বা ভরসাস্থল। এখন তা ভাবে না। বরং বলে, সংখ্যালঘুর রক্তে সকল বড়াে বড়াে দলের হাত রঞ্জিত। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মােশারফ হােসেন ফরিদপুরের জমিদারের ‘দয়াময়ী’ হাউজ বা প্রাসাদ দখল করেন। ওই সময় আবদুল গাফফার চৌধুরী নিউইয়র্কে ছিলেন। তাকে একথা জানালে তিনি হেসে বলেন, ‘হিন্দুর জমি গনিমতের মাল’। তাই হয়তাে মুসলমানরা বলে, হিন্দু থাকলে মেয়ে পাবাে, গেলে জমি পাবাে।
বাংলাদেশের হিন্দু বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাঁচার উপায় কী? ১৯৪৭ সাল থেকে নির্যাতিত হতে হতে এঁরা এখন জীবন্মাত। পাকিস্তান বা আফগানিস্তান অনেকটা হিন্দুশূন্য। মহাভারতের ‘গান্ধার’ নামে দেশটি হচ্ছে আজকের আফগানিস্তান। দেশটিতে এক সময় সবাই হিন্দু ছিল। এখন হিন্দু হাতে গােনা। পাকিস্তানে হিন্দুর অবস্থা শােচনীয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে দেড় কোটি হিন্দু ছিল, মােট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা এখনাে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মােট জনসংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটি হয়েছে, হিন্দু বাড়েনি। এর তিনটি কারণ হতে পারে, এক, হিন্দুরা নপুংসক। দুই, হিন্দুদের মেরে ফেলা হয়েছে। তিন, তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। সরকার বা যে কেউ এই তিনটির একটিও স্বীকার করবেন না। তাহলে হারিয়ে যাওয়া হিন্দুরা কোথায়? মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কোনাে হিন্দুর ভারত যাওয়ার কথা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুদের সুখে-শান্তিতে বসবাস করার কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, সংখ্যালঘু হিন্দু সংখ্যাগুরু মুসলমানের অত্যাচারে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে বা এখনাে হচ্ছে। এটাই সত্য। সব মুসলমান অত্যাচার করেছে, বিষয়টি তানয়, তাদের একটি অংশ এবং শাসনযন্ত্র হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। এ দৃশ্যটি বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে হুবহু একইরকম, কারণও একই। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে হিন্দু থাকে কী করে?
হিন্দুরা ভারত যাও বা ভারত তােমাদের দেশ— এ বাণী শুনেনি এরকম হিন্দু বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনাে সরকারই চায়নি হিন্দু বা সংখ্যালঘুরা থাকুক। ডিজিটাল যুগে অবশ্য চাইলেও দুই কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে খেদানাে কঠিন হবে। থাকতে তাে হবেই, যাবে কই? ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে গিয়ে কী করবে? এখনাে বাংলাদেশে যত হিন্দু আছে, পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি দেশে তত মানুষ নেই। এত হিন্দু বা সংখ্যালঘুকে ভারতে ঠেলে দেওয়া যাবে না, মেরে ফেলা যাবে না বা ধর্মান্তরিত করা যাবে না। তাই, হিন্দুদের বাংলাদেশেই থাকতে হবে, বাংলাদেশের মাটি ধরেই উঠে সােজা হয়ে দাঁড়াতে হবে।
ছাত্রজীবনে আমরা স্লোগান দিয়েছি, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের লড়াই করেই বাঁচতে হবে।‘সারভাইবেল অব দিফিটেস্ট’
আমাদের প্রজন্ম হয়তাে এখনাে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। পরবর্তী প্রজন্ম তা বিশ্বাস না করলে কী তাদের দোষ দেওয়া যাবে? মাত্র চারশাে বছর আগে বঙ্গপ্রদেশে তেমনি কোনাে মুসলমান ছিল না। বঙ্গভূমি হিন্দুদের ছিল। বঙ্গভূমি তাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটা। সেই হিন্দুদের ‘ভূমিপুত্র’ অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করতে করতে এখন এমন এক জায়গায় এসে। দাঁড়িয়েছে, যে আর পশ্চাদপসরণের সুযােগ নেই। হয় মরতে হবে, নয়তাে লড়াই করে বাঁচতে হবে। এ বাঁচার লড়াই। যুগ পালটেছে, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতাে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হবে না। বরং যাঁরা আগে ভারতে গেছেন, তাঁরা যে ফিরে আসবেন না, এ গ্যারান্টি কোথায়?
শান্তি চাই। দেশের সব হিন্দুকে চিরদিনের জন্যে অত্যাচার করা যাবে না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একমাত্র সমাধান। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি প্রধান দিলীপ ঘােষের কাছে একজন প্রস্তাব দিয়েছেন, ভারত বাংলাদেশি হিন্দুদের দ্বৈত নাগরিকত্ব দিক। তাঁর মতে এতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন কমবে, হিন্দুদের মনােবল বাড়বে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য বা দেশ গঠনে ব্রতী হবেন, সমানভাবে দুই দেশে বসবাস করবেন এবং এতে উভয় দেশ লাভবান হবে। তিনি এও বলেন, বাংলাদেশ যদি ভারতের মুসলমানদের নাগরিকত্ব দিতে চান, তাও হতে পারে। দেশবিভাগ হয়ে বাঙ্গালি হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মুসলমানরা লাভবান হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দুরা ধ্বংসপ্রায়। তাই হয়তাে স্বর নীচু হলেও পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বিনিময়ের কথা মাঝে মধ্যে শােনা যায় বইকী! ঢাকা-দিল্লি সম্মত হলে কতকিছুই হতে পারে।
শিতাংশু গুহ
2020-08-24