যুদ্ধটা লেগেই গেল। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গত তিনমাস ধরে এ যুদ্ধ থামার কোন লক্ষণ নেই। যদিও এ যুদ্ধে কোন গোলাগুলি নেই, বোমারু বিমান নেই, ক্ষেপণাস্ত্র নেই, নেই সৈনিকের ভারী বুটের শব্দ। আছে শুধু হৃদয়ভেদী নিস্তব্ধতা, আছে মৃত্যুর নীরব মিছিল—কারণ এ যে নীরব যুদ্ধ! অঘোষিত “জৈব যুদ্ধ” (Biological War)। এ যুদ্ধে আজ অবধি (২৮/৩/২০২০) বিশ্বের প্রায় ১৯৯টি দেশ যুক্তযুদ্ধ একটি মারণ রোগের বিরুদ্ধে–একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে–যার নাম করোনাভাইরাস (Corona Virus)। এই ভাইরাসে আজ অবধি বিশ্বের ৫,৯৫,৯৫৩ জন আক্রান্ত—মৃত ২৭,৩৩২। চীন দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া এই অসুখটির নাম করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কোভিড-১৯ (COVID-19) আর ভাইরাসটির নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (Severe Acute Respiratory Syndrome) করোনা ভাইরাস-২ (SARS-CoV-2)।

মনে হচ্ছে বিজ্ঞানের চরম উন্নতির হাত ধরে বিশ্বের কতিপয় মদগর্বী দেশ ও তাদের দোসররা অচিরাচরিত যুদ্ধ বিলাসে মেতে উঠেছে আবার। কালে কালে দেশে দেশে বার বার যুদ্ধের নামে মানুষ ও প্রকৃতি হয়েছে ছিন্নভিন্ন। যুদ্ধে জিততেই হবে এই লক্ষ্যে একটাই দর্শন ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে‘। মানব সভ্যতা যত এগিয়েছে তত উন্নত হয়েছে যুদ্ধ প্রস্তুতি, উন্নততর হয়েছে যুদ্ধ প্রকরণের ধারা।

বেশ কয়েক বছর ধরেই জৈবযুদ্ধ (বায়োলজিক্যাল ওয়ার) এবং জৈব সন্ত্রাসবাদ (Bio-Terrorism) (বায়ো-টেররিজম) কথা দুটি আমাদের অপরিচিত নয়। বিশেষ করে এ শতকের গোড়ার দিকে যখন আমেরিকার মতো দেশ অ্যানথ্রাক্সের ভয়ে কুঁকড়ে গেল তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল ব্যাপারটা নিয়ে। প্রশ্ন জেগেছিল যখন ২০০২-এ চীন থেকে সার্স (SARS) ছড়িয়েছিল, ২০১২-তে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছড়িয়েছিল মার্স (MERS)। দুটি অতিমারীই (Pandemic) ছিল ভাইরাস সংক্রমণের ফল এবং ভাইরাসটি ছিল করোনাভাইরাস (Coronavirus)। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রতিটি করোনাভাইরাসে (Coronavirus) সংক্রমণই চীনে ঘটেছে, সঙ্গে আক্রান্ত বহু দেশ। প্রতিপক্ষের মানুষ, প্রাণী ও শস্য মেরে বা ক্ষতিসাধন করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা স্থিতাবস্থাকে ধ্বংস করতে বিভিন্ন মারাত্মক জীবাণু ও তাদের দ্বারা নিসৃত বিষকে যখন যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয় তখনই তা জৈবযুদ্ধে পরিণত হয়। আর এখন তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এই যুদ্ধাস্ত্রগুলিকেই তাদের সন্ত্রাস চালানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে ফলে প্রসার ঘটছে জৈব সন্ত্রাসবাদের।

গত জুলাই মাসে (২০১৯) কানাডার সংবাদ মাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর বিরল ঘটনা প্রকাশিত হয় যাতে অভিযোগ করা হয় যে ড. জিয়াঙ্গু কিউ (Dr. Xiangguo Qiu) সহ একদল চীনা বিজ্ঞানী কানাডার বিখ্যাত ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরিতে (NML) গুপ্তচর হয়ে প্রবেশ করে কিছু জৈব যুদ্ধাস্ত্র হাতিয়ে নিয়ে চীনে পাচার করে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য কানাডার ঐ ল্যাবরেটরি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানুষ ও প্রাণীর মারণরোগের জীবাণুগুলো নিয়ে কাজ করে।

বিশ্বের নানা বিজ্ঞানী সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে বর্তমান কোভিড-১৯-এর জন্য দায়ী করোনাভাইরাস (Coronavirus) চীনের একমাত্র চতুর্জৈথ স্বতরীয় সুরক্ষা গবেষণাগার (Level-Four Biosafety Laboratory, BSL-IV) হুহান (Wuhan)-এর ইন্সটিটউট অব ভাইরোলজি (Institute of Virology) থেকে তৈরী। এ তথ্য ফক্স নিউজ (Fox News)-এর মাধ্যমে প্রথম ব্যক্তিত্ব হিসাবে সবার সামনে আনেন আমেরিকার বিখ্যাত সেনেটর শ্রী টম কটন (Tom Cotton)। তিনি জোর দিয়ে বলেন এই ভাইরাস ঐ ল্যাব থেকেই উদ্ভূত। এছাড়াও, আমেরিকার বায়োলজিক্যাল ওয়েপন্স অ্যান্টি-টেররিজম অ্যাক্ট, ১৯৮৯ (Biological Weapons Anti-terrorism Act, 1989)-এর স্রষ্টা ড. ফ্রান্সিস বয়েল (Dr. Francis Boyle)-ও ঘোষণা করেছেন যে এই করোনাভাইরাসটি একটি আক্রমণাত্মক জৈবযুদ্ধাস্ত্র যা ডিএনএ-জেনেটিক এনজিনিয়ারিং(DNA-Genetic Engineering)-এর মাধ্যমে সৃষ্ট। তবে শ্রী টম কটন বা ড. ফ্রান্সিস বয়েল-কারোর মতামতই এখনও অবধি প্রমাণিত নয়। সঠিক তথ্যের জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই।

জৈব যুদ্ধের ইতিহাস

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যুদ্ধ জয়ের জন্য বহু শতক আগেই পারসিক, গ্রীক এবং রোমানরা অতি সংক্রামক রোগ সুকৌশলে ছড়িয়ে দিত বিপক্ষ শিবিরে মহামারী ঘটানোর উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন ইউরোপীয় যুদ্ধে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার (America) গৃহযুদ্ধে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ের যুদ্ধেও বিভিন্ন জৈব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। শত্রু শিবিরে খাদ্য ও জলের জোগান বন্ধ করে দিয়ে ভয়ঙ্কর সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে দেওয়া বহু দিন যাবৎ যুদ্ধ পরিকল্পনার অঙ্গ। তখনকার দিনে রোগ জীবাণু সম্বন্ধে বিস্তারিত না জানলেও সেই সকল রোগের মারণ ক্ষমতা সম্বন্ধে তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল তাই বহু ক্ষেত্রেই প্লেগ ও গুটি বসন্তে আক্রান্ত মৃতদেহগুলিকে তারা দুর্গপ্রাকার বা শহরের উঁচু দেওয়াল পার করে ভিতরে ফেলে দিত। ফলে মহামারী ছড়িয়ে যেতে সময় লাগতো না। যুদ্ধ জয় হত সহজতর।

ইংল্যাণ্ড (England), জাপান (Japan) প্রভৃতি যে দেশগুলি আজ জৈব যুদ্ধের বিরুদ্ধে এত সরব তাদের কয়েকটি কৃতকর্মের উল্লেখ করা যেতে পারে। আমেরিকার (America) রেড ইণ্ডিয়ানদের উপর প্রভুত্ব করার বাসনায় ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক স্যার জেফ্রে আমহার্স্ট (Sir Jeffrey Amherst) কোন এক চুক্তি মোতাবেক তৎকালীন রেড ইণ্ডিয়ান (Red Indian) সর্দারদের কাছে ভয়ানক স্মল পক্সের জীবাণু দূষিত অনেক কম্বল ও রুমাল পাঠিয়েছিলেন তার অফিসার মারফৎ। সরলচিত্তে তা গ্রহণ করে বিতরণ করার অব্যবহিত পরেই সেই রোগ রেড ইণ্ডিয়ান (Red Indian) উপজাতিদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল এবং নিয়ে গেল ষাট লক্ষ মানুষের জীবন। হায়রে বৃটিশ যুদ্ধনীতি!

আধুনিককালে ভয়ঙ্কর রোগ জীবাণুকে যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে জাপান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে ১৯৩১ সালে। এই কাজের জন্য তাদের অধিকৃত চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলের হার্বিন শহরে একটি কেন্দ্র স্থাপন করে। সেখানে প্লেগ, কলেরা, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড এবং অ্যানথ্রাক্স প্রভৃতি মহামারী সৃষ্টিকারী রোগের জীবাণু নিয়ে গবেষণা ও যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করার লক্ষ্যে বহু বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করা হয়। ঐ সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গিনিপিগ বানানো হয়েছিল চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দীদের। ফলে কম করে ১৫০০-২০০০ বন্দীর মৃত্যু হয়েছিল সেই সকল মারাত্মক রোগে। ১২টি চীনা শহরে ব্যাপক হারে ঐ সকল রোগের মহড়া দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐসব রোগ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে প্রায় ১৭০০ জাপানীও মরেছিল কারণ তারা বোতলের দৈত্যকে বার করতে শিখলেও তাকে আবার বোতলবন্দী করতে শেখেনি। নিজেদের সুরক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি ঠিকমতো জানা না থাকায় দুমুখো ফলার মতো ঐ রোগগুলি জাপানীদেরও ক্ষমা করেনি।

পরবর্তী সময়ে আমেরিকা (America) , বৃটেন (Britain) ও রাশিয়া (Russia) প্রভৃতি দেশও জৈব যুদ্ধাস্ত্র তৈরীর জন্য অনেক গবেষণা কেন্দ্র ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে। আর এখন তো প্রতিযোগিতামূলক ভাবে ইরান, ইরাক, ইস্রায়েল, উত্তর কোরিয়া, চীন, লিবিয়া, সিরিয়া, তাইওয়ান প্রভৃতি কম করে কুড়িটি দেশ নূতন নূতন জৈব যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করতে ব্যস্ত। একমাত্র দেশ ভারতবর্ষ (India) যেখানে কখনই এই কাজে উৎসাহ দেওয়া হয় না। তবে সম্প্রতি রাশিয়া সহ কয়েকটি দেশ অন্তত মুখে জৈব মারণাস্ত্র উৎপাদন থেকে বিরত থাকার কথা ঘোষণা করেছে।

বর্তমান জৈব যুদ্ধে ব্যবহৃত উপাদান সমূহ

ক। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস     

ব্যাসিলাস অ্যান্থ্রাসিস (Bacillus anthracis), ব্রুসেল্লা সুইস্ (Brucella suis) , কক্সিয়েল্লা বুর্নেটি (Coxiella burnetii) , ফ্রান্সিসেল্লা টুলেরেস্লিস্ (Francisella tularensis), ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস (Yersinia pestis) প্রভৃতি ব্যাক্টেরিয়া; স্মলপক্স (Smallpox) , ভাইরাল এনসেফেলাইটিস (Viral encephalitis), ভাইরাল হেমারেজিক ফিভার (Viral haemorrhagic fever) , হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (Human immunodeficiency virus) , ইবোলা (Ebola virus) , নীফা (Nipah virus), করোনা (Corona virus) প্রভৃতি ভাইরাস প্রভৃতি।

খ। বিষ

বটুলিনাম্ (Botulinum), রিসিন্ (Ricin), স্ট্যাফাইলো কক্কাল এন্টেরোটক্সিন বি (Staphylococcal enterotoxin B) ( SEB), কলেরা এন্ডোটক্সিন্ (Cholera endotoxin) , ডিপথেরিয়া টক্সিন্ (Diphtheria toxin) প্রভৃতি।

গ। শস্য বিনাশকারী উপাদান

রাইস ব্লাস্ট (Rice blast) , রাই স্টেম রাস্ট (Rye stem rust) , মেইজ রাস্ট (Maize rust) , হুইট স্টেম রাস্ট (Wheat stem rust) প্রভৃতি।

জৈব যুদ্ধাস্ত্র কেন সন্ত্রাসবাদীরা বেছে নিচ্ছে?

১। সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছান যায়

আগে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছি। পরে আরও কয়েকটি ঘটনার থেকে বোঝা যাবে কত সহজে আপাত নিরীহ পদ্ধতিতে উদ্দীষ্ট শত্রুকে মৃত্যুবাণ পাঠান যায়।

একটি ছাতার বাটে ছোট খাঁজ কেটে সেই খাঁজে তীব্র বিষ রিসিন ভর্তি ১.৭ মিমি ক্ষুদ্র মাদুলি আটকে সেই ছাতা রাশিয়ার কেজিবি লণ্ডনে পাঠিয়েছিল এক বুলগেরিয়ান ডিফেক্টর জর্জি মারভককে মারতে। মাদুলির মুখ মোম দিয়ে আটকানো ছিল। ছাতাটি ব্যবহার করতে গিয়ে শরীরের তাপে মাদুলির মোম গলে তীব্র বিষ ঐ হতভাগ্যের সংস্পর্শে আসে ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। এই পদ্ধতি ১৯৭৮ সালে ভ্লাদিমির কাস্তভকে মারার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছিল কিন্তু তা সফল হয়নি। তবে ঐ একই ধরনের অস্ত্রে রাশিয়ায় (Russia) ছয় জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় (Africa) কালো মানুষদের নিধন যজ্ঞেও এ পদ্ধতিকে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

কখনও বিকৃত মস্তিষ্কের সাম্প্রদায়িক লোকেরা জৈব অস্ত্রগুলিকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে স্বার্থসিদ্ধির জন্য। রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে ১৯৮৪ সালের ২৯ আগষ্ট আমেরিকার (America) ডালাস (Dallas) শহরে দুজন স্থানীয় কমিশনারকে রজনীশ অনুগামীরা সাল্মোনেল্লা টাইফিমুরিয়ান দ্বারা দূষিত জল পান করিয়ে মারাত্মক অসুস্থ করে দেয়। পরের মাসেই ঐ শহরের দশটি রেস্তোরাঁতে ঐ একই জীবাণু দ্বারা দূষিত স্যালাড বারের মাধ্যমে ৭৫১ জনকে ভয়ঙ্কর আন্ত্রিক রোগে আক্রান্ত করে। তাদের মধ্যে ৪৫ জনের অবস্থার অবনতি ঘটায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। রজনীশ ভক্তরা একটি ওষুধ সরবরাহ সংস্থার থেকে ঐ জীবাণুর কালচার অনায়াসে সংগ্রহ করেছিল এবং সহজেই ছড়িয়ে দিয়েছিলো স্থানীয়দের মধ্যে দ্বিধা ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করতে যাতে তারা পরবর্তী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে।

জৈব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে সিদ্ধহস্ত জাপানের (Japan) একটি সাম্প্রদায়িক সংস্থা আয়ুম শিনরিকিও, ১৯৯০-১৯৯৫ সালে বার বার জাপানে (Japan) সন্ত্রাস চালিয়েছে। কখনও পার্লামেন্ট হাউসের আশপাশে গাড়ির ইঞ্জিনের একজস্টের মাধ্যমে বটুলিনাম্ বিষ ছড়িয়ে (এপ্রিল, ১৯৯০), কখনও বা সেই বিষ বিশেষভাবে তৈরী গাড়ির মাধ্যমে টোকিও শহরে ছড়িয়ে দিয়ে জাপানের যুবরাজ নারাহিতোর বিবাহ অনুষ্ঠান পণ্ড করতে (জুন, ১৯৯৩)। ঐ জুন মাসেই চার দিন ধরে তারা এক বিশেষ স্প্রেয়ারের মাধ্যমে টোকিও শহরে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু ছড়িয়েছিল। ঐ সংস্থাটি আরও ঠিক করেছিল যে ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে টোকিও সাবওয়েতে এক বিশেষ ধরনের ব্রিফকেসের মাধ্যমে বটুলিনাম্ বিষ ছড়িয়ে দেবে গণহত্যার উদ্দেশ্যে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ বিষ না ছড়িয়ে সারিন্ বিষ ব্যবহার করে

সকলেরই মনে আছে কত সহজে বিভিন্ন প্যাকেটের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স স্পোর আমেরিকার (America) বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদীরা যার ফলে ফ্লোরিডায় ইনহেলেশন অ্যানথ্রাক্স ও নিউইয়র্কে কিউটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স দেখা দিয়েছিল (অক্টোবর, ২০০১)। তবে রোগের থেকেও সেই সব অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কিত হয়েছিল অস্বাভাবিক ভাবে। আর সেটাই ছিল সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য।

২। সহজ উৎপাদন

কোন গবেষণাগার থেকে গোপনে রোগজীবাণু সংগ্রহ করা বিশেষ কঠিন কাজ নয়। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সেই জীবাণুকে কে সংরক্ষিত রেখে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চোরাচালান করাও খুব কঠিন নয়। এসব ব্যাপারে সাধারণ ফিল্টার কাগজকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু বাজার চলতি যন্ত্রপাতি ও জীবাণুতত্ত্ব জানা দক্ষ লোকের প্রয়োজন যাৱা দরকার মতো সেই জীবাণু বা জীবাণু সৃষ্ট বিষ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করতে পারবে

৩। সহজ নাড়াচাড়া

সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি তাদের সদস্যদের সংক্রামক রোগ বা তার উপাদান ছড়িয়ে দিতে এবং এব্যাপারে ঝুঁকি নিতে অনুপ্রাণিত করে। আর যদি আগেভাগেই যথাযথ প্রতিষেধক টিকা নেওয়া যায় তবে তো কথাই নেই–নাড়াচাড়া করার ব্যক্তিগত ঝুঁকি আরও কমে যায়। তবে আত্মঘাতী বাহিনী তো তৈরীই থাকে জীবনের ঝুঁকি নিতে।

৪। খরচ কম, লাভ বেশী

জৈব যুদ্ধাস্ত্র তৈরী রাসায়নিক অস্ত্র তৈরীর থেকে অনেক কম খরচে করা যায়। কারণ জৈব উপাদান তৈরীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক খরচ বা পরিকাঠামোগত খরচ তুলনামূলক ভাবে অনেক কম এবং গোপনীয়তা বজায় থাকে অনেক বেশি।

৫। অতি গোপন ব্যবহার

কারও সন্দেহের উদ্রেক না করেই অন্তরাল থেকে জৈব উপাদানগুলিকে শত্রুপক্ষ ধ্বংসের কাজে লাগানো হয়। পানীয় জল, খাবার এমনকি বাতাসের মাধ্যমেও রোগের উপাদানগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু শত্রুপক্ষ টেরও পাবে না। ছড়িয়ে দেওয়া যায় সন্দেহের উর্ধ্বে থাকা কোন ব্যবহার্য বস্তুর মাধ্যমেও। রোগের প্রাদুর্ভাব হতে যে সময় লাগে তার মধ্যে অকুস্থল থেকে সন্ত্রাসবাদীরা পালিয়ে যায়, ফলে তা যে সন্ত্রাসবাদীদের কাজ তা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন ১৯৯৪ সালে আমাদের দেশে গুজরাটের সুরাট শহরে যে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল তার পিছনে সন্ত্রাসবাদীদের হাত ছিল বলে অনেক বিজ্ঞানীর সন্দেহ, কিন্তু তা প্রমাণ করা যায়নি।

৬। সহজ লক্ষ্যবস্তু

ঘন লোকবসতি অঞ্চল, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, প্রেক্ষাগৃহ, উপাসনাস্থল, এমনকি বৈঠকখানা পর্যন্ত যেখানে খুশি সন্ত্রাসবাদীরা জৈব উপাদান নিয়ে সন্দেহাতীত ভাবে পৌঁছাতে পারে।

৭। দ্রুত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া

বিমান প্রভৃতি দ্রুতগামী যানের সাহায্যে একদিনের মধ্যে ভয়ঙ্কর রোগের উপাদান পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে ফলে মহাবিপর্যয়ের হদিশ পাওয়া সাধারণ বোধশক্তির অগম্য। অতীতে রহস্যময় বার্ড ফ্লু, সার্স প্রভৃতি রোগ কীভাবে চীন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রুতগতিতে ছড়িয়েছিল কিংবা বর্তমান কোভিড-১৯ গত তিনমাসে পৃথিবীর ১৯৯টি দেশে কীভাবে ছড়াচ্ছে তা সকলেই জানেন

৮। বিভিন্ন রোগ উপাদান মিশ্রণের সুবিধা

রোগ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীদের দিশাহারা করার জন্য সন্ত্রাসবাদীরা প্রায়ই একাধিক রোগের জৈব উপাদান একসঙ্গে মিশিয়ে দেয় ফলে সঠিক রোগ বা জৈব বিষ নিরুপণে বিজ্ঞানীদের অনেকটা সময় লেগে যায় এবং সেই সুযোগে রোগের ব্যাপ্তিও যায় বেড়ে। চীনে কোভিড-১৯-এর উৎপত্তিস্থলেই হান্টাভাইরাসের প্রকোপ এই তত্ত্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

৯। সহজেই জনগণকে বিভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত করা যায়

রোগ সংক্রমণের খবর প্রকাশ হলেই সাধারণ জনগণ ভীষণ ভাবে বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে যা সামাল দেওয়া প্রশাসনের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে–কোন যুক্তিতর্কের তোয়াক্কা না করে প্লেগের সময় সুরাটের (Surat) জনগণ (১৯৯৪) বা অ্যানথ্রাক্সের ভয়ে আমেরিকার জনগণ (২০০১) কেমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন। সুরাটে তো প্রশাসন প্রায় ভেঙে পড়েছিল অবস্থার সামাল দিতে গিয়ে। আর এই ধরনের অরাজক অবস্থার সৃষ্টিই সন্ত্রাসবাদীদের মূল লক্ষ্য।

১০। শত্রুপক্ষের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন

আমরা এতক্ষণ মানুষের শারীরিক ক্ষতির দিকটাই দেখলাম। জৈব সন্ত্রাসবাদীরা সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ভয়ঙ্কর জীবাণু (যেমন ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক প্রভৃতি) প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে প্রাণী সম্পদ ও কৃষি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। শত্রুদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট ডেকে আনতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে।

১৮৪০ সালে আয়ারল্যাণ্ডে ভয়াবহ আলুর ব্লাষ্ট রোগের জন্য যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যার ফলে ৫ লক্ষ লোক অনাহারে মারা গিয়েছিলেন এবং আরও ৫ লক্ষ হয়েছিলেন দেশান্তরী এবং পরবর্তী এক শতক লেগেছিল সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শোধরাতে।

১৯৯৭ সালে হংকং-এ পাখির যে মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু) রোগ হয়েছিল তাতে ৬ জন মানুষও মারা যাবার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ লক্ষ হাঁস, মুরগী প্রভৃতি পাখি মেরে ফেলতে হয়েছিল।

আমাদের দেশেও মুরগীর মধ্যে বার্ড ফ্লু সংক্রমণ (H5N1) ২০০৬ সাল থেকে এখনও অবধি যেখানে যেখানে হয়েছে সেই সব অঞ্চলেই কোন মানুষ আক্রান্ত না হলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই মুরগীর মাংস ও ডিম না খাবার ব্যাপারে জনগণ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মারা হয় লক্ষ লক্ষ হাঁস-মুরগী–রোগের বিস্তৃতি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। মার খায় পোল্ট্রি ব্যবসা, ক্ষতি হয় আমাদের দেশীয় অর্থনীতির। আমাদের দেশে চলমান কোভিড-১৯-এর ছড়ানোর সঙ্গে মুরগীকে দায়ী করে যে গুজব ছড়ানো হয় তার ফলে জনগণ অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে মাংস ও ডিম না খাবার ব্যাপারে। ফলে মার্চ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভারতীয় পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।

এই রকম বহু দেশে বহু সংক্রামক রোগ ও প্রাণী ও মানুষকে পারস্পরিক সংক্রামিত করায় ও উভয়েরই মৃত্যু হওয়ায় রোগ ঠেকানোর তাগিদে লক্ষ লক্ষ প্রাণী হত্যা করে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে, হতে চেয়েছে মহামারীর কবল মুক্ত। বিনিময়ে সেই সকল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়েছে অতীব সঙ্গীন।

১৯৯৭ সালে এঁষো (ফুট আণ্ড মাউথ ডিজিজ) রোগের ফলে তাইওয়ানে যে শূকর মড়ক লাগে তাতে ৩৮ লক্ষ শূকর মারা যায় এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় কয়েক বিলিয়ন ডলার। এই মহামারীর জন্য তাইওয়ান অভিযোগের আঙুল তুলেছে চীনের দিকে যারা নাকি এই রোগকে চোরাপথে তাইওয়ানে ঢুকিয়ে দিয়েছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ধবংস করার জন্য। ২০০৩ সালে সার্স (SARS)-এর প্রভাবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার

জৈব যুদ্ধ পৃথিবীব্যাপী মানব সভ্যতার ধ্বংস ত্বরান্বিত করছে

চিরকালই সংক্রামক ব্যাধি পৃথিবী ব্যাপী মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য রিপোর্ট (২০১৭) অনুসারে বর্তমানে প্রতি বছর যে ৫৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় তার ৩২ শতাংশই মারা যায় বিভিন্ন সংক্রামক রোগে। আর ১৪০০-র অধিক যে সকল রোগ জীবাণু এখনও অবধি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার প্রায় ৬১ শতাংশই প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সংক্রমণ ঘটাতে পারে (অর্থাৎ জুনটিক প্রকৃতির)। যদিও দ্রুত কার্যকর উপযুক্ত ওষুধ ও টিকা আবিষ্কারের ফলে বহু প্রাণঘাতী মারাত্মক সংক্রামক রোগ থেকে মানুষ ও প্রাণীকুলকে বহুলাংশে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু নিত্যনূতন রোগ জীবাণুর আবির্ভাব, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি জীবাণুর ও কীটনাশকের প্রতি কীটপতঙ্গের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ শক্তি এবং পুরানো ও নিয়ন্ত্রিত রোগের নূতনভাবে আরও ভয়ানকভাবে ফিরে আসা জনস্বাস্থ্য ও প্রাণীস্বাস্থ্যের প্রতি এক অশনি সংকেত বয়ে আনছে। পরাজিত মৃতপ্রায় শত্রুর ফের ভীমবিক্রমে ঘুরে দাঁড়ানোর মতোই কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, পীত জ্বর (ইয়েলো ফিভার), ডেঙ্গু, ডিপথেরিয়া প্রভৃতি রোগের বিশ্বব্যাপী পুনরুত্থান এবং ছত্রাক ঘটিত রোগের প্রাদূর্ভাব আজ ভয়ানক ভীতির কারণ। আর উন্নত জৈব প্রযুক্তির সাহায্যে ভয়ঙ্কর জীবাণুর সংশ্লেষণ, নিরীহ রোগ জীবাণুকে মারক জীবাণুতে পরিবর্তন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে সক্ষম জীবাণুর যথেচ্ছ প্রচুর উৎপাদন এবং তীব্র জৈব বিষ উৎপাদনে জীবাণুর অধিক ব্যবহার করে বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করছে এবং প্রয়োজনমতো সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা চোরাচালানের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সমগ্র বিশ্বে, ত্বরান্বিত করছে নিখিল বিশ্বে মানব সভ্যতার অমোঘ মৃত্যু।

ডা. শিবাজী ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.