পূজার কদিন বাংলাদেশে

পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় দর্জিপাড়ার বাড়ির দোতলাতে বড়দাদুরা থাকতেন। ঠাকুমা তাদের বাঙাল বলতেন। বাঙাল মানে কি করতাছিস? কোথা যাস’—এ ধরনের কথা যারা বলে তাদের বুঝতাম। পরে যত বয়স বেড়েছে, পূর্ববঙ্গ, দেশভাগ, পূর্বপাকিস্তান, বাংলাদেশ শব্দবন্ধগুলির অর্থ স্পষ্ট হয়েছে। ষাটের দশকে শিয়ালদহ সাউথ সেকশন দিয়ে কলকাতায় কলেজে যাতায়াত করেছি, তখন স্টেশন চত্বর জুড়ে শতছিন্ন, নােংরা কাপড় পরা শীর্ণ মানুষগুলিকে দেখেছি; জেনেছি ওরা রিফিউজি, দেশভাগের বলি। ৭১-এ খান সেনাদের নৃশংস অত্যচার, মুজিবের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি ও “আমার সোনার বাংলা গান-বাংলাদেশ দেখার ইচ্ছেটা তখন থেকেই জাগছিল। যখন শুনতাম, কদিনের মুক্ত সীমান্তের সুযোগে পরিচিত কয়েকজন বাংলাদেশ ঘুরে এসেছে, তখন মনটা খুস খুস করত। সেই অনেকদিন ধরে পুষে রাখা গোপন ইচ্ছেটা পুরণের এবছরে একটা সুযোগ অনেকটা আকস্মিক ভাবেই এসে গেল। মাস তিন-চারেকের মধ্যেই পাসপোর্ট-ভিসা, কোথায় যাবো, কোথায় উঠবো— এসব ব্যবস্থা হয়ে গেল। অতঃপর ‘জয় মা বলে ভাসাও তরী’ পঞ্চমীর সকালেই বনগাঁ লোকাল ধরে আমরা চার বন্ধু—সুকেশদা, জয়রামদা ও অপূর্বদা রওনা হলাম। হরিদাসপুর সীমান্তে দু’পারের চেকপোস্টের কাজকর্ম সেরে বেনিয়াপোল থেকে বেলা বারোটা নাগাদ বাস ধরে পিরোজপুর। বাসে যতটা পথ এসেছি, চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। সত্যিই ‘সবুজে সাজানো দেশ’ আর অসংখ্য নদীনালা, খালবিল। মাঝে মাঝে গ্রাম। বেশিরভাগ টিনের চালাঘর। সামনের খোলা জায়গায় হাস-মুরগি, গোরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। যশোর, খুলনা, বাগেরহাট পেরিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বাস পৌঁছাল পিরোজপুরের নাজিরহাটে। পিরোজপুর আগেকার বরিশাল জেলারই একটা অংশ। সেখানে নেমে অটোতে যেতে হবে। শ্রীরামকাঠি গ্রামের শ্রীশ্রীপুরুষোত্তম মঠে। বাসস্ট্যান্ডে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আশ্রম থেকে কয়েকজন এসেছিলেন।
পঞ্চমীর সন্ধ্যায় মঠের প্রবেশদ্বারে যখন পৌঁছালাম, তখন অতিথি হিসেবে আরতি, শঙ্খ ও উলুধ্বনি এবং মালা পরিয়ে আমাদের বরণ করে নিলেন আশ্রমের মা-বোন ও ভাইয়েরা। পৌঁছানোর মুহূর্তে এরকম আন্তরিক আপ্যায়ন কখনও ভাবিনি। এক অনাস্বাদিত আনন্দে মন ভরে গেল। বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধা সেনানি চিত্ত সুতারের প্রেরণায় তাঁর অনুগামী সুনীল সন্ন্যাসী নিজেদের পৈতৃক তিনবিঘারও বেশি জমিতে এই আশ্রম গড়ে তুলেছেন। বেশ পরিপাটি করে সাজানো এই আশ্রম। মন্দির, মন্দিরের সম্মুখে প্রশস্ত খোলা জায়গা যেখানে সংকীর্তন, ধর্ম বা আলোচনা সভা হয়।
আবাসিকদের থাকার পৃথক ব্যবস্থা। মা-বোন ও অতিথিদের জন্যও। সবই মাটির ঘর, টিনের চালা। ঘরগুলো সব মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। আশ্রম গুরু সুনীল সন্ন্যাসীও এরকমই একটি ঘরে থাকেন। শুধূ অতিথিদের জন্য থাকার বাড়িটি পাকা। আশ্রমে এখন ১৪-১৫ জন যুবক রয়েছেন। বেশিরভাগই পড়াশোনা করছেন। এক-দুজন বাদ দিলে সবাই অবিবাহিত। গত ৫২ বছর ধরে এই আশ্রম চলছে। এখান থেকে পড়াশোনা করেছেন এমন সংখ্যা প্রায় হাজার খানেক। সমাজ জীবনে। প্রতিষ্ঠিত হলেও আশ্রমের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হৃদয়ের। পূজা উপলক্ষ্যে বিশেষত দশমীর দিনে সবাই আসেন। আশ্রমে যেমন সাজানো বাগান, ছোটো ছোটো পুকুর আছে, তেমনি আছে পোষ্য পাঁচ-ছ’টা কুকুর, খরগোশ, পায়রা, রাজহাঁস। এইসব পোষ্যদের দেখার ব্যবস্থা আছে। একটা বাঁধাধরা নিয়মে সারাদিন আশ্রমের কাজ চলে। আশ্রমিকদের উপর বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব আছে। পাঁচ হাজার বছরের হিন্দু বাঙ্গালির সংস্কৃতির যা আদতে ভারতীয় সংস্কৃতিরই নামান্তর, তারই আদর্শে আশ্রম জীবন পরিচালিত। পুজোর কদিনে সেটা আরও ভালোভাবে অনুভব হলো।
পরেরদিন অর্থাৎ ষষ্ঠীতে চা-পান সেরে আশ্রমকন্যা অমিয়াদি ও অপূর্বর্দার সঙ্গে ঘুরে দেখলাম। আশ্রমের বেলতলায় ঘটপূজা ও চণ্ডী পাঠ করে দুর্গাপূজার কল্পারম্ভ হলো। এখানে পূজারি ও পাঠক আশ্রমের আবাসিকরাই। প্রত্যেকেরই আশ্রম প্রদত্ত একটা নাম আছে। এদিন সকালে যারা পূজার সঙ্গে যুক্ত, তাদের এবং সেই সঙ্গে আমাদেরও আর একবার ধুতি ও ফল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হলো। আশ্রমের উদ্দেশ্য ও কার্যপদ্ধতি ও আগামীদিনে কী করার সম্ভাবনা আছে, তা নিয়ে সুনীল সন্ন্যাসী সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বললেন। আরও জানালেন, তার বয়স এখন ৭৫, তাই নতুনদের ওপর তাঁর ভরসা। আশ্রম পরিচালনায় ভারতের হিন্দুদের কাছেও তিনি সাহায্য প্রার্থী। দেখলাম, সারাদিন। ধরেই গৈরিক বসন পরিহিত এই প্রবীণ সন্ন্যাসী কোনও না কোনও কাজের তদারকিতে ব্যস্ত। যেটা লক্ষ্য করার মতো, এখানে পূজার মন্ত্র সংস্কৃত নয়— বাংলা, মূল সংস্কৃত গ্রন্থের কাব্যানুবাদ। আমরা শুনছিলাম। কোথাও কোনও তালভঙ্গ হয়নি। মূলানুগ। আর সব থেকে বেশি মন কেড়েছে মন্ত্রের মধ্য দিয়ে তাদের আকুতির প্রকাশ। মা আমরা দেশহারা, স্বজনহারা, নির্যাতিত, মা-মেয়েরা অরক্ষিত, মা মুখ তুলে চাও, সন্তানদের কৃপা করো, আবার অখণ্ড ভারত হোক।এই আকুতি, এই মর্মস্পর্শী প্রার্থনা, স্বদেশের অখণ্ডতার জন্য প্রার্থনায় আমাদের চোখও ঝাপসা হয়ে আসছিল। এমন বেদনভরা আর্তি পশ্চিমবঙ্গে দুর্লভ।
শ্রীরামকাঠী বাজারে পুজো দেখতে বেরোলাম। চারটি পুজো হয়েছে। আড়ম্বরের চাকচিক্য নেই— পবিত্রতার স্নিগ্ধতা আছে। স্টিমার ঘাটটাও এক ফাঁকে ঘুরে এলাম। নাম কালীগঙ্গা। বেশ চওড়া। আরও দুটি নদী এসে কালীগঙ্গাতে মিলে বিশাল আকার নিয়েছে। অষ্টমীরদিন সকালে নৌকা করে আশ্রমের লোকেরা নেচে-গেয়ে আনন্দ করে পূজার ঘট ভরে নিয়ে যায়। সেট যেমন দেখার তেমন উপভোগেরও। আমাদের সঙ্গীরা চা খাওয়ার জন্য একটা দোকানে নিয়ে গেলেন। সেখানে আশপাশের কয়েকটি দোকান থেকে কয়েকজন দেখা করতে এলেন। বিভিন্ন গল্প হলো। একটা বইয়ের দোকানে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ দেখে জিজ্ঞাসা করাতে ভালোই বিক্রি হয় বলে মালিক জানালেন। শ্রীরামকাঠি বাজার অবশ্য হিন্দুপ্রধান। বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন প্রায় ৯ শতাংশ। দেশভাগের সময় ছিল ২৮ শতাংশ। নিজেদের পৈতৃক ভিটে আঁকড়ে সাহসের সঙ্গে থাকাটাই হলো সেখানকার হিন্দুদের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ। যদিও তারা জানালেন, শিক্ষিত ও ধনী হিন্দুদের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দুদের অসংখ্য মঠ-মন্দির-আশ্রম রয়েছে। নিত্য পূজা ও নৈমিত্তিক যাগ-যজ্ঞ, ভজন-কীর্তন, পালাগান, শাস্ত্র পাঠ সবই হয়ে থাকে। দিনাজপুর জেলার হিলি থানার সাধুরিয়া গ্রামে শুধু মহিলারা বসে গীতা পাঠ শুনছেন—যিনি পাঠ করছেন, তিনিও মহিলা— এ দৃশ্য তো আমরা নিজের চোখেই দেখলাম। কিন্তু সমন্বয়ের বড়োই অভাব, সবাই বিছিন্ন দ্বীপের মতো অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। সংগঠনই যে হিন্দুদের সব থেকে বড়ো দুর্বলতা, সেকথা এদেশেও যেমন সত্য, সীমান্তের ওপারেও তেমন সত্য। আশার কথা, হিন্দু সংগঠিত হলে কী হতে পারে তার একটা আভাস এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুবক আশ্রমিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হলো। স্থানীয় বেশ কয়েকজন মানুষ দেখা করতে এলেন। আওয়ামি লিগের প্রাক্তন এমপি-র ভাই জনাব রহিম সাহেবও দেখা করতে এসেছিলেন। খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর সম্পর্ক কীভাবে আরও দৃঢ় হয় তা নিয়েও চর্চা হলো।
অষ্টমীর সকালে সুনীল সন্ন্যাসী ও আবাসিকদের সঙ্গে বিদায়পর্ব, আশ্রমের বিশাল বটবৃক্ষ তলে সকলের সঙ্গে ছবি তুলে এবং মন্দিরে গিয়ে মা দুর্গাকে প্রণাম করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। আমাদের সঙ্গে বাসস্ট্যাণ্ড পর্যন্ত বিদায় জানাতে এলেন আশ্রমের পরবর্তী প্রধান বিধানদা। নাজিরপুর থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে বাস পোঁছাল পদ্মা নদীর পাড়ে। এখানে নেমে পদ্মা পার হতে হবে। ওপারে এই বাস এজেন্সিরই আর একটি বাস আমাদের নিয়ে যাবে। সব ধরেই টিকিট। ট্রেনের প্লাটফর্মের মতো স্টিমারে ওঠারও বিভিন্ন জেটি। দেখলাম বড়ো বড়ো স্টিমার, ট্রলার, বাস শুদ্ধ একটা বার্জ। বিশাল চওড়া পদ্মা। গঙ্গার মতো ঘোলা জল— আসলে পদ্মাও যে গঙ্গা। সেই ছোটোবেলা থেকে পদ্মা নদীর নাম শুনছি। পদ্মার ইলিশ, গোয়ালন্দের ঘাট, স্টিমারের ভেঁপু, পদ্মার মাঝিমোল্লা—এমনিই সব কত কী! সেই পদ্মা আজ পার হবো। মনে বেশ একটা শিহরণ অনুভব করছি। এখন ভরা পদ্মা। অসংখ্য ছোটো বড়ো জলযান ভেসে আছে। এপার-ওপার, এদিক-ওদিক লঞ্চ যাচ্ছে। ফেরি সার্ভিস বেশ জমজমাট।
পদ্মা পার হতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগল। সারটা পথই স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে দেখতে এলাম।লঞ্চের হোটেলে আহারের ব্যবস্থা আছে। ঝালমুড়ি, চা বিকেচ্ছে। চা খাওয়া গেল। লঞ্চ চলছে। দূরে পদ্মার উপর ডবল ডেক সেতু তৈরি হচ্ছে— রেল ও সড়ক দুটো পথই হবে। যে স্টিমারে উঠেছি তাতে অবশ্য বেশি ভিড় নেই। লঞ্চ থেকে নামলাম মাওয়া ঘাটে। ঢাকা পৌঁছাতে বেলা দুটো বেজে গেল। সৈদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি (এখনে অটোকে বলে সিএনজি) ধরে টিকাটুলির হাটখোলা রোডে মহাপ্রকাশ মঠে। শ্রীশ্রী প্রভু জগবন্ধু এখানে পূজিত হন। পরিচয়পত্র দেখাতে আশ্রমের অধ্যক্ষ নীলাদ্রিবন্ধু ব্রহ্মচারী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। আশ্রমে সারাদিনই প্রায় হরিসংকীর্তন, নামগান চলছে।
ঢাকায় প্রদীপ্তই আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাল। সে ডাক্তারি পড়ছে। চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আমাদের এক বন্ধুর সূত্রে প্রদীপ্তর সঙ্গে পরিচয়। ঢাকায় প্রদীপ্তদের বাড়িও গিয়েছিলাম। কথামতো প্রদীপ্ত ওর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মঠে এলো। নীলাদ্রিবন্ধুজীর দেওয়া চা পান করে দুর্গা প্রতিমা দর্শনে বেরোলাম। প্রথমে গেলাম ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ও ভোলাগিরি আশ্রমের পূজামণ্ডপে। সেখান থেকে রামকৃষ্ণ মিশনে। ঢাকায় রামকৃষ্ণ আশ্রমের কথা অনেকবার শুনেছি। এবার দেখলাম। বেশ বড়োসড়ো আশ্রম। আমরা যখন এখানে, ভারতে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছেন। সেইসময়ই ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদীজী ঢাকার মিশনে স্বামী। বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত হলের উদ্বোধন করেছেন। প্রতিমা দর্শন ও ঠাকুর-মা স্বামীজীকে প্রণাম করে ঢাকা মিশনের বর্তমান অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। তিনি পূর্বপরিচিত। কলকাতায় বিবেকানন্দ পৈতৃক ভিটাতে মিশনের যে কেন্দ্র রয়েছে তিনি তার অধ্যক্ষ ছিলেন। স্বস্তিকার বহুদিনের পাঠক তিনি। স্বস্তিকা পূজা সংখ্যাটি দিলাম। সেদিন রাতে ও পরের দিন সকালে প্রদীপ্তর সঙ্গে শাঁখারি বাজার, তাঁতিবাজার, নাগিন্দা, স্বামীবাগে ইস্কনের মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা কালীবাড়ি, হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দির, মা আনন্দময়ীর আশ্রম, খামারবাড়ি, ধানমণ্ডি (বনানি)-র পূজা মণ্ডপে গিয়েছিলাম।
দক্ষিণ ঢাকা পুরনো শহর। রিক্সার দাপট। গলিঘুজি দিয়ে, কখনও বা শহরের প্রধান রাস্তা। দিয়ে, রিক্সায় বা হেঁটে চলেছি। শাঁখারি ও তাঁতিবাজারে রাস্তা সরু– উপর মাচা করে প্রতিমা বসানো হয়েছে। তলা দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা। রাস্তার দু’পাশেশাখার দোকান ছাড়া হবেক কিসিমের দোকানপাট। মনে হচ্ছিল, কলকাতার গঙ্গার ঘাটের দিকে কোনও রাস্তা দিয়ে চলেছি। কিন্তু কলাবাগান, খামারবাড়ি বা ধানমণ্ডির পূজাপ্রাঙ্গণ কলকাতার বড়ো পুজোমণ্ডপগুলির মতোই। ধানমণ্ডীর মণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে। মাইকে মন্ত্র পড়া হচ্ছে। অঞ্জলির ফুল ঝুড়ি করে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে মা-র চরণে দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে প্যাকেটে করে খিচুড়ি প্রসাদ বিলি করা হচ্ছে। আমরাও পেলাম।
ঢাকা শহরে এবারে ২৩৬টা পূজা হচ্ছে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা এবারে হাজার দুয়েক বেড়েছে। মোট সংখ্যা ৩০ হাজারের কাছাকাছি। পূজায় সরকার থেকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ পাহারারও ব্যবস্থা হয়েছে। তবুও বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকটা জায়গায় মূর্তি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে। পুজোর সরকারি স্লোগান— ধর্ম যার যার/ উৎসব সবার। বাংলাদেশে ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনাকালীবাড়ি, চন্দ্রনাথ ধামের মতো হিন্দুতীর্থগুলিকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রতিমা দর্শনের ফাঁকে দেখেছি ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্মারক। সেখানে সেদিন (৭ অক্টোবর, ২০১৯) স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকারের দাবিতে জমায়েত হয়েছে। অনেকটা আমাদের দেশের কমিউনিস্টদের মতো। যারা শুধু অধিকারটাই বোঝে— কর্তব্য নয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্মারক জ্যামিতিক আকারে কোথা রেখার আকার। অবশ্য মানুষের প্রতিমূর্তি দিয়েও বহু স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক রয়েছে। ঢাকার জিরো পয়েন্ট গোলাকার। সেই কেন্দ্রবিন্দু থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব মাপা হয়। ভাষা স্মারক দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল দেখতে গেছি। খানসেনাদের গুলিতে নিহত ছাত্র-অধ্যাপকদের স্মরণে স্মারক তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকরা নিজেদের রক্ত বিক্রি করে এই স্মারক বানিয়েছে। এখানে ভগবান বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য ও স্বামীজীর পূর্ণাবয়ব প্রতিমূর্তি রয়েছে। এই জগন্নাথ হলেও দুর্গা পূজা হচ্ছে। তবে ঢাকার বঙ্গভবন, জে এম সেন হল— এরকম অনেক কিছুই সময়াভাবে দেখা হয়নি।
পরেরদিন সকালে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেল। এখানেও কোতোয়ালির (থানা) পাশে নতুন তৈরি মহাউদ্ধারণ মঠে অতিথি হলাম। সেখানকার সভাপতি রাজুগোপাল বণিক সাদর অভ্যর্থনা জনালেন। বিকেলে গেলাম চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতে বিজয়া দশমীর প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে। মূল শহর থেকে সৈকত প্রায় ২০ কিলোমিটর দূরে। শ’খানেক লরি প্রতিমা নিয়ে জড়ো হয়েছে। সৈকতে আসার পথে নেচে গেয়ে ডিজেবাজিয়ে যুবক-যুবতীদের আসতে দেখেছি। যৌবনের এই উত্তাল তরঙ্গ রুধিবে কে? যৌবন বোধহয় দেশকালের সীমারেখা মানে না। সৈকতে প্রায় লক্ষ লোকের মেলা। হিন্দু-মুসলমান সবাই। মেলাতে যেমন থাকে, এখানেও তেমন নানান সামগ্রীর দোকান। হাওয়ায় বুদবুদ বেরুনোর ফানুস থেকে মোবাইলের সিম— সবই বিকোচ্ছে। এরই মধ্যে শুনতে পাচ্ছি মেলা কর্তৃপক্ষের নানান ঘোষণা, সতর্কবাণী। আমাদের এখানে যেমন। আমরা যতটা পারি খুঁটিয়ে দেখার সব চেষ্টা করছি। কেননা এমন সুযোগ কবে আবার পাবো তা জানি না। চট্টগ্রামের সমুদ্রে অবশ্য ঢেউ নেই—- শান্ত সমুদ্র। বেশ কয়েক শো নানা ধরনের জলযান সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। সৈকতে আসার পথে অনেক স্টিল ফ্যাক্টরি, পেট্রোলিয়াম পণ্যের গুদাম, বাংলাদেশের নৌ-বাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট দেখলাম। চট্টগ্রামে ৫০ শতাংশ হিন্দু। বাংলাদেশের বোধহয় সবচেয়ে বড় শহর। উঁচু উঁচু বাড়ি, হাল ফ্যাশনের নানান দোকান, মল, বাজার, লোকজন ও গাড়ির ভিড়—কলকাতাকে মনে করিয়ে দেয়। কল্যাণপুর-গাবতলি বাসস্ট্যান্ডে উত্তরবঙ্গের বাস ধরতে গিয়ে একই দৃশ্য ঢাকাতেও দেখেছি। বস্তুত সারা বাংলাদেশ জুড়ে হাইওয়ে, বড়ো বড়ো সেতু, হাইরাইজ বিল্ডিং তৈরির যেন ধুম লেগেছে।
বাংলাদেশের অনেক শহর, গ্রাম বা রাস্তাঘাটের নাম এখনও হিন্দুদের নামেই রয়েছে। সৈকত থেকে ফেরার পথে ৫২ পীঠের অন্যতম পীঠ মা চট্টেশ্বরীকে দর্শন করতে গেলাম। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মতো বড়ে মন্দির নয়। রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দির চত্বর। তার উপর মা-র মন্দির। বহুদিন ধরে এই মন্দিরের কথা শুনেছি, আজ দেখলাম। পণ্ডিত দীনদয়ালজীর কথা স্মরণে এলো। এক বৈঠকে বাংলাদেশের তীর্থক্ষেত্রের নাম জিজ্ঞাসা করাতে আমরা পশ্চিমবঙ্গের তীর্থক্ষেত্রগুলির নাম বলেছিলাম। তখন সামান্য ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঢাকেশ্বরী, চট্টেশ্বরী, চন্দ্রনাথ ধাম কী বাঙ্গলার তীর্থক্ষেত্র নয়? আমরা লজ্জায় মুখ নামিয়েছিলাম। আজ কিছুট হলেও সেই লজ্জা মুক্ত হলাম। মা চট্টেশ্বরীর নামে এই জেলার নাম চট্টগ্রাম।
পরদিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম শ্রীচন্দ্রনাথ ধাম দর্শনে। সীতাকুণ্ড হয়ে মন্দিরে উঠার পথ। পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ শিবের মন্দির। মন্দিরের প্রবেশ পথে তোরণ। তাতে লেখা— ‘জাতীয় মহাতীর্থ চন্দ্রনাথ ধাম, সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম। যাত্রা শুরুর আগে ডাবের জল খাওয়া গেল। পাহাড়ে উঠার জন্য দশ টাকা দিয়ে লাঠি ভাড়া নেওয়া হলো। পথের শুরুতে কয়েক মিটার পথ বাধানো হলেও বাকি পথই খাড়া চড়াই। অনেকটা অমরনাথে পিসুটপের মতো। ফারাক এই—এখানে খাড়া সিড়ি আছে, অমরনাথে নেই, পাহাড় ভেঙেই উঠতে হবে। দু’পাশের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, হাজারেরও বেশি খাড়া সিঁড়ি এঁকে বেঁকে উপরে উঠে গেছে। লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে উঠছি। আকাশে ভগবান ভানুর প্রচণ্ড প্রতাপ। ওই গাছগাছালি ঘেরা জায়গাতেও ঘামছি। বার দশেক বসেছি। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হলে আবার চলা শুরু করেছি। বেশ কিছু যুবককে দল বেঁধে উঠতে দেখেছি। ট্রেকিংয়ের পক্ষে এটা বেশ ভালো জায়গা। আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন এক সিলেটি পরিবার। স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাকে নিয়ে তিনি উঠছেন। একটা ঝরনা চোখে পড়ল। জল বেশ ঠাণ্ডা। মাঝে একটা দোকান দেখলাম। ডাব ও জলের বোতলের দোকান। অমরনাথের মতো এখানেও মুসলমানরাই এসবের মালিক।
একটু বসে আবার যখন চলতে শুর করলাম, তখন এগিয়ে আশপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছি সেখানে পথ দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটা ইটের পথ। গাড়ির চাকার ছাপ। যাত্রীদের ফেলে দেওয়া বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট দেখে সেই পথ ধরলাম। প্রায় মাইলখানেক একাকী হেঁটেছি। কেউ কোথাও নেই। চন্দ্রনাথের নাম জপ করতে করতে চলেছি। হঠাৎ দেখি দুজন যুবক সামনের দিকে থেকে আসছে। তারা বললে, আপনি ভুল পথে উল্টো দিকে। এসেছেন। কী করব ভাবছি। এমনই সময় একটা অটো আসছে দেখলাম। ওই যুবকরাই আমাকে একরকম ঠেলে অটোতে উঠিয়ে দিল। ড্রাইভার ভাড়া দাবি করলেন। বললাম, আমার কাছে বাংলাদেশি মাত্র তিরিশ টাকা আছে। যাহোক মিনিট পনেরোর মধ্যে যেখান থেকে উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেখানে এসে পৌঁছালাম। দেখি বাঁদিকেই সিঁড়ি উঠে গেছে। মন্দিরের চূড়াও দেখা যাচ্ছে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আবার শ’ খানেক সিড়ি ভেঙে মন্দিরের দুয়ারে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক লাগল। পাহাড়ের শীর্ষদেশে চন্দ্রনাথ শিবের মন্দির। মন্দিরে তখনও পূজারি রয়েছেন। মন্ত্রোচ্চারণ করিয়ে তিনি পুস্পাঞ্জলি দেওয়ালেন। কথায় কথায় মনের কথা— অখণ্ড ভারত কবে হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলেন। বললেন, এই পাহাড়ই স্বয়ম্ভুশিব চন্দ্রনাথ। মন্দিরের এইবিগ্রহ তার প্রতীক। প্রণাম করে মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম। মন্দির প্রাঙ্গণে কিছুক্ষণ বসলাম। সামান্য জলযোগও সেরে নিলাম। চারদিকের দৃশ্যগুলিকে ক্যামেরা বন্দি করলাম।
এবার আবার ফেরার পালা। নীচে নামতে হবে। নামার পথটা হলো আলাদা। একটা গুহার মতো আধো অন্ধকার পথ দিয়ে সিঁড়িগুলি নেমে গেছে। একটু গা ছম ছম করে। তবু ধীরে ধীরে নামছিও। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা জোর বৃষ্টিহয়ে গেল। অর্থাৎ এবার চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হবে। পাহাড়ি রাস্তা একেবারে পিচ্ছিল হয়ে গেল। পা একটু এদিক ওদিক পড়লেই পঞ্চত্ব প্রাপ্তির বেশি দেরি হবে না। খুব ধীরে সাবধানে একটা একটা করে পা ফেলে নামছি। এক একটা সময় কোথায় পা রাখবো ঠিক করতে পারছি না। তা চন্দ্রনাথ শিবই বোধ হয় জুটিয়ে দিলেন। একদল যুবক নামছিল। তাদেরই একজন বলল, আঙ্কেল, আমার হাতটা ধরুন। সেই-ইহাত ধরে ওই বিপজ্জনক জায়গাটা পার করিয়ে দিল। পেছন থেকে আরও একজন যুবক ধরেছিল। একবার সত্যি সত্যিই পিছলে পড়ে গেলাম। না, লাগেনি। তবে জামা-কাপড় কাদায় একশা হয়ে গেল। নীচে নেমে সীতাকুণ্ডের জলে হাত-পা,জমা-কাপড় ধুলাম। নীচে ভবানীমন্দির দর্শন করে ফের চট্টগ্রামে যখন ফিরলাম তখন প্রায় বেলা তিনটে। ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীরটা একটা বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু তা আর হলো না। কথামতো স্বস্তিকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি দেখা করতে এলেন। তিনি ঢাকার বাসিন্দা হলেও চট্টগ্রামের পৈতৃক পুজো বাড়িতে এসেছেন। অনেক বিষয় নিয়ে চর্চা হলো। শিলাইদহ ও পতিসরে রবীন্দ্রচর্চার জন্য গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানালেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাস্টারদা সূর্যসেনের জমি-জায়গা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা কারার জন্য কোনও কোনও মহল চেষ্টা করলে দেশের মানুষই তা রুখে দিয়েছে। সে দেশের আদালতও এই প্রয়াসকে নিন্দা করেছে।
কলকাতার মতো চট্টগ্রামের এক চায়ের দোকানে আমাদের ‘ডিপার্টিং টি স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলাতে তিনি হেসে ফেললেন। তবে সারা বাংলাদেশ জুড়ে কথায় কথায় ইংরেজি ভাষা বলার চল নেই। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, গাড়ির নাম ও নম্বর, সরকারি কাগজপত্র সব বাংলা ভাষায়। কিন্তু বাংলাভাষার যে দ্রুত ইসলামিকরণ হচ্ছে, একটু নজর দিলে সেটাও বেশ বোঝা যায়।
এবার ফেরার পালা। হিলি হয়ে ফিরবো। সুকেশদার পৈতৃক ভিটে দিনাজপুর জেলার সাধুরিয়া গ্রামে পৌঁছাতে প্রায় আটটা বেজে গেল। ঢাকা থেকে রাত দশটায় বাস ছেড়েছিল। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। গ্রামটিতে হিন্দুদের প্রাধান্য। সাদর আপ্যায়ন। সবাই সুকেশদার আত্মীয়। এক বছর বয়সে মায়ের কোলে চেপে এদেশে এসে ষাট বছরে সুকেশদার এই পৈতৃক ভিটেতে পদার্পণ। গ্রামের আত্মীয়দের বাড়িগুলিতে যাওয়া, বাজার ঘোরা, বাজারে আত্মীয়দের দোকানে আড্ডা ও চা খাওয়া হলো। কোজাগরী পূর্ণিমার আগের রাত। চাদের স্নিগ্ধ আলোয় চারদিক ভরে আছে। তবে কোজাগরীর রাত হিন্দুদের মনে নোয়াখালির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে বহু ধর্মীয় মঠ-মন্দির, দুর্গাপূজার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবু যেন আতঙ্ক কাটেনা। ঘরকা মুরগির মতন মনে হয়। মা দুর্গার কাছে তাই নিজেদের রক্ষার জন্য হিন্দুদের কাতর প্রার্থনা। ভারতের উপর নির্ভরতা। বস্তুত শক্তিশালী ভারতই যে। বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষাকবচ—এই অনুভব নিয়েই এবার পুজোয় বাংলাদেশ থেকে ফিরলাম।
বিজয় আঢ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.