মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার সকালে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ইরান যদি কোনও ভাবে আমেরিকার উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে, তা হলে ‘তছনছ’ করে দেওয়া হবে। রাতে আরও সুর চড়িয়ে তিনি নিশানা করলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা তথা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক আয়াতোল্লা আলি খামেনেইকে।
ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে কয়েকটি পোস্ট করেছেন মঙ্গলবার রাতে। একটিতে তিনি লিখেছেন, ‘‘নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ’’। এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘অসামরিক নাগরিক বা আমেরিকান সৈন্যদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ চাই না। কিন্তু আমাদের ধৈর্য ক্রমশ ভেঙে পড়ছে।’’ তবে সেই সঙ্গেই পোস্টে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আপাতত ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ‘নির্মূল’ করার জন্য তিনি কোনও পদক্ষেপ করবেন না। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা জানি যে তথাকথিত সর্বোচ্চ নেতা কোথায় লুকিয়ে রয়েছেন। তিনি একটি সহজ লক্ষ্য, কিন্তু সেখানে নিরাপদ। আমরা তাঁকে বার করে (হত্যা!) করব না, অন্তত আপাতত নয়।’’
ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাৎজ় মঙ্গলবার ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসির প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘‘প্রতিবেশী দেশের স্বৈরাচারী শাসকের কী চরম পরিণতি হয়েছিল, ইরান যেন তা মনে রাখে। সাদ্দামের মতো পরিণতি খামেনেইয়েরও হতে পারে।’’ ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার খামেনেইকে খুন করতে সক্রিয় ছিল বলে রবিবার রয়টার্স প্রকাশিত একটি খবরে দাবি করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদন জানানো হয়, ট্রাম্প তেল আভিভের ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তেহরানকে আত্মসমর্পণের বার্তা দিয়ে ট্রাম্প কার্যত ইজ়রায়েলের সুরেই হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘‘ইরানের আকাশ এখন আমাদের দখলে।’’ অন্য দিকে, নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন খামেনেইকে হত্যা করতে পারলেই তেল আভিভ-তেহরান সংঘাতের ইতি হবে।
তড়িঘড়ি জি৭ শীর্ষবৈঠক ছাড়লেন ট্রাম্প
ঠিক ছিল, মঙ্গলবার কানাডায় আয়োজিত জি৭ শীর্ষবৈঠকের দ্বিতীয় দিনেও হাজির থাকবেন তিনি। কিন্তু সফরসূচি কাটছাঁট করে মঙ্গলবার দুপুরেই ওয়াশিংটনে ফেরেন ট্রাম্প। যুদ্ধের প্রস্তুতির উপর নজরদারির জন্যই তাঁর এই তৎপরতা কি না, তা নিয়ে জল্পনা চলছে।
হোয়াইট হাউসের প্রেসসচিব ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছেন, পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতির জন্যই জি৭ সম্মেলনের সূচি সম্পূর্ণ না-করে ফিরতে হচ্ছে ট্রাম্পকে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জি৭ বৈঠক ছাড়ার আগে ট্রাম্প তেহরান থেকে সাধারণ ইরানি নাগরিকদের অন্যত্র সরে যাওয়ার ‘পরামর্শ দেন’। যদিও এর কোনও কারণ ওই পোস্টে উল্লেখ করেননি ট্রাম্প। তিনি লেখেন, “আমি যে ‘চুক্তি’তে ইরানকে সই করতে বলেছিলাম, তা ইরানের করে নেওয়া উচিত ছিল। কী লজ্জার বিষয়, মানুষের জীবন কী ভাবে নষ্ট হচ্ছে! সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ইরান পরমাণু অস্ত্র রাখতে পারে না। আমি বার বার বলেছি!” এর পরের বাক্যেই তিনি লেখেন, “প্রত্যেকের অবিলম্বে তেহরান থেকে সরে যাওয়া উচিত!”
যুদ্ধের হুমকি ভান্সেরও
এক ধাপ এগিয়ে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স মঙ্গলবার সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের বার্তা দিয়েছেন। এক্স পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘ইরান অসামরিক প্রয়োজনে ব্যবহারে জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করেছে, যা উদ্বেগজনক। এই সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও কোনও পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’’
শুক্রবার ‘চিরশত্রু’ ইরানের বিভিন্ন পরমাণু কেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে বিমানহামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলি বাহিনী। যার পোশাকি নাম ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। ওই হামলার নেপথ্যে আমেরিকার হাত দেখেছেন অনেকেই। ট্রাম্প সরাসরি ইজ়রায়েলের ওই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে সোমবার পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন সেনাঘাঁটিগুলির নিরাপত্তা জোরদার করতে সক্রিয় হয়েছে পেন্টাগন। মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের অধীনস্থ ‘নিমিৎজ় ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ’ (আদতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস নিমিৎজ় এবং তার সহযোগী কয়েকটি ডেস্ট্রয়ার এবং কর্ভেট শ্রেণির রণতরী) ওমান উপসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। ফলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের আশঙ্কা
রাষ্ট্রপুঞ্জ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) মঙ্গলবার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, ইজ়রায়েলি বিমানহানায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের নাতানজ় পরমাণুকেন্দ্র। আর তা থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। আইএইএ-র ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি জানিয়েছেন, অভিযানের পর থেকেই তাঁরা ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলির ‘উচ্চ রেজ়োলিউশন’ উপগ্রহচিত্র নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আর সেগুলি পরীক্ষা করেই প্রাথমিক ভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আইএইএ-র রিপোর্ট বলছে, হামলার ফলে নাতানজ় পরমাণুকেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ সেন্ট্রিফিউজ হলগুলিতে ‘সরাসরি প্রভাব’ পড়েছে। যার পরিণতিতে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। তবে ভিয়েনায় সংস্থার গভর্নর বোর্ডের বৈঠকের পরে গ্রোসি জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত নাতানজ়, ইস্পাহান-সহ ইরানের সবগুলি পরমাণুকেন্দ্রের বাইরের ‘বিকিরণের মাত্রা’ (রেডিয়েশন লেভেল) স্থিতিশীল রয়েছে। ওই দু’টি পরমাণু কেন্দ্রে ইরান বোমা বানানোর উপযোগী ইউরেনিয়াম পরিশোধনের কাজ চালাচ্ছিল বলে ইজ়রায়েলের অভিযোগ। গ্যাসীয় ইউরেনিয়াম নিঃসরণ ঘটলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর শঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন গ্রোসি।
নিহত ইরানের নতুন সেনাপ্রধানও?
সোমবার গভীর রাতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান আলি শাদমানি নিহত হয়েছেন বলে মঙ্গলবার দাবি করেছে ইজ়রায়েল। শুক্রবার শাদমানিকে এই পদে নিযুক্ত করেছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনেই। যদিও এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত ইরানের তরফে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইজ়রায়েলি হানায় মৃত্যু হয়েছিল ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (চিফ অফ স্টাফ) মেজর জেনারেল মহম্মদ হোসেন বাগেরির। এ ছাড়াও মৃত্যু হয় ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেন সালামি এবং ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম আলি রশিদের। প্রাণ হারান ইরানের ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানীও। তার পরেই শাদমানিকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন খামেনেই। তাঁকে সেনার ‘খাতম আল-আম্বিয়া’ কেন্দ্রীয় সদর দফতরের নতুন প্রধান হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইডিএফ-এর দাবি, খামেনেইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন শাদমানি।