তুমি কার কে তোমার?

তালিবান কবলিত আফগানিস্তানের থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দিল্লির প্রচেষ্টা ছিল একান্ত আন্তরিক। যাঁরা ফিরে এসেছেন তাদের মধ্যে কলকাতার দু-একজন বলেছেন,  ” এ তালিবান, সে তালিবান নেই। এরা অনেক মানব দরদী আর ভদ্র।” তার উওরে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসেছে, তাহলে ফেরার জন্য এতো উতলা হয়েছিলেন কেন? প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের জীবনের প্রয়োজনে অনেক কথাই বলতে হয়। কারো অসুবিধা বা বাধ্যবাধকতা বোঝা বাইরে থেকে অনুভব করাও সম্ভব নয়। তাই আলটপকা মন্তব্য করাটাও হয়তো অমানবিক হতে পারে।কিন্তু বাংলা সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ বড় অদ্ভুত আচরণ করছে। তাঁরা বর্তমান তালিবানের মহত্ব প্রচারে ব্যস্ত। 

ভারতের সভ্যতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিলো আফগানিস্তানের।  সেদিন আফগানিস্তান  ছিল উপগনস্থান কান্দাহার ছিল গান্ধার।  বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল বামিহান। আফগানিস্তানের বহুস্থানে মন্দির আর গুরুদ্বার। ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে উদ্ভূত সুফি ধর্মমতের বিকাশ হয়েছিল আফগানিস্তানে। ফারসি ভাষায় যে কবি আজও সারা পৃথিবীতে আদৃত, সেই সুফি কবি রুমির জন্মস্থান আফগানিস্তানের বাল্ক এলাকা। এই সব মুছে ফেলতে হবে। তালিবানের হাতে আর কিছুদিন দেশটা থাকলে এইসব কিছু, সব স্মৃতি মুছে যাবে। সাংস্কৃতিক ভাবে শুদ্ধ করে, মেয়েদের যৌনদাসী বানিয়ে দেশটাকে চিন বা অন্য কারো হাতে বেচে দিয়ে যাবে তালিবান। চিন সেখান থেকে লিথিয়াম,  তামার মতো মূল্যবান খনিজ তোলার ব্যবস্থা করবে।

কলকাতার সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ লেফট লিবারাল। পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় গনতন্ত্রের ময়দানে কমিউনিস্ট শক্তি লুপ্তপ্রায় হওয়ার  সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরে আসছে চেয়ারম্যান আর চিনের প্রতি ভক্তি। 

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যাতে ডেমোক্রেট বাইডেন জেতেন তার জন্য সমর্থনের বন্যা বয়েছিল বামেদের পক্ষ থেকে। ওদেশে বামপন্থী বঙ্গসন্তানদের  প্রায় সকলেই ট্র‍্যাম্পকে তাড়িয়ে বাইডেনকে আনতে মরিয়া ছিলেন। বাইডেন তার যথাযোগ্য পুরস্কার দিয়েছেন।  বিগত কয়েক দশকে ভারতের জন্য এতবড় ক্ষতি আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট করেন নি। বাইডেন যে কেবল অসহায় সাধারণ আফগানিস্থানবাসীকে তালিবান জল্লাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলেন তাই নয়, এই উপমহাদেশে  এক দীর্ঘস্থায়ী বিপদের সূচনা করে গেলেন। আমেরিকা আফগান মাটিতে ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা করেছে, রাস্তাঘাট বানিয়েছে তারপর দেশটাকে মধ্যযুগীয় বর্বরদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলেন। লিথিয়াম,  রেয়ার আর্থ মেটারিয়াল, তামা, সোনার অগাধ ভান্ডার আফগানিস্তান। চিন সহজেই এই সুযোগ নেবে। একটা “ফেলড স্টেটকে” নিজেদের তাঁবে রাখাটা স্বৈরতান্ত্রিক চিনের পক্ষে খুব সহজ হবে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরার গিলগিট-বাল্টিকস্থান ঘেষে আফগান-চিনের ৯১ কিলোমিটার ব্যাপী সীমান্ত। চিন যেমন পাকিস্তানের হাতে পরমানু প্রযুক্তি দিয়েছে, ঠিক তেমনই খনিজ সম্পদের বিনিময়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র দেবে তালিবানদের।

তালিবানের হাতে আফগানিস্তানের ক্ষমতা যাওয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলের নেতা নিলাম ইরশাদ শেখ সম্প্রতি প্রকাশ্যে  বলেছেন, তালিবানরাই পাকিস্তানের জন্য কাশ্মীর দখল করে দেবে। প্রকারান্তরে পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালিবান যোগাযোগের এ এক বড় স্বীকারোক্তি।  

বাংলাদেশের মাটিতেও উৎসাহিত হয়ে উঠেছে মৌলবাদ।  ঢাকার রাস্তা দখল করে সরকার বিরোধী সমাবেশ হয়েছে।

স্লোগান উঠেছে হাসিনা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে,  ” বুবুজান বুবুজান/ আপনি দিল্লির প্রডাকশন / আপনি ভারত মাতার প্রান/ আপনি দিল্লি চলে যান”।  হাসিনার অপরাধ উনি মূর্তিপূজা করতে দেন, ধান উঠলে বজরা দেবীর আশির্বাদ বলেন। তাই তিনি মুনাফির মানে ইসলামের বিরোধী।

উল্লেখ্য বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময় শিরাজ সিকদারের মতো বহু চীনপন্থী কমিউনিস্ট খান সেনাদের পক্ষে ছিলেন।

চিনের তথাকথিত “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সঙ্গে এবারের তালিবান অভ্যুত্থানের প্রভূত মিল আছে। মাও সে তুং বলেছিলেন, ” সামনে লম্বা লাফ”। গ্রেট লিপ ফরোয়াডের ধাক্কায় ততোদিনে হয়ে গেছে বিরাট মন্বন্তর,  মারা গেছেন প্রায় ৫ কোটি মানুষ।
এই বিপর্যয়ের পরে চিনের তৎকালীন শিক্ষিত, প্রবুদ্ধ আর মানবতাবাদী লোকেরা প্রতিবাদ করা শুরু করলেন। তাই চেয়ারম্যান বললেন, কেবল পুঁজিবাদের বিরোধিতা করলেই হবে না, যা কিছু পুরাতন মূল্যবোধ সব কিছুকে মুছে ফেলতে হবে। ১৯৬৬ থেকে টানা ১০ বছর এই অরাজকতা চলে। মাও সে তুং এর মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তখন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল গ্যাং অফ ফোর। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওয়ের সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী জিন কিন। হিংসা আর মাৎসন্যায়ের একেবারে চরম অবস্থা। চারজনেরই স্থান হলো হাজতে। তাদের গারদে ভরে নতুন চিন চলা শুরু করলো।
এবার তালিবানও প্রায় একই পদ্ধতি নিয়েছে। এবার কেবল বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙাতেই তারা থামবে না, দেশের যা কিছু পুরাতন ঐতিহ্যবাহী তাকেই ধ্বংস করতে হবে। গজনীর তোরন গুঁড়িয়ে দিয়ে তার সূচনা করেছে তালিবানেরা। এই নাশকতার শেষটাও ওইরকম কোন “গ্যাং অফ ফোর ” গোছের কিছুতেই শেষ হবে। কিন্তু তার আগে আমাদের ভারতবর্ষের কতটা ক্ষতি হবে সেটাই সবথেকে আশঙ্কার বিষয়।

জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.