ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধর ইতিকথা

সিপাহি বিদ্রোহকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহ, ভারতীয় বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ও ১৮৫৮ সালের গণ-অভ্যুত্থান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসন, একনায়কতান্ত্রিক ও বিমাতৃসুলভ আচরনের বিরুদ্ধাচারে শুরু এই বিদ্রোহ দমন করা হয় নির্মমভাবে। বহু নিরপরাধ নরনারী, শিশু বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। যার মধ্যে আলেম ওলামাদের অবদান অপরিসীম। ক্রমশ এই বিদ্রোহ গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে (অধুনা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উত্তর মধ্যপ্রদেশ ও দিল্লি অঞ্চল ) ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহকে গ্রেট ইন্ডিয়ান ইভেন্ট, সিপাহী বিদ্রোহ, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা স্বাধীনতার জন্য ভারতের প্রথম সংগ্রামও বলা হয়। মুলতঃ ইংরেজরা ১৬০৮-এ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বিচরণ শুরু হয়। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ হয় তাতে বাংলার নবাবের করুন মৃত্যু দিয়ে এই ভুখন্ডে অর্থাত্‍ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।
মূলতঃ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এই প্রায় ১০০ বছর ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার থাকে। এই মহাবিদ্রোহ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর সিপাহীদের বিদ্রোহ হিসাবে ১৮৫৭ সালের ১০ই মে মীরাট থেকে শুরু হয়েছিল।পরে তা গাঙ্গেয় উপত্যকা ও মধ্য ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিক্ষিপ্তভাবে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের স্থানে স্থানে সেই বিক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। সৈন্যরা তাদের ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল যদিও এই বিদ্রোহ অসফল ভাবে শেষ হয় ।
বিদ্রোহের কারণগুলি গোপন করা বা আলোকপাত না করে রাখা শক্ত এবং এনিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। বিদ্রোহের আগে ৫০,০০০ ব্রিটিশ সেনা নিযুক্ত ছিল এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারিতে ৩০০,০০০ সিপাহী কর্মরত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া বাহিনীকে তিনটি প্রেসিডেন্সি সেনাবাহিনীতে বিভক্ত করা হয়েছিল: বোম্বাই, মাদ্রাজ এবং বাংলা। এই সেনাবাহিনীর সাজসজ্জাও অঞ্চলভেদে পৃথক ছিল।
বেঙ্গল আর্মি রাজপুত এবং ভূমিহার ব্রাহ্মণদের মতো উচ্চ বর্ণের লোককে নিয়োগ করে । তারা ১৮৫৫ সালে নিম্ন বর্ণের তালিকা বাতিল করে দেয়। বিপরীতে, মাদ্রাজ সেনাবাহিনী এবং বোম্বাই সেনাবাহিনী “আরও স্থানীয়, বর্ণ-নিরপেক্ষ সেনাবাহিনী” ছিল যা “উচ্চ বর্ণের পুরুষদের পছন্দ করতো না”।
প্রাথমিক বিদ্রোহের জন্য বেঙ্গল আর্মিতে উচ্চ বর্ণের আধিপত্যকে কিছুটা দোষ দেওয়া হয়েছে।
তাদের পরিষেবার শর্তাবলীতে কিছু পরিবর্তন ছিল যা হয়ত বিরক্তির উদ্রেক করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্প্রসারণের সাথে সাথে সৈন্যরা বার্মার মতো কম পরিচিত অঞ্চলে এবং তাদের আগে প্রাপ্ত “বিদেশী পরিষেবা” পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করবে এমনটি আশা করা হয়েছিল।

আর একটি আর্থিক অভিযোগ ছিল যা সাধারণ পরিষেবা আইন থেকে উদ্ভূত, যাতে অবসরপ্রাপ্ত সিপাহীদের পেনশন অস্বীকার করা হয়েছিল । যদিও এটি কেবলমাত্র নব নিযুক্ত সিপাহীদের জন্যই প্রয়োগ করা হয়েছিল, তবুও পুরানো সিপাহীরা সন্দেহ করেছিল যে এটি ইতিমধ্যে চাকরিতে নিযুক্তদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে । এছাড়াও, বিমাতৃসুলভ ভাবে বেঙ্গল আর্মিকে মাদ্রাজ এবং বোম্বাই সেনাবাহিনীর চেয়ে কম বেতন দেওয়া হয়েছিল, যা পেনশন নিয়ে তাদের ভয় বাড়িয়ে তোলে।

বিদ্রোহকালীন পারিপার্শিক পরিস্থিতি:

প্রাথমিক ভাবে কোম্পানি-শাসিত অন্যান্য অঞ্চলগুলি (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, বোম্বে প্রেসিডেন্সি ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি) শান্তই ছিল।
পাঞ্জাবের শিখ রাজ্যগুলি ব্রিটিশদের সৈন্য সরবরাহ করে সমর্থন জোগায়।
বড় রাজ্যগুলির (হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, ত্রিবাঙ্কুর ও কাশ্মীর) পাশাপাশি রাজপুতানার মতো ছোট রাজ্যগুলিও বিদ্রোহ থেকে দূরে থাকে।
অযোধ্যার মতো কোনো কোনো অঞ্চলে বিদ্রোহীরা ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চূড়ান্ত দেশপ্রেমের নিদর্শন স্থাপন করে।

ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ, তুলসীপুরের রানি ঈশ্বরী কুমারী দেবী প্রমুখেরা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে লোকনায়কে পরিণত হন।
অন্যান্য প্রতিরোধী শক্তিশালী প্রধান নেতৃবর্গের মধ্যে ছিলেন নানা সাহেব, তাঁতিয়া তোপী, কুনওয়ার সিং ইত্যাদি সামন্ত রাজা ও সৈনিকেরা।

স্থিমিত ও ম্রিয়মান হয়ে যায় বিদ্রোহের আগুন।সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালে ভারতে কোম্পানি-শাসনের অবসান ঘটে, ব্রিটিশরা সেনাবাহিনী, অর্থব্যবস্থা ও ভারতীয় প্রশাসন পুনর্গঠনে বাধ্য হয়।
ভারত প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটেনের রানির শাসনের অধীনে আসে।

——//———//———-//————//————//

লেখক: সৌমিত্র সেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.