কলকাতা, ১০ মে (হি স)। উনিশ ও বিশ শতকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের সাক্ষ্য বহনকারী কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ১৩ নম্বর বাড়ি সংরক্ষণের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিলেন দ্বারকানাথ–কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র রাজীব গঙ্গোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে রাজীববাবু দলের বিশাল জয়  ও তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, “আমরা জানি বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে আপনি অত্যন্ত সচেতন। এই কথা মাথায় রেখে  তাই সাহস করে আপনার কাছে একটি আর্জি রাখতে চাই। 

উনিশ ও বিশ শতকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের সাক্ষ্য বহনকারী কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ১৩ নম্বর বাড়ির ইতিহাস আপনার অবশ্যই জানা তবে তা যে বর্তমানে প্রমোটারের হাতে চলে গিয়ে  আজ পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে সে সম্পর্কে আপনাকে হয়তো এখনও অবগত করানো হয় নি। ১৮৬১ সালে এই বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ঠাকুরদাস চক্রবর্তীর ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমী। শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘ ঐতিহ্য বহনকারী এই স্কুলটির প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য নাম কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, ডাঃ শান্তিরঞ্জন পালিত, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। প্রচলিত ধারণায়, রবীন্দ্রনাথের স্কুল জীবনের শুরুটা হয়েছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, কিন্তু বাস্তবে ১৮৬৫ সালে এই ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমীতেই রবীন্দ্রনাথের স্কুল জীবনের শুরু। ১৮৭২ সালে নবগোপাল মিত্র এই বাড়িতেই ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭২, এই বাড়িতেই নবগোপাল মিত্রের জাতীয় সভার অধিবেশনে রাজনারায়ণ বসু ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব : আস্তিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে’ শীর্ষক ঐতিহাসিক বক্তৃতাটি দেন। সেই সভার সভাপতি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এছাড়া ১৮৯০ সালে ১৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের  এই বাড়ির একতলার দক্ষিণ অংশে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়। বাড়ির দোতলার একাংশে ৬ জন আবাসিক নিয়ে চালু হয় স্কুলের ছাত্রীনিবাস। ১৮৯৭ সালে ছাত্রীনিবাস সহ স্কুলটি ৫৬ মির্জাপুর স্ট্রিটে একটি ভাড়া বাড়িতে উঠে গেলে তার জায়গায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’ কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়ি থেকে উঠে আসে। এবারে আসি এই ঐতিহাসিক বাড়ির বাসিন্দাদের কথায়। এই বাড়িতে বসবাস করতেন উনিশ শতকের নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব, সমাজসংস্কারক 
‘অবলাবান্ধব’ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও আধুনিক বাঙালি নারীর আর্কিটাইপ্‌ ডাক্তার 
কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁদের পরিবার।

দ্বারকানাথের মেয়ে বিধুমুখীকে বিয়ে করে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর পরিবার নিয়ে ঐ বাড়ির দোতলার উত্তর অংশে থাকতেন। এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অনন্যকর্মা প্রচারক, আসামের চা-কুলি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব রামকুমার বিদ্যারত্ন পরবর্তীকালে যিনি স্বামী রামানন্দ মহাভারতী নামে পরিচিত হয়েছিলেন। থাকতেন সীতানাথ তত্ত্বভূষণ, ভারত সভা’র সহ সম্পাদক কাদম্বিনীর মেজ ভাই বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু।

উপেন্দ্রকিশোর-বিধুমুখীর ছেলে-মেয়েরা, সুখলতা, সুকুমার, পুণ্যলতা, সুবিনয়, শান্তিলতা  তো বটেই এই বাড়িতে জন্মেছেন দ্বারকানাথ– কাদম্বিনীর চতুর্থ পুত্র প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় যিনি ভাগ্যক্রমে আমার পিতামহ। প্রভাতচন্দ্র তাঁর বাবা–মা’র দেশপ্রেমের উত্তরাধিকার নিয়ে পরবর্তীকালে বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক-সাংবাদিক। দ্বারকানাথ–কাদম্বিনীর আর এক সন্তান জ্যোতির্ময়ী গঙ্গোপাধ্যায়, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিসরের বাইরে বেশি লোকে মনে রাখেন নি তাঁকে, অথচ সাহিত্য জগতে বা নারীশিক্ষা, সমাজ সেবামুলক কাজে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

১৩ নম্বর বাড়িটার আজকের দৈন্যদশার দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এই বাড়িতে এক সময় কত স্বনামখ্যাত ব্যক্তির পদার্পণ ঘটেছিল. দ্বারকানাথ, 
উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের। রবীন্দ্রনাথ আসতেন এই বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে সুর নিয়ে আলোচনা হত, উপেন্দ্রকিশোর বেহালা বাজাতেন; রবীন্দ্রনাথ করতেন সেই সুরে সুর মিলিয়ে গান। অল্প দুর সিমলা থেকে আসতেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথের গান মাঘোৎসবে গাইবেন বলে। বিজ্ঞানের আজব আজব আবিষ্কারের কথা শোনাতে আসতেন বৈজ্ঞানিক অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়; আসতেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি একাধারে দ্বারকানাথের বিশিষ্ট বন্ধু আবার রাজনৈতিক গুরু। ওই বাড়িতে আসতেন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম আচার্য্য শিবনাথ, দুর্গামোহন দাশ ও ভুবনমোহন দাশ, বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

এই শহরের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাচীন এই বাড়িটার বড় বড় কলাম, খড়খড়ি যুক্ত জানালা, 
ঢালাই লোহার গ্রিল, কাঠের জাফরি ঢাকা বারান্দা আজ জীর্ণ, ধ্বংসপ্রাপ্ত. যে ‘নাটমন্দির’ 
একদিন রাজনারায়ণ বসুর ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ বক্তৃতায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তা এখন নিছক ইট পাথরের গাদা; ছাদ ভেঙে গেছে, স্তম্ভগুলি তার অর্ধেক ভাঙা। পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আগে এই বাড়ির যে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।হেরিটেজ কমিশন দ্বারা স্বীকৃত গ্রেড টু হেরিটেজ বিল্ডিংটির বিষয়ে কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এবং হেরিটেজ কমিশন কি এই আর একটু সচেতন হবেন না?

মাননীয়া, আপনার কাছে আমার সনির্বন্ধ আর্জি আপনি আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই বাড়িটিকে  সরকারী অধিগ্রহণের আওতায় এনে এটিকে যদি একটি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করেন তাহলে  আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শিকড় এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে; 
কলকাতাও তার বিশাল ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হবে না। আমি আশাবাদী আপনার মতো ঐতিহ্য সচেতন মানুষ এই বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন।“
 
Foto, link                                 
হিন্দুস্থান সমাচার/ অশোক

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.