অষ্টমীর ভাবনা

প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীতে নিত্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জন্মাচ্ছে এবং নিত্যই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কে তার হিসেব রাখে? কিন্তু তার মধ্যেও এক একজন মানুষ তার কর্মের গুণের আদর্শের ত্যাগ তিতিক্ষার দ্বারা জগতে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম, এমন এক মহামানব হলেন শ্রীকৃষ্ণ। মানুষের মধ্যে যেমন জৈবিক প্রবৃত্তি, তেমনি আছে তার মানবিক গুণ এবং ঐ মানবিক গুণে যখন সর্বোত্তম উন্মোচন ঘটে তখনই মানব দেবতার রূপান্তরিত হন। এমনি এক দেবতা হলেন শ্রীকৃষ্ণ। অসম্ভব, অলৌকিক, অনন্ত অসাধারণ কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য আমরা তাকে ভগবানম, পুরুষোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে থাকি। কিন্তু ভারত ভূমিতে নিজ জীবনে যা সম্পাদন করেছে, তা ভাবলে মাথা নত না করে উপায় নেই। যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে স্বীকার করেন না, যারা তাকে মর্ত মানব বা কল্প চরিত্র বলে উপহাস করেন, তাঁরা যদি তাঁর আদর্শ, কর্মকাণ্ড, চিন্তা, দর্শন প্রবৃত্তি কল্পনায় ভাবতে চেষ্টা করেন তখন অবশ্যই ভাববেন বর্তমান অসহিষ্ণু হিংসাদীর্ণ পৃথিবীতে তার আদর্শে প্রয়োজন আছে কিনা, আর তাকে যদি ভগবান ভাবতে পারেন তবে তো কথাই নেই।
পাশ্চাত্য দেশের মতো দিন ক্ষণ তারিখ দিয়ে ইতিহাস লেখার প্রবণতা কখনোই ভারত ভূমিতে ছিল না। আত্মপ্রচার বিমুখ সনাতন ধর্ম বিশ্বাসী ভারতীয় যেটুকু স্মরন রেখেছে, তা মহাকালের তিথি নক্ষত্র বিচার করে। সেই হিসেবে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে গভীর নিশীথে কংসের কারাগারে তার আবির্ভাব নিত্যান্ত অনাদরে অনাড়ম্বরে। নিভৃতে চলে গেলেন নন্দালয়ে, বাল্যে কৈশোর গোচরনকে করলেন জীবিকা। কৈশোরে প্রেম-প্রীতিধনে ধনী বৃন্দাবনের গোপপল্লীতে বর্ষণ করলেন যথার্থ প্রেমের মধুময় লীলা, ভাগবত মতে মাত্র দশ বছর আট মাস বয়সে বৃন্দাবন থেকে ফিরলেন কংস ভবনে মূর্তিমান মৃত্যু হয়, ভাবসম্পদে যারা সম্পন্ন তাদের দান করলেন অমৃত, আর রাক্ষসী দানবীয় বলে বলিয়ানদের হানলেন মৃত্যুর আঘাত।
বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর কর্মকাণ্ডগুলি দেখে নেওয়া যাক। মানুষের দুঃখবর্ধনকারী দুর্জন দানবদের তিনি দমন ও সংহার করলেন, উদ্দেশ্য নিপীড়িত মানবগণের সুখ শান্তি দান করা।
তাঁর কর্ম ও উদ্দেশ্য সকলের জন্য তিনি সাম দান দণ্ড ভেদ নীতির আশ্রয় গ্রহন করলেন যা আধুনিক বিশ্বে সমভাবে গৃহীত ও প্রযুক্ত।
তিনি ন্যায় অন্যায় সত্য মিথ্যার ঊর্দ্ধে থেকে সর্ব মানবের সুখ শান্তি ও মৈত্রীর ব্যবস্থা করলেন। এই বিষয়ে তিনি নিজের লোকেদেরও ক্ষমা করেন নি। স্বজন পোষণ ও স্বজন তোষণ নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দেন নি। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাকৃত অপ্রাকৃত শক্তির আশ্রয়ে তিনি সনাতন ধর্ম রক্ষক ও সংস্থাপক। লক্ষণীয় যে সকল দুষ্ট দানব ও দুষ্ট রাজাদের তিনি সংহার করেছিলেন তাঁদের ঘৃণাভরে নরকে পাঠান নি, তাঁদের প্রত্যেককেই স্বর্গলোকে ঠাঁই করে দিয়েছেন। এইজন্য তাঁকে ক্ষমা ও করুণার মূর্ত প্রতীক মনে করা যায়।
তাঁর বাল্য লীলা ভক্ত হৃদয়ে পুলক জাগায়, কৈশোরের বৃন্দাবন লীলা প্রেমিকের পরম ঐশ্বর্য। হিংসাময় কুরুক্ষেত্রে তাঁর অহিংসাত্মক অভিযান যে কোন রাজা বা নীতিজ্ঞ ব্যক্তির চিত্তে প্রেরণা দান করে তা সন্দেহ নেই। শ্রী গীতায় তাঁর জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির বার্তা মানব জীবনের এক দীপ্ত দিগদর্শন, যা জ্ঞানী, কর্মী ও ভক্তজনের জীবন পথের ধ্রুবতারা। তিনি গুণ ও কর্মানুসারে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র চারি বর্ণের সৃষ্টি করে সমাজের সুষ্ঠু কর্ম বিভাজন স্থাপনা করলেন। তিনি আশ্বস্ত করলেন – নিষ্কাম কর্ম কর, মোহ মুক্ত হতে পারবে। জ্ঞানীকে এক জ্ঞানে স্থিত হওয়ার উপদেশ দিয়ে তাঁকে স্থিত প্রজ্ঞ হওয়ার কথা বললেন। যোগীকে শান্ত চিত্ত হওয়ার জন্য যোগের সুকৌশল অবলম্বন করতে উপদেশ দিলেন। ভক্তকে বললেন আমাকে আশ্রয় কর, অন্তিমে আমাতে যুক্ত হতে পারবে। সর্বকালের সর্বধর্মের সকল মানবকে উদ্দেশ্য করে ধর্মপালন ও তৎসহ তাঁর প্রতি চিত্ত মন প্রাণ সমর্পণের উপদেশ দিলেন, তিনি বললেন তোমার বলতে যা কিছু আছে জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, গর্ব, অহংকার সবকিছু আমাকে অর্পণ কর, তোমাদের সকল ভার আমি বহন করব, আমি তোমাদের সব পাপ থেকে রক্ষা করব।
ভারতবর্ষে, আর্যশাস্ত্রে অসংখ্য মহৎ চরিত্রের সমাবেশ আমরা লক্ষ্য করি, এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ডঃ মহানাম ব্রত ব্রহ্মচারী যথার্থই বলেছেন যে ঐ সকল চরিত্রের মধ্যে একদিকে দাঁড়িয়ে আছেন যারা কর্মে বড়, পরাক্রমে মহান, শৌর্যে বীর্যে শ্রেষ্ঠ যেমন রাবণ, কংস, হিরণ্যকশিপু, শিশুপাল প্রভৃতি আর একদিকে আছেন যারা তপস্যায় বড়, সাধনায় মহান, ব্রাহ্মণ্যধর্মে গরীয়ান যেমন ব্যাস, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, নারদ প্রভৃতি। অপরদিকে এই উভয়কে ছাড়িয়ে শোভা পাচ্ছেন যাঁরা এই দুইয়ের মিলনে মহীয়ান, ক্ষাত্রবীর্যে অপরাজেয়, ব্রাহ্মন্য বীর্যে মহাঋষি যেমন ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, জনক প্রভৃতি এদের যেমন আছে বীরত্ব তেমনি আছে জ্ঞানের গৌরব, আর একদল আছেন যারা বিনয়ে নতশীর, চিত্তের অনুভূতিতে ভাস্বর প্রহ্লাদ, উদ্ধব, বিদুর প্রভৃতি। এদের সকলের উর্ধ্বে যিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত যার শৌর্যে কংস, শিশুপাল প্রভৃতি বীরগণ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন – ব্যাস, নারদ যার গুনগান – ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির যার ভক্ত – অর্জুন যার শিষ্য, আর যার রুপ ধ্যান করেন ধুব, প্রহ্লাদ প্রভৃতি। তিনি হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, নিজের উপমা তিনি নিজেই।
পরিশেষে মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলি – “ব্রজে যিনি গোপালক বৈশ্য, দ্বারকায় তিনি রাজ্যপালক ক্ষত্রিয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যিনি মহপদেশক গীতার উপদেষ্টা, ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূর্ত বিগ্রহ, রাজসূয় যজ্ঞে তিনিই ভৃঙ্গাঁর হস্তে পাদপ্রক্ষালক শূদ্র, চারিবর্ণের সমবায়ে সর্ববর্ণনাতীত পুরুষোত্তম” পরিশেষে জন্মাষ্টমী স্মরণে বলি – “যথাসূর্যকরে দূর হয় অন্ধকার, সেই কল্পতরু শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার – ত্বং কল্পতরুং প্রনমামি কৃষ্ণম্”।

দেবপ্রসাদ মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.