আমার চিদাকাশে তুমি জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ – সপ্তমপর্ব

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপ্রাঙ্গনে পার্থকে বলছেন – 

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।

আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।

হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেন শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকুল-প্রদীপ!সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভুতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর।

তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – 

প্রভু,   তোমার বীণা যেমনি বাজে

               আঁধার-মাঝে

               অমনি ফোটে তারা।

      যেন     সেই বীণাটি গভীর তানে

               আমার প্রাণে

               বাজে তেমনিধারা ॥

      তখন   নূতন সৃষ্টি প্রকাশ হবে

               কী গৌরবে

               হৃদয়-অন্ধকারে।

      তখন   স্তরে স্তরে আলোকরাশি

               উঠবে ভাসি

               চিত্তগগনপারে ॥

সেই আত্মাকে জানার জন্য পুনরায় ইন্দ্র বত্রিশ বৎসর প্রজাপতি আশ্রমে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করলেন। তারপর আবার এক  প্রাতঃকালে প্রজাপতি ইন্দ্রকে ডেকে বললেন , ” তদ্ যত্রৈতৎ সুপ্তঃ সমস্তঃ সম্প্রসন্নঃ স্বপ্নং ন বিজানাত্যেষ আত্মেতি হোবাচৈতদমৃতভয়মেতদ্ ব্রহ্মেতি ….”।

যখন এই আত্মা গভীর নিদ্রামগ্ন হন, সব ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হয় তখন তিনি সকল দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত হয়ে প্রসন্নতা লাভ করেন। এমনকি তিনি গভীর নিদ্রায় স্বপ্নও দেখেন না। ইনিই আত্মা। ইনি অমর ও অভয়।ইনিই ব্রহ্ম। 

অর্থাৎ ,প্রজাপতি ইন্দ্রকে সুষুপ্তির কথা বললেন।সাধারণত জাগ্রত অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি বহির্মুখী। যেন সবসময় তারা বাইরে কিছুর সন্ধান করতে থাকে। আবার যখন নিদ্রাবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি তখন দেহ নিষ্ক্রিয় হয় কিন্তু মন সক্রিয় থাকে। কিন্তু গভীর নিদ্রায় ,মানে সুষুপ্তিতে যখন আমরা স্বপ্নও দেখিনা , তখন আমাদের দেহ, মন , ইন্দ্রিয়, স্থির , নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। 

প্রজাপতি বললেন , “ইনিই ব্রহ্ম”। বেদান্ত বলছেন, আত্মা এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন। আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা, যিনি আমাদের মধ্যে রয়েছেন। আর ব্রহ্ম শব্দের অর্থ হল বৃহত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ , সর্বোচ্চ। যাঁর থেকে বড়, যাঁর থেকে মহৎ আর কিছুই নেই।  বস্তুতঃ , সেই সর্বচ্চো বস্তুটি কিরকম তা আমরা জানি না। কিন্তু সেটি সকলের থেকে পৃথক, স্বতন্ত্র একটুই জানি। তাই তো ব্রহ্ম কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। 

প্রজাপতি যখন বললেন,  “ইনিই আত্মা” তখন ইন্দ্রও সেটি মেনে নিলেন। পুনরায় ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে রাজবেশ ধারণ করে ফিরে চললেন। কিন্তু কিছু দূর মাত্র চলার পরেই , তিনি একটি ক্ষুদ্র প্রস্তরের সঙ্গে আঘাত পেলেন। অরণ্যের মধ্যে যন্ত্রণায় বসে পড়লেন। কিন্তু বহুকাল ব্রহ্মচর্য পালনের ফলে মনে ক্রোধ , দুঃখ কিছুই জন্মাল না। কিছু সময় পরে যন্ত্রণার উপশম হলে , তিনি বসে বসে দেখলেন গাছের কোটরে কয়েকটি পেঁচা ঘুমাচ্ছে। দিবালোকে পেঁচাক নিদ্রা দেবে এটাই স্বাভাবিক। ইন্দ্রর সেই নিদ্রিত পেচকদের দেখে মনে বড়ই  আশঙ্কা, সন্দেহ উদ্রেক হল। কি সন্দেহ?  সন্দেহ হল – ,” নাহ খল্বয়মেবং সম্প্রত্যাত্মানং জানাত্যয়মহমস্মীতি নো এবেমানি ভূতানি বিনাশমেবাপীতো ভবতি নাহমাত্র ভোগ্যং পশ্যামীতি। ” অর্থাৎ ,  ” তাহলে কেন সুষুপ্তিতে আমার কাছে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না ? এমন কি নিজেরও নয়। সেখানে আমিত্ব সম্পূর্ণ মুছে যায়।  আমার চারপাশ থেকে সকল কিছু অদৃশ্য হয়ে যায়।  এমন কেন হয়? ” 

প্রজাপতি কেন আবার এমন বললেন? ….. তাহলে একটা কথা বলি। 

শ্রীরামকৃষ্ণদেব যখন সমাধিস্থ হতেন তখন তাঁর বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণ লুপ্ত হত। দেহটায় কোনো প্রাণ চিহ্ন থাকত না। তাহলে এই সমাধি এবং সুষুপ্তি এর মধ্যে পার্থক্য কি? সমাধিতে আত্মজ্ঞান লাভ হয়।  সমাধিতে আমি আমার নিজস্ব স্বরূপ জানতে পারি। সমাধি ভঙ্গ হবার পরে এই বাহ্যিক অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার জগৎ সম্পর্কে যখন আমরা সচেতন হই , তখন দেখি আমি মুক্ত। এই মায়ার সংসারের প্রতি কোনো আসক্তি নেই। কামনা , বাসনা লুপ্ত হয়েছে। বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার জগতে প্রবেশ করেছে আমার মন ও মস্তিক। এ এক পরম আনন্দের অবস্থা। এমন অবস্থা প্রাপ্তি যোগীদের হয়। 

নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া

     স্মরণ করি,

বিশ্ববিহীন বিজনে বসিয়া

     বরণ করি;

তুমি আছ মোর জীবন মরণ

     হরণ করি।

তোমার পাই নে কূল–

আপনা-মাঝারে আপনার প্রেম

     তাহারো পাই নে তুল।

আচ্ছা সুষুপ্তিতে কি ঘটে? সুষুপ্তিতে সব অনুভূতি, সব অভিজ্ঞতা , সব বস্তু সাময়িকভাবে মুছে যায়। কিন্তু অবিদ্যা থেকে মুক্তি হয় না। জাগ্রত হলে আবার সেই সংসারে ভোগে ডুবে যেতে হয়। অজ্ঞানতার থেকে মুক্তি ঘটে না , এই জগতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায় না। সেই আসক্তি, ভয়, ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছোটা  – সুষুপ্তির পূর্বে যেমন ছিল ঠিক তেমনটি থাকে। সমাধি ও সুষুপ্তির মধ্যে এটাই পার্থক্য। 

সুতরাং, ইন্দ্র সেই কথা উপলব্ধি করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন , ” সুষুপ্তিতে আমরা সম্পূর্ণ মুছে যাই ও কোনো জ্ঞান লাভ করি না। সুষুপ্তি থেকে জাগ্রত হলে আবার সংসারে নিষ্পেষিত হই। তাই, এ কখনো আত্মা হতে পারে না। “….

উদয়শিখরে সূর্যের মতো

     সমস্ত প্রাণ মম

চাহিয়া রয়েছে নিমেষ-নিহত

     একটি নয়ন-সম–

অগাধ অপার উদাস দৃষ্টি,

     নাহিকো তাহার সীমা।

তুমি যেন ওই আকাশ উদার,

আমি যেন ওই অসীম পাথার,

আকুল করেছে মাঝখানে তার

     আনন্দপূর্ণিমা।

ইন্দ্র পুনরায় যজ্ঞ কাঠ নিয়ে প্রজাপতি আশ্রমে ফিরে এলেন। সন্ধ্যা আহ্নিক সম্পন্ন করে প্রজাপতি  ধ্যানে বসবেন। এমন সময় ইন্দ্রকে ভয়ার্ত , ঘর্মাক্ত , জিজ্ঞাসু হয়ে আসতে দেখে প্রজাপতি প্রসন্ন হলেন। তিনি ইন্দ্রকে প্রশ্ন করলেন, “মঘবন্ কি হল ? তুমি তো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছ। তুমি শান্ত চিত্তে তাই চলে গিয়েছিলে। কিন্তু কি কারণে আবার এমনভাবে ফিরে এলে?” ( এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি মঘবন্ হল ইন্দ্রের অপর একটি নাম।)

ইন্দ্র বললেন , ” নাহ খল্বয়ং ভগব এবং সম্প্রত্যাত্মানং জানাত্যয়মহমস্মীতি নো এবেমানি ভূতানি বিনাশমেবাপীতো ভবতি নাহমত্ৰ ভোগ্যং পশ্যামতি।… ভগবান , সুষুপ্তিতে আত্মা নিজেকে #আমি_এইরকম বলে বুঝতে পারেন না, যেমন জেগে থাকলে পারেন। মনে হয় তিনি যেন সম্পূর্ণ মুছে গেছেন। এই বিদ্যায় কিবা সুফল হবে? কি কল্যাণই বা হবে? “

প্রজাপতি ইন্দ্রের কথা শ্রবণ করে বললেন , ” মঘবন্ তুমি ঠিকই বলেছ। এমনই বটে। তবে তুমি আরও।পাঁচ আমার আশ্রমে ব্রহ্মচর্য পালন কর। ….”

এবারেও যখন ইন্দ্র ফিরে এলেন , তখন প্রজাপতি প্রসন্ন হয়েছিলেন। কারণ , শিষ্যের মধ্যে বারবার প্ৰশ্ন উত্থিত হলে তাকে জানার ইচ্ছে বলে। শিষ্য বারবার প্রশ্ন করলে আচার্য খুশি হন। জিজ্ঞাসা হল বুদ্ধির পরিচয়। শিষ্য বুদ্ধিমান হলে তবেই প্রশ্ন উত্তর, তর্ক বিতর্ক করে জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটায়। গুরু বোঝেন যে শিষ্য আরও জানতে চায়। এমন শিষ্যকে সাহায্য করতে পারলে আচার্যের আনন্দ হয়। 

এবার কিন্তু প্রজাপতি ইন্দ্রকে আগের মতো বত্রিশ বত্রিশ বৎসর করে নয় , বরং পাঁচ বৎসর সংযম পালন করতে বললেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে ইন্দ্র এখন প্রায় প্রস্তুত। ইন্দ্রের মন, মানসিকতা, মস্তিষ্ক সকল ক্রমে জ্ঞান লাভের যোগ্য হয়ে উঠছে। একশ এক বৎসরের ব্রহ্মচর্য পালনে ইন্দ্র দেবরাজ পদের অহঙ্কার পরিত্যাগ করে ক্রমে নির্মল , শুদ্ধ চিত্ত হয়ে উঠেছিলেন। 

তুমি প্রশান্ত চিরনিশিদিন,

আমি অশান্ত বিরামবিহীন

     চঞ্চল অনিবার–

যত দূর হেরি দিক্‌দিগন্তে

     তুমি আমি একাকার।

শঙ্করাচার্য বলছেন : আত্মজ্ঞান লাভ করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ , এ হতে অধিকতর বা উচ্চতর কাম্য বস্তু জীবনে কিছুই থাকতে পারে না , সেই কথা বোঝাতেই উপনিষদ উক্ত প্রজাপতি , ইন্দ্রের কথা বলেছেন। 

বাস্তবিক, ভারতীয় শাস্ত্রের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। ভারতীয় শাস্ত্র বলেন  :  তুমি অর্থ উপার্জন করতে চাও ? বেশ তো , কর উপার্জন। কিন্তু সেই সঙ্গে সর্বদা মনে রেখ এসব কিছু ক্ষণস্থায়ী। একটা সময় তুমি নিজেই উপলব্ধি করবে যে , তুমি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছ। বৈভব, রাজনৈতিক ক্ষমতা, পদমর্যাদা সবই থাকবে। কিন্তু কর্ম করেও ফল পেয়েও তুমি থাকবে নিঃস্পৃহ। ভোগ কর এই জেনে  যে, এসব চিরস্থায়ী নয় এবং এগুলো স্থায়ী শান্তি দিতে পারবে না। 

ইহ চেৎ অবেদীদথ সত্যমস্তি

ন চেৎ ইহাবেদীন্মহতী বিনষ্টিঃ।

এখানে যদি তাঁহাকে জানা যায় তবেই জন্ম সত্য হয়, যদি না জানা যায় তবে “মহতী বিনষ্টিঃ’, মহা বিনাশ। অতএব ব্রহ্মকে না জানিলেই নয়। 

শাস্ত্র বলেন , একমাত্র সেই ব্রহ্মজ্ঞান আত্মজ্ঞানই পারে সেই অখণ্ড আনন্দ দিতে যা চিরকাল তোমার থাকবে। তাই সব কিছু করেও আত্মজ্ঞান লাভ করাই আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত।

তখন   তোমারি সৌন্দর্যছবি,

               ওগো কবি,

               আমায় পড়বে আঁকা–

      তখন   বিস্ময়ের রবে না সীমা,

               ওই মহিমা

               আর যাবে না ঢাকা।

      তখন   তোমারি প্রসন্ন হাসি

               পড়বে আসি

               নবজীবন-‘পরে।

      তখন   আনন্দ-অমৃতে তব

               ধন্য হব

               চিরদিনের তরে ॥

আচ্ছা তারপর কি হল? আদৌ কি ইন্দ্র সেই পরম জ্ঞানের অধিকারী হলেন? 

ক্রমশঃ 

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.