বহু বাধা পেরিয়ে হীরক-জয়ন্তী বর্ষে স্বস্তিকা পত্রিকা

পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত সবদিক থেকে নিখাদ জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দু হিতৈষী পত্রিকা স্বস্তিকা ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ৭৫ বছরে হীরক জয়ন্তীবর্ষে পড়ল। এই উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রাদেশিক কার্যালয় কেশব ভবনের সভাগৃহে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। ৭৫ বছরে পদার্পণকে স্মরণীয় করা ছাড়াও আরও একটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ও এদিনের (২০/৮/২২) অনুষ্ঠান সূচিতে ছিল। সেটা হল বঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কাজের একটি ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ।

পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখা ১৯৩৯ সালে সেই পরাধীন ভারতে একটি নির্দিষ্ট আদর্শবাদী ভাবনার লক্ষ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর সময় না ছিল কোনও কার্যালয়‚ না ছিল কোনও নির্দিষ্ট শাখা স্থান। তবু অভাব ছিল না উৎসাহের। শ্রী গুরুজীর হাতে কলকাতায় শুভারম্ভের পর ১৯৪০ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে গার্ড অফ অনার দেওয়া থেকে ধীরে ধীরে সঙ্ঘে কাজ এগিয়ে চলে। পরবর্তী সময়ে সঙ্ঘ তার আদর্শকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকশিত করার প্রয়াস নেয়। সেই মতাদর্শকে বৃহত্তর জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদেই ‘স্বস্তিকা’র আত্মপ্রকাশ, কিন্তু বিগত ৭৪ বছরের (১৯৪৮-২০২২) সফরকাল তার খুব মসৃণ ছিল না। বিলিতি ভাবধারার পোষণ ও মুসলিম ভোটের ওপর ভর করে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাভোগ নিরঙ্কুশ করার লালসায় ভারতীয় বা হিন্দু ভাবধারার বিনষ্টিই ছিল তৎকালীন শাসকদলের চূড়ান্ত কর্মসূচীর অঙ্গ।


এর ফলে যুক্তিশীল অগ্ৰগতির পথ, সঙ্ঘ বা তার ভাবানুরাগী স্বস্তিকা উভয়ের কাছে, সর্বদাই ছিল কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু এত সব সমস্যা, অবহেলা, অর্থাভাব, অবমাননা, প্রতিহিংসামূলক আক্রমনের মোকাবিলা কীভাবে করা হয়েছিল? জন্মলগ্নের মুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত যে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রয়েছে, তা সম্ভবপর করার সঙ্গে জড়িয়ে কত মানুষের আদর্শ নিষ্ঠা, নিরলস শ্রম ও নির্যাতন সহ্য করার কাহিনি, সেসব সাধারণ মানুষের কাছে এতাবৎ অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। যুগপৎ যন্ত্রণাময় এবং মনুষ্য চরিত্র নির্মাণ তথা সমাজ পরিবর্তনের ধ্যেয়নিষ্ঠ কর্মকাণ্ডের বর্ণনা ছড়িয়ে আছে ওইদিন প্রকাশিত ‘ বাংলায় সঙ্ঘ কাজের ইতিহাস’ নামক মহামূল্যবান বইটিতে।

এমনই পরিস্থিতিতে স্বস্তিকা-র রজত জয়ন্তী বর্ষে ঋষিপ্রতিম সম্পাদক,
অকৃতদার ভবেন্দু ভট্টাচার্যের লেখার (পুরনো লেখাটি সঙ্ঘ-ইতিহাস গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত) উদ্ধৃতিই প্রমাণ করে এই পত্রিকার সামগ্ৰিক দূরদৃষ্টি ও অভ্রান্ততাকে‌। “পাশ্চাত্য ভাবধারা ও গান্ধীবাদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংমিশ্রণ পন্ডিত নেহেরুর চিন্তা ও মানসিকতা সম্যক ধাতস্থ নয়।শাসনব্যবস্থা‚ কূটনীতি নির্ধারণ, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রভৃতিতে তখনও তিনি ব্রিটিশ নীতির মুখাপেক্ষী। গান্ধীবাদী রসপুষ্ট মুসলিম তোষণ তখন তাঁর মাধ্যমে অভৃতপূর্ব পাক – তোষণ নীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে স্বভাবতই ভারতের প্রাণরসপূর্ণ জাতীয়তাবাদী ভাবধারা দেশ ও জাতির স্বার্থের প্রয়োজনেই যথাযোগ্য পথানুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছে”। দীর্ঘ ৫০ বছর আগে করা তৎকালীন রাজনৈতিক মূল্যায়নটি কি ২০১৪ অবধি অকাট্যভাবে মিলে যায় না?

এমনি বহু দূরদৃষ্টিপূর্ণ লেখা ও যুক্তিপূর্ণ ক্রমবিকাশের সত্য কথন নিয়েই সমৃদ্ধ বইটি। বহু মানুষই জানেন না দেশের প্রকৃত চিরন্তন ভাবধারার ইতিহাস। সেই ইতিহাস বারবার মানুষকে চাক্ষুষ করানোর জন্য কী নিস্বার্থ পরিশ্রমই করেছিলেন সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা। এই বইটির ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দুত্বের সনাতনী ভাবনাকে পুনরুদ্ধার করার মরনপণ সাধনার কথা।

এই যুগ্ম অনুষ্ঠানের দিন বাইরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল। চলছিল প্রবল ধারায় বৃষ্টি। তবু সভাগৃহ ছিল উপস্থিত দর্শকদের উৎসাহ আর কলতানে পূর্ণ। আর তা আরও ঝলমলে হয়েছিল আদর্শবান মানুষদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে। গ্ৰন্থে যা লেখা সংকলিত আছে‚ এমনও বহু উল্লেখিত ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ ও আজকের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে প্রবাহমান রাখার মতো বহু প্রবুদ্ধজনেরাও ছিলেন উপস্থিত। ভারতমাতার প্রতিকৃতিতে প্রদীপ প্রজ্বলনের পর অরিন্দম চক্রবর্তী বক্তব্য পেশ করেন । শিবেন্দ্র ত্রিপাঠী ভবেন্দু ভট্টাচার্যের লেখা একটি দেশাত্মবোধক কবিতায় সুরারোপ করে আক্ষরিক অর্থেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। বাংলার সংঘ কাজের শুরুর অন্যতম পথিকৃৎ শ্রী কেশবরাও দীক্ষিতের প্রারম্ভিক সময়ে নিদ্রা যাওয়ার স্থান পর্যন্ত সংকুলান না হওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে অশ্রু সজল হয়ে পড়েন পৃর্বতন স্বস্তিকা সম্পাদক ডঃ বিজয় আঢ্য।

বিজয়দারই বক্তব্যের সুর ধরে প্রবীণ প্রচারক শ্রী অদ্বৈতচরণ দত্ত স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে স্বস্তিকা সংক্রান্ত নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর ভাবে তাঁর পরিচিত বামপন্থী ঘরানার নেতাদের স্বস্তিকা-প্রীতির কথা উল্লেখ করেন। বলেন, বাইরে বিরোধিতা করলেও এরা বাড়িতে নিয়মিত স্বস্তিকা পড়েন। এই সূত্র ধরেই তিনি দিকপাল নকশালপন্থী নেতার শেষ বয়সে অবিশ্বাস্য মানসিক পরিবর্তনের প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, কোনও সপ্তাহে স্বস্তিকা না পেলে রীতিমত হাঁকপাঁক করতেন তিনি। এমনকি রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে স্বস্তিকার বিষয়বস্তু ও লেখার প্রতি তাঁর প্রবল শ্রদ্ধার কথা জেনেছিলেন , বলেন অদ্বৈতদা।

অদ্বৈতদার আন্তরিক বক্তব্যের সূচীমুখ ছিল যে, দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে এসেও মানুষের মধ্যে যথার্থ জাতীয়তাবাদী চিন্তা প্রতিষ্ঠা করতে স্বস্তিকা আজ বহুলাংশে সফল। তবে এর প্রচার আরও বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি মহারাষ্ট্র ও কেরলে সঙ্ঘ মুখপত্রের বিপুল প্রচারসংখ্যার কথা তোলেন।

একজন ষোল আনা খাঁটি স্বয়ংসেবক কেমন হন তার প্রমাণ মিলল অনুষ্ঠানে এক সময়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ সঙ্ঘ- পদাধিকারী শ্রী রণেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। প্রবল দুর্যোগেও ৮৫ বছর বয়সে কুঁদঘাট থেকে মানিকতলায় একটু দেরীতে হলেও পৌঁছেছিলেন তিনি। সেদিনের অনুষ্ঠান তাই একাধারে শিক্ষনীয় ও স্মরণীয়।

সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি : জয়দীপ রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.