সাহিত্য, সিলেবাস, সময় থেকে আজ বাতিল সত্যেন্দ্রনাথ-সলিল-হেমন্তের ‘পালকির গান’

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকেই ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী বালসাজার এসেছিলেন কলকাতায়। তিনি পালকি (Palki) সম্বন্ধে অনেক কিছুই লিখে গিয়েছেন। লিখেছেন, পালকির গড়নটা বড়ো ভালো। চারজন বেহারা বা কাহার বয়ে নিয়ে যায় এই পালকি। এদের আগে আগে চলে হরকরা আর পেয়াদার দল। বেহারারা মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয়, অথচ ভেতরে বসে বোঝার উপায় নেই যে, কারও ঘাড়ে চেপে যেতে হচ্ছে। চলতে চলতে ওরা কখন যে ঘাড় বদল করে, যাত্রীরা টেরই পায় না। আবার, চলতে চলতেই কী সুন্দর গান গায়, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। মাইলের পর মাইল হাঁটলেও তারা ক্লান্তিহীন। যেন এই পথ চলাতেই আনন্দ।

পথ চলার এই আনন্দকেই সাহিত্যে, ‘পালকির গান’ (Palkir Gaan) ছড়ার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তুলে ধরেছিলেন এককালে গ্রাম বাংলার পথে চলা পালকির এক অবিস্মরণীয় চিত্র— ‘পালকি চলে!/ পালকি চলে!/ গগন তলে/ আগুন জ্বলে!/ স্তব্ধ গাঁয়ে/ আদুল গায়ে/ যাচ্ছে কারা/ রৌদ্রে সারা…’। কয়েক বছর আগে অবধি এই ছড়া পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চতুর্থ শ্রেণীর সিলেবাসে ছিল, আমরাও পড়েছি। সেসব এখন স্মৃতি।

পরে সত্যেনবাবুর ছড়াটাতে সুর বসালেন সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-কে দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। একটিও শব্দ না বদলে, বদলে দিলেন দেখার দৃষ্টিকোন, সত্যেন্দ্রনাথের ছড়া ‘গান’ হয়ে ওঠে—মেহনতী মানুষের গান। সলিলবাবুর কম্পোজিশন-এ ধরা পড়লো খেটে খাওয়া মানুষের ক্লান্তির সুর, চড়াই-উতরাইয়ের সুর।

গোটা গানে কথার সঙ্গে সুর এমন মিলমিশ খেয়ে চলছে যে, বোঝাই যায় না এটা একটা ছড়ার ওপর সুরারোপ! ‘উঠছে আলে’— তো সুরও একটু উঠল; ‘নামছে গাড়ায়’— সুরও একটু নামল; ‘পালকি দোলে ঢেউয়ের নাড়ায়’-তে সুরেও সেই ঢেউয়ের দোলা!

অধিকাংশই কানে শুনতে একেবারে মসৃণ কিন্তু হারমোনিয়াম নিয়ে ‘পালকির গান’ বা ‘রানার’ ‘পথে এ বার নামো সাথী’ গাইতে বসলে বা বাজাতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যেত তাবড় তাবড় গাইনদের। সত্যেন্দ্রনাথের ছড়াতে কিন্তু ওই ‘হুম হুনা’ ব্যাপারটা নেই। সেখানে দেখানো হয়েছে পালকিতে চড়ে এক জন যাচ্ছে, তার চোখে গ্রামবাংলার রূপ। গানটাও তাই। পালকিতে বসা লোকটিই যেন সব কিছু দেখছে আর গাইছে। কিন্তু শুধু ওই ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো যোগ করায় পালকির বেহারারাও এখানে সমান্তরাল চরিত্র। তারা যখন দিনের শুরুতে পূর্ণ উদ্যমে চলে, ‘হুম হুনা’-ও চলে দ্রুত তালে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে তাদের ঈষৎ ক্লান্ত পা একটু দুলকি চাল ধরে— ওই ‘হেঁইয়া রে হেঁইয়া, হেঁই সামালো হেঁইয়া, হেই সামাল… সামাল হেঁকে চলল ডেকে’— ওই জায়গাটায়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঢোকার সময়ে ‘আহা, ওই গো গাঁয়ের ওই সীমানা’ বলে ‘আ’ টান দিয়ে যেখানে এসে গানের পরদা আবার থিতু হয়, সেটা সম্পূর্ণ অন্য একটা স্কেল। এ গ্রাম ছাড়িয়ে ওই গ্রামে ঢুকল। যেন নাটকের মতো দৃশ্যান্তর ঘটল। অতএব, এক নতুন সুরে গানের আবার যাত্রা শুরু হল। গোটা গানে কথার সঙ্গে সুর এমন মিলমিশ খেয়ে চলছে যে, বোঝাই যায় না এটা একটা ছড়ার ওপর সুরারোপ! ‘উঠছে আলে’— তো সুরও একটু উঠল; ‘নামছে গাড়ায়’— সুরও একটু নামল; ‘পালকি দোলে ঢেউয়ের নাড়ায়’-তে সুরেও সেই ঢেউয়ের দোলা! ‘উড়ছে মাছি ভনভনিয়ে’-তে হঠাৎ আচমকা দুটো পাশাপাশি পরদা এমন দুর্দান্ত লাগল যে মাছির ভনভন আওয়াজটা যেন কানে শোনা গেল! দিনের (এবং গানের) শেষে বেহারাদের মুখের ‘হেঁইয়া হেই রে হেঁইয়া হা’-তে সারা দিনের পথশ্রমের ক্লান্তি। একদম শেষের এই ছন্দ-পরিবর্তনটি সত্যেন দত্তের ছড়াতেও আছে, কিন্তু মাঝের সব কিছুই সলিল চৌধুরীর নিজস্ব সংযোজন।

পালকি নিয়ে গান গেয়েছেন ভূপেন হাজারিকাও। তাঁর ‘দোলা হে দোলা’ গানটিতে তিনি পালকির বেহারাদের দুঃখভরা জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার জন্ম দেয়। উপন্যাসটিতে হতদরিদ্র কাহার সমাজের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে আজও সত্যেন্দ্রনাথ-সলিল-হেমন্ত জুটির ‘পালকির গান’-এর আবেদন ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায় আমাদের, এখানে ‘পালকি’ শুধুমাত্র তার আক্ষরিক অর্থ নিয়ে নয়, জীবন এবং সময়ের সেতু হিসেবে বিরাজমান। জন কীটস-এর ভাষায় বললে ‘The poetry of Earth is ceasing never’। সময় এবং জীবনের চোরাস্রোতের অন্তরালে একটা চিরন্তন সুর এবং সঙ্গীত পরিব‍্যপ্ত হয়ে আছে যুগযুগান্ত ধরে। ’পালকি চলে’র মধ্যে এই যে ‘চলে’ শব্দটি আছে সেটি হল আসলে Eternal jouney of our soul into the way of freedom, truth and niceties. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যানটি অচল হলেও ‘পালকির গান’ হল আমাদের গতিময় জীবন, যা কখনও থেমে থাকে না, হারিয়ে যায় না।

©বঙ্গদর্শন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.