সারাবছর ধরে বালির হিন্দুরা নানা উৎসব অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। ন‍্যেপি বা নববর্ষ তার মধ্যে অন্যতম। এই নববর্ষ অনুষ্ঠানে বিধৃত হয়ে আছে হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য। পৃথিবীর প্রতিটি সম্প্রদায় তাদের নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট দিনে নববর্ষ পালন করে থাকে। চীনা লেমলেক বর্ষের প্রথম দিন চীনা ভাষায় গ‍্যাং জি ফ‍্যাট চয়। মুসলিমরা মহরম মাসের প্রথম দিনটি পালন করে থাকেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ গ্রেগরিয়ান ক‍্যালেন্ডারের প্রথম দিন পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে পালন করে থাকেন।

ইন্দোনেশিয়ার একমাত্র হিন্দু অধ‍্যুষিত দ্বীপ বালিতে নববর্ষের দিনে ন‍্যেপি উৎসব পালিত হয়। ন‍্যেপি শব্দটি এসেছে সেপি থেকে অর্থ সাইলেন্ট বা নিস্তব্ধ। সাকা ক‍্যালেন্ডার অনুসারে ন‍্যেপি পালিত হয়। অন‍্যান‍্য ক‍্যালেন্ডারের নববর্ষের মত এই দিনটি বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে পালিত হয় না। বিভিন্ন বছরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ন‍্যেপির দিনটি আসে। এবছর সাতই মার্চ বালিতে ন‍্যেপি পালিত হয়। বালির হিন্দুরা ব‍্যবসা এবং সরকারি কাজে গ্রেগরিয়ান ক‍্যালেন্ডার ব‍্যবহার করলেও যেকোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিবাহ, শ্রাদ্ধ পাউকোন এবং সৌর সাকা এই দুটি ক‍্যালেন্ডার মতে হয়। পাউকোন শব্দটি এসেছে উকু থেকে যার অর্থ উইক। উকুর মধ্যে থাকে ৩০ দিন যার শুরু হয় সিন্টা থেকে শেষ হয় ওয়াটুগুন্নুংতে। পাউকোন ২১০ দিনের ধর্মীয় ক‍্যালেন্ডার যার উৎপত্তি হয় জাভায় চতুর্দশ শতকে। এই ক‍্যালেন্ডারটি সংখ্যাগত ভাবে জটিল। সাকা ক‍্যালেন্ডারের উৎপত্তি ভারতে। সৌর গণনায় বারো মাস থাকে এই ক‍্যালেন্ডারে। অমাবস‍্যার পর পুনরায় চাঁদ ওঠা থেকে মাসের সূচনা হয় এই ক‍্যালেন্ডারে। এই ক‍্যালেন্ডার অনুসারেই পূজা পার্বণের দিন ধার্য হয়। নয় মাসের পর নতুন চাঁদ উঠলে ন‍্যেপি পালিত হয়। বসন্তের অমাবস‍্যার পর নতুন চাঁদ উঠলে ন‍্যেপির দিন আসে। ৭৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এই ক‍্যালেন্ডারের সূচনা।

পশ্চিমি সভ‍্যতায় নববর্ষ মানে হই হুল্লোড় পানভোজন হলেও বালির হিন্দুরা নববর্ষ পালন পুরোপুরি ধর্মীয় অনুষঙ্গে। এই দিন পুরোপুরি নিস্তব্ধতা ও কর্মবিরতি পালিত হয়। সমস্ত রকম প্রাকৃতিক সম্পদের ব‍্যবহার ও বন্ধ থাকে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এ এক গুরুত্বপূর্ণ উদ‍্যোগ। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা হিন্দু ধর্মের মূল কথা। ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে কনিষ্কের রাজ‍্যাভিষেকের সময় থেকে এই ক‍্যালেন্ডারের সূচনা। সম্রাট কনিষ্ক বিখ্যাত জ্ঞানী এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আজিসাকা যেদিন হিন্দু ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ধর্মযাত্রায় বের হন সেই দিনটিকেই ন‍্যেপি হিসেবে পালন করা হয়। তাই নববর্ষের নির্দিষ্ট দিনের কিছু দিন আগেই ন‍্যেপি পালিত হয়।

ন‍্যেপির বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হতে থাকে। এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ হবে মনে ক‍রা হয়। ন‍্যেপির তিনদিন আগে পালিত হয় মেলাস্টী বা মেকিইস বা মেলিস পরিচ্ছন্নতা ও স্নানের দিন। এই দিন শোভাযাত্রা সহকারে সকলে সমুদ্রে স্নান করতে যান এবং দেবপ্রতিমাগুলিকেও সমুদ্র স্নানের দ্বারা পরিষ্কার করা হয়। নেপচুন বা বরুণ দেবতার উদ্দেশ্যে মানুষ স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ওঠেন। এই স্নানের উদ্দেশ্য হল আত্মশুদ্ধি। ন‍্যেপির আগের দিনটি হল তাউরকেসাঙ্গা। এই দিন ওগো ওগো নামক দৈত‍্যকে বিতাড়িত করা হয়। এই দিন কার্নিভালের ঢঙে বালিনীজ গামেলিন মিউজিক পরিবেশিত হয়। স্থানীয় বাদ‍্য কুলকুল, বাম্বু বেল ইত্যাদি সহযোগে গামেলিন মিউজিক গেয়ে ওগো ওগো দৈত্য বিতাড়ন করা হয়। এটি হল অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির জয় ঘোষণা।

এর পরের দিনটি ন‍্যেপি। এটি উপোস ও ধ‍্যানের দিন। এই দিন কাতুর ব্রত পালিত হয়। ২৪ ঘন্টা উপবাস রাখা হয়। এই ব্রতের পালনীয় কর্মগুলি হল- আমাতি গেনি, আমাতি কার্য ও আমাতি লেলুংগানান। কোনো রকম কাজ এদিন হয় না। আত্মশুদ্ধি উপোস এবং বিনোদন রহিত ভাবে দিনটি পালিত হয়। এই দিন পেকালানরা ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হয় না সমস্ত দোকান পাট এবং অফিস বন্ধ থাকে। পেকালানরা ধর্মীয় প্রতিরক্ষক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই তারা রাস্তায় নেমে সকল ব্রতীকে রক্ষা করে। ন‍্যেপি পালন করার ওপর যেন কোনো আঘাত নেমে না আসে তা সুনিশ্চিত করতে।

এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রদর্শন করে পরিচ্ছন্নতা, আত্মশুদ্ধি ও নতুন সূচনা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলি পালনের মাধ্যমে নিজের ওপর নিজের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ, আত্মানুসন্ধান সূচিত হয়। ন‍্যেপির দিনের পালনীয় নিষেধাজ্ঞা গুলি সকলেই শ্রদ্ধা সহকারে পালন করেন। কর্মবিরতির মাধ্যমে পুরনো বছরের কৃতকর্মের ওপর নজর রেখে নতুন বছরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা হয়। ন‍্যেপির পরের দিন ন‍্যগেমবাক গেনি। এই দিন উপবাস ভেঙে আনন্দ উৎসব পালন করা হয়। আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি গিয়ে পুরনো বছরের ভুলের জন‍্য ক্ষমা চাওয়া হয় এবং খাওয়া দাওয়া করে আনন্দ করে পালন করা হয়। সকলে মিলে ধর্ম কন্ঠি করেন এই ধর্ম কন্ঠি হল ধর্মীয় শ্লোক এবং পুরনো পুথির আবৃত্তি ও ধর্মসঙ্গীত গাওয়া। উদয়না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যাপক মেড সুয়াস্ত্রার মতে এই অনুষ্ঠান সপ্ত তিমির বা অন্তরের সাতটি দৈত‍্যকে হত্যা করার দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.