আওয়ামি লিগের বিপুল জয়েও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনিশ্চয়তা কাটছে না

বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামি লিগের জয় প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এমন বিপুল জয়ে অবাক আওয়ামি লিগ নেতৃত্বও। মোট ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন আওয়ামি লিগের মহাজোটের পক্ষে আসায় দলের কর্মীরাও হতবাক। ৩০০ আসন বিশিষ্ট সংসদের একটি আসনে ভোট গণনা স্থগিত আছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি ও কয়েকটি ছোট দলকে নিয়ে শেখ হাসিনার জোটের এই অভাবিত ফলাফলে শাসকদল উল্লাস প্রকাশ করলেও, বিরোধীরা জানিয়ে দিয়েছেন, এই ফলাফলকে তাঁরা প্রত্যাখান করছেন। দেশের উন্নয়নের পক্ষে ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মানুষের রায় বলে আখ্যা দিয়েছেন শেখ হাসিনা কিন্তু বিরোধীরা একে সাজানো নির্বাচন বলে দাবি করে বলেছেন, ভোটের আগেই ফলাফল ঠিক করে রাখা হয়েছিল।
হাসিনার আওয়ামি লিগের মহাজোটের অন্যতম দল এরশাদের জাতীয় পার্টি জিতেছে ২২টি কেন্দ্রে, আওয়ামি লিগ একাই পেয়েছে ২৫৫টি। বিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জেতা আসনের মধ্যে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি ৭টি এবং আওয়ামি লিগেরই প্রাক্তন মন্ত্রী বিশিষ্ট আইনজীবী কামাল হোসেনের গণফোরাম জিতেছে মাত্র ৪টে আসনে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন দলের এমন বিপুল জয় আওয়ামি লিগই দেখাতে পারল। ভোটের দিন বিস্তীর্ণ এলাকায় হাঙ্গামা, হিংসা, প্রতিবাদস্বরূপ একাধিক বিরোধী প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সর্বোপরি ২১ জনের মৃত্যু বুঝিয়ে দিচ্ছে কী ধরনের হিংসার ঘটনা ঘটেছে নির্বাচনে। এসবের মধ্যেই শাসকদল আওয়ামি লিগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করছে। বিরোধীরা নির্বাচনের আগে দাবি করেছিল ‘এবার ভোটে বিপ্লব হবে’। তবে সেটা বিরোধীদের পক্ষে হয়নি, হয়েছে শাসকদলের অনুকূলে। ভোটে কারচুপি হয়েছে বলে বিরোধীরা দাবি করলেও হুদা** জানিয়ে দিয়েছেন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে।
সন্দেহ নেই এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শাসকদল আওয়ামি লিগ এখন থেকে রাজনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমের সুযোগ অর্জন করল। যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক অশনি সঙ্কেতও বলা যেতে পারে। শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে কখনও এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে যা গণতন্ত্রের অস্তিত্বের সামনে জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব হলে দেশে কোনও কোনও সময় রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। মনে রাখা দরকার দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই বিএনপি নির্বাচন থেকে কার্যত ছিটকে যায়। এরপর শর্তাধীনে ভোটে যাওয়া, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতা, ঐক্যফ্রন্ট গঠন শেষমেশ নির্বাচনী জোট করে ভোটে যাওয়া কোনও কিছুই দলকে ভোটমুখী করতে পারেনি। প্রার্থী বাছাই ও চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকার ঘোষণা যখন হল তাতে তাদের নির্বাচনী পালে হাওয়া এল না। ভোটে শুধু নামেই দেখা গেল বিএনপি-কে। প্রার্থীরা নিজের কেন্দ্রে সরাসরি মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়ার বদলে ব্যস্ত ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। অন্তত ৭০টি আসনে বি এন পি যোগ্য প্রার্থীই বাছাই করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে বিত্তবান ব্যক্তিদের প্রার্থী করে সমর্থক ভোটারদের বিরাগভাজনও হয়েছে। এছাড়া ৫০টির বেশি আসন ভোটসঙ্গীদের ছেড়ে দিলেও বিএনপি কর্মীদের কিন্তু জোটপ্রার্থীদের হয়ে মাঠে আদৌ নামতে দেখা যায়নি। এর ফায়দা নিয়েছে শাসকদল আওয়ামি লিগ। আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ অনুযোগ, তাদের শাসন প্রণালী সম্পর্কে মানুষের খেদ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা শেখ হাসিনাকে বিকল্পহীন হিসাবে ভেবে নিয়েছেন। আওয়ামি লিগ নেতা মুনতাসির মামুন দুমাস আগেই বলেছিলেন “বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবেশটাই পাল্টিয়ে দিয়েছে বর্তমান আওয়ামি সরকার। একটির পর একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচির সফল রূপায়ণ করে শাসক দল বাংলাদেশকে উন্নীত করছে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে এবং ভোটদাতারা উন্নয়নের এই সার্বিক উদ্যোগকে বিপুলভাবে সমর্থন করেছে।”
গতবার ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জঙ্গি ও মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেন। লাগাতার ধারাবাহিক অভিযানের ফলে চোরাচালানে অনেকটাই লাগাম টানা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার সাত শতাংশের সীমা অতিক্রম করেছে। যার আর্থিক মূল্য ১৯৭৫৮১৭ কোটি টাকা। হতদরিদ্রের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে হ্রাস পেয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৬,৩৫০ মেঘাওয়াট এবং বিদ্যুৎ জালের প্রসারের কারণে একশ শতাংশ গৃহেই বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অঙ্ক হল তিন লক্ষ কোটি ডলার–চিন ও ভারতের সঙ্গে রাশিয়াও অকাতরে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে। দেশজুড়ে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলি জোর দিচ্ছে রপ্তানি বৃদ্ধির ওপর।
ডিজিটাল দুনিয়ায়ও যাকে বলে নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এই মুহূর্তে আট কোটি নাগরিক ইন্টারনেট ব্যবহার করে, ১৩ কোটি সিমকার্ড বাজারে চালু। উন্নয়নের এই পর্বে দেশে গড়ে উঠেছে এক সক্রিয় ও সংহত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। অর্থাৎ বাংলাদেশের সেই **পর্বপরিচয়-কবিতায় ধনী এবং অগণিত দরিদ্র–এখন আর সত্য নয়। বাংলাদেশকে এখন আর ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলা যাবে না। হেনরি কিসিঙ্গারের উচিত তাঁর এই মন্তব্যটি প্রকাশ্যেই প্রত্যাহার করে নেওয়া। এই মধ্যবিত্ত সমাজের নাগরিকরা অগ্রপদক্ষেপ করতে উন্মুখ, এরা ‘অন্তেপ্রেনিয়ার’, বা স্ব-উদ্যোগী।
এছাড়াও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অন্তর্গত যারা এবার প্রথম ভোট দিয়েছে, তাদের সংখ্যা এক কোটি বাষট্টি লক্ষ এবং এর অধিকাশই ধর্মের নিগড় ছিন্ন করে ঢালাও ভোট দিয়েছে শাসক দলকে, কেননা এরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপাসক।
মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে তীব্র ভাবাবেগও এই নির্বাচনে সহ-নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে। একদিকে নাগরিকরা বিএনপি-র সঙ্গে জামাত-ই-ইসলামির নিবিড় মাখামাখি সুনজরে দেখেনি। বিএনপি এবারে ২৫টি আসনে জামাতের নেতাদের প্রার্থী করেছে তাদের প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে লড়াই করার জন্য। তাদের অধিকাংশই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের সীমান্তবর্তী এলাকা সাতক্ষীরা, খুলনা, বগুড়া, চাঁপাই, নবাবগঞ্জ, সিলেট, ঠাকুরগাঁও এবং চট্টগ্রাম থেকে দাঁড়িয়েছিল এবং হেরেছে। অন্যদিকে এ বারের ফলাফল এটাই প্রমাণ করে যে, বেশ কয়েকজন জামাতিকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পক্ষে ছিল দেশের জনসাধারণ।
এখন প্ৰশ্ন উঠছে, এই নির্বাচনে আওয়ামি লিগ জিতেছে কিন্তু সংখ্যালঘুরা কতটা নিরাপদ? অনিশ্চয়তা কাটছে না বাংলাদেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শেখ হাসিনার দলের নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করছেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে। ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অধিক ঝুঁকিপূর্ণ মিলিয়ে ৬১টি আসন চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সারা দেশে ৯৬টি আসনে মোট ভোটদাতার মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ১২ শতাংশের বেশি। তার মধ্যে ৬১টিতেই তারা বিপন্ন। ঝুঁকির হিসেবে শীর্ষে রয়েছে খুলনা কক্সবাজারের মতো এলাকা।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সভার সাধারণ সম্পাদক রঞ্জন কর্মকারের কথায়, “উগ্র এবং মৌলবাদী ইসলামকে বাংলাদেশে সামাজিক জায়গাটি দেওয়ার বিষয়টিতে পাকিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির ভূমিকা রয়েছে। গ্রামে গিয়ে দেখুন, হাসান লালন মেলা সব ভেসে গিয়েছে উগ্র ইসলামের দাপটে।
ভোটে এবার সংখ্যার বিচারে দাঁত ফোটাতে পারেনি প্রাক্তন জামাত বা নব্য বিএনপি নেতারা। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের শেষরক্ষা হবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের নির্বাচন বিশারদদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। ১৯৭১-এর পর চার দশক অতিক্রম করা সত্ত্বেও এই সে দিন পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশি ঘুম থেকে উঠে নিজেদের প্রশ্ন করতেন তাঁরা প্রথমে বাঙালি না মুসলমান। রমনা ময়দানে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন তিনি প্রথমে বাঙালি, তারপর মুসলিম। এই নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে একদা দ্বিধামুক্ত অনেকেই মুজিবরের পথের অনুসারী। অন্যভাবে বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্মৃতি নির্বাচকদের প্রভাবিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরী হিসাবে তাঁরা শাসক দলকেই বেছে নিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সদ্য প্রকাশিত বই ‘A Broken DREAM- Rule of Law, Human Rights & Democracy’ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি বেশ তোলপাড় হয়ে উঠেছিল। বইয়ে বিচারপতি সিনহা সবিস্তারে বিবরণ দিয়েছেন আওয়ামি লিগ সরকারের সঙ্গে কোন পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সংঘাত বেধেছিল, কী ভাবে তাঁকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়, কেন তিনি বিদেশ থেকেই প্রধান বিচারপতি পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। দুর্বল বিএনপি ভোটের আগে কিছুটা পালে হাওয়া পাওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু কাজ হয়নি। সরকার এবং আওয়ামি লিগের অভিযোগ হাসিনা বিরোধী-রা বইটির পিছনে সক্রিয়, রয়েছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট আইনজীবী ও জামাত নেতা রাজ্জাক বিচারপতি সিনহাকে সাহায্য করেছেন এই বইয়ের ব্যাপারে।
এখন প্ৰশ্ন হল এই ঢালাও বিজয়ের পর শেখ হাসিনা কি আরও আক্রমণাত্মক এবং কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবেন? ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তবে সংশ্লিষ্ট অন্য প্রশ্নটিও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। প্রশ্নটি হল একজন ‘আক্রমণাত্মক, কর্তৃত্ববাদী, এমনকী স্বৈরাচারী নেত্রী কি কখনও রাজনীতির প্রাঙ্গণে এ রকম সর্বাত্মক বিজয় অর্জন করতে পারতেন? এই প্রশ্নটির সম্ভাব্য উত্তর হল, না।
নবনির্বাচিত বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবে। যেগুলি হল ১) দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের প্রত্যার্পণ সুনিশ্চিত করা। ২) তিস্তার জলবণ্টন কার্যকর করা। ৩) মুক্তিযুদ্ধের আদ্যন্ত বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্ৰদান ৪) শিল্পায়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। এ সবই শেখ হাসিনাকে করতে হবে বিরোধীহীন জমানায়।

দীপক কুমার চক্রবতী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.