ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ আছড়ে পড়তে পারে সাগর এবং পুরীর মধ্যবর্তী স্থলভাগে। তার ২৪ ঘণ্টা আগেই ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে দিঘার সমুদ্র। মঙ্গলবার জোয়ারের সময় সমুদ্রের সেই রূপ দেখার জন্য সৈকত এলাকায় হাজির হয়েছিলেন পর্যটকেরা। কিন্তু দুর্ঘটনার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি বেলাভূমি এলাকা দড়ি দিয়ে ঘিরে দেয় প্রশাসন। কাউকেই সমুদ্রস্নানে নামতে দেওয়া হয়নি। পর্যটকেরা খানিকটা হতাশ হলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে কড়া মনোভাব পূর্ব মেদিনীপুর প্রশাসনের। ইতিমধ্যে নদী এবং সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী প্রচুর মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একই ভাবে সাবধানি দক্ষিণ ২৪ পরগনা প্রশাসনও। সাগর, সুন্দরবন, বকখালি ইত্যাদি এলাকায় সতর্কতামূলক প্রচার চলছে। মাইকিং হচ্ছে এলাকায় এলাকায়।
বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে মঙ্গলবারই। বুধবার সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আছড়ে পড়তে পারে ওড়িশা এবং বাংলার উপকূলে। কাতার ওই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়েছে ‘দানা’। অর্থ, মুক্ত বা স্বাধীনতা। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস ঝড়ের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। মঙ্গলবার প্রায় সারা দিন ধরে গঙ্গাসাগরের কচুবেড়িয়া ঘাটে ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে অসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মীরা মাইকিং করে মৎস্যজীবীদের গভীর সমুদ্রে যেতে নিষেধ করছেন। ইতিমধ্যে যাঁরা সমুদ্রে চলে গিয়েছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদেরও সতর্ক করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রশাসন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার সঙ্গে সমুদ্রের চেহারাও বদলাচ্ছে। দিঘার সমুদ্র অশান্ত হতে শুরু করেছে। পর্যটকদের দিঘায় আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি না হলেও সমুদ্রে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। দিঘা বেড়াতে আসা পর্যটকেরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস দেখবার জন্যই তাঁরা ছুটে এসেছেন। মঙ্গলবার নিরাপদ দূরত্ব থেকে সমুদ্র দেখেছেন। তবে বুধবার সমুদ্রের কতটা কাছে ঘেঁষতে পারবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়।
হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, ‘দানা’র প্রভাবে বুধবার থেকেই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের জেলা, যেমন দুই মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃহস্পতি এবং শুক্রবার পরিস্থিতি আরও ‘জটিল’ হয়ে উঠতে পারে। ওই সময় সমুদ্র উত্তাল থাকবে বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। সেই বার্তা মাথায় রেখে দিঘা-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের প্রায় ৭৫ কিমি দীর্ঘ সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার সুরক্ষা জোরদার করার জন্য মঙ্গলবার জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি-সহ জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা এলাকা পরিদর্শনে যান। জানা যাচ্ছে, পুরী থেকে পর্যটকদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে ওড়িশা সরকার। তবে দিঘার ক্ষেত্রে এখনই কোনও নির্দেশিকা জারি করেনি নবান্ন। তবে সমুদ্রস্নানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাতে কিছুটা নিরাশ পর্যটকেরা। শান্তিপুরের ফুলিয়া থেকে দিঘায় বেড়াতে আসা চঞ্চল সর্দার বলেন, ‘‘মঙ্গলবার সকাল থেকে সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। কাউকেই সমুদ্রে নামতে দেওয়া হয়নি। তবে জলোচ্ছ্বাস দেখার আশায় আমরা বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দিঘায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” দিঘা থানার অসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মী রতন দাস জানিয়েছেন, কোনও ভাবেই যাতে পর্যটকেরা সমুদ্রস্নানে না যান, সে দিকে কড়া নজরদারি করার নির্দেশ রয়েছে তাঁদের উপর। এখন বেলাভূমির অধিকাংশ এলাকা দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক বলেন, ‘‘আমরা সম্পূর্ণ ভাবে প্রস্তুত আছি। সমুদ্রে যে মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে গিয়েছিলেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন কোনও মৎস্যজীবীকে সমুদ্রে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আগেভাগে পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রেখেছি। ৫০০-র বেশি কুইক রেসপন্স টিম তৈরি করেছি। যাতে ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়লে সেগুলো দ্রুত কেটে সরিয়ে ফেলা যায়। কোনও ভাবে যান চলাচলে যেন সমস্যা না-হয়, সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে। তা ছাড়া ঝড় আছড়ে পড়ার আগেই পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র তীরবর্তী গ্রামগুলি থেকে দেড় থেকে দুই লক্ষ বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তাঁদের থাকা-খাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফ্লাড সেন্টারগুলিকেও তৈরি রাখা হয়েছে। উঁচু এলাকায় থাকা স্কুল ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনে সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করা হবে। বুধবার দুপুরের মধ্যে সমস্ত ব্যবস্থা শেষ করে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।’’ দিঘার তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে জেলাশাসক আরও বলেন, ‘‘আমি দিঘায় এসে গোটা এলাকা পর্যবেক্ষণ করলাম। সমুদ্রের বাঁধগুলিতে নজরদারি চালানো হচ্ছে। আসন্ন ঝড়ের মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সব দিক থেকে প্রস্তুত।’’
ঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মোহনপুর, দাঁতন, কেশিয়াড়ি ও নারায়ণগড় ব্লকের বেশ কিছু এলাকায়। নবান্নের নির্দেশে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় তৎপরতা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদরি এবং জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার জানান, যে সমস্ত এলাকা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দাদের আগেভাগে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিরাপদ জায়গায়। একাধিক কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ওড়িশা সীমান্তে মোতায়েন করা হচ্ছে চারটি এসডিআরএফ এবং একটি এনডিআরএফ দলকে। থাকছে মোবাইল কন্ট্রোল ইউনিট এবং বিদ্যুৎ দফতরের বিশেষ দল। পুজোর জন্য লাগানো বড় বড় বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং খুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট জেলায় এক হাজারের বেশি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে।
আয়লা, আমপান, বুলবুলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনও সতর্ক। ‘দানা’ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা মাথায় রেখে বসিরহাট মহকুমার ১০টি ব্লকে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। সুন্দরবন লাগোয়া হিঙ্গলগঞ্জ এবং সন্দেশখালি ব্লকে ঝড়ের প্রভাব বেশি পড়ে। তাই ওই দুই ব্লকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। উদ্ধারের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা থাকছে। থাকছে ইলেকট্রিক করাত, মই, ‘মিনি জেনারেটর’ থেকে উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ। মঙ্গলবার হেমনগর, হিঙ্গলগঞ্জ এবং সন্দেশখালির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাইকিং হয়েছে। মঙ্গলবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা শাসকের দফতরে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করছেন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র হাজরা। সুন্দরবনের নদী এবং সমুদ্রবাঁধ নিয়ে কিছুটা হলেও চিন্তায় থাকছে প্রশাসন। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাকদ্বীপ মহকুমার মৌসুনি এবং ঘোড়ামারা দ্বীপ। ক্ষতির বহর কমানোর জন্য সব রকম আয়োজন করছে প্রশাসন।