রাজশেখর বসু, লঘুগুরু

“একটা ভ্রান্ত ধারণা অনেকের আছে যে চলিতভাষা আর পশ্চিম বঙ্গের মৌখিকভাষা সর্বাংশে সমান। এর ফলে বিস্তর অনর্থক বিতণ্ডা হয়েছে। মৌখিকভাষা যে অঞ্চলেরই হােক, মুখের ধ্বনি মাত্র, তা শুনে বুঝতে হয়। লৈখিকভাষা দেখে অর্থাৎ পড়ে বুঝতে হয়। মৌখিকভাষার উচ্চারণই তার সর্বস্ব। লৈখিকভাষার চেহারাটাই আসল, উচ্চারণ সকলে একরকমে না করলেও ক্ষতি নেই, মানে বুঝতে পারলেই যথেষ্ট। লৈখিকভাষা সর্বসাধারণের ভাষা, সেজন্য বানানে মিল থাকা দরকার, উচ্চারণ যাই হােক।”


“আজকাল মনােবিদ্যার উপর শিক্ষিত জনের প্রবল আগ্রহ জন্মিয়াছে, তাহার ফলে এই বিদ্যার বুলি সর্বত্র শােনা যাইতেছে। Psychological moment কথাটি বহুদিন হইতে সংবাদপত্র ও বক্তৃতার অপরিহার্য বুকনি হইয়া অপবিজ্ঞান দাড়াইয়াছে। সম্প্রতি আর একটি শব্দ চলিতেছে-complex। অমুক লােক ভীরু বা অন্যের অনুগত, অতএব তাহার inferiority complex আছে। অমুক লােক সাঁতার দিতে ভালবাসে, অতএব তাহার water complex আছে। বিজ্ঞানীর দুর্ভাগ্য—তিনি মাথা ঘামাইয়া যে পরিভাষা রচনা। করেন, সাধারণে তাহা কাড়িয়া লইয়া অপপ্রয়ােগ করে, এবং অবশেষে একটা বিকৃত কদৰ্থ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া বিজ্ঞানীকে স্বাধিকারচ্যুত করে।”

“বৈদিক ঋষি থেকে ফ্রয়েডপন্থী পর্যন্ত সকলেই হয়তাে একটা ভুল করেছেন। আগে কাম, না আগে ক্ষুধা? পাচনরসই আদিরস নয়তাে? কাম-কমপ্লেক্স যেমন নব নব মূর্তি পরিগ্রহ করে ফুটে ওঠে, ক্ষুৎ-কমপ্লেক্সেরও কি তেমন কোনও ক্ষমতা নেই?”

“কোন্ সীমায় সুরুচির শেষ আর কুরুচির আরম্ভ তারও নির্ধারণ হতে পারে না। এক যুগ এক দল যাকে উত্তম আর্ট বলবে, অপর যুগ অপর দল তার নিন্দা করবে, আর সমাজ চিরকালই আর্ট সম্বন্ধে
অনধিকারচর্চা করবে।”

“বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের ফলে প্রাচীন অন্ধসংস্কার ক্রমশ দূর হইতেছে। কিন্তু যাহা যাইতেছে তাহার স্থানে নূতন জঞ্জাল কিছু কিছু জমিতেছে। ধর্মের বুলি লইয়া যেমন অপধর্ম সৃষ্ট হয়, তেমনি বিজ্ঞানের বুলি লইয়া অপবিজ্ঞান গড়িয়া উঠে। সকল দেশেই বিজ্ঞানের নামে অনেক নূতন ভ্রান্তি সাধারণের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক ছদ্মবেশে যেসকল ভ্রান্ত ধারণা এদেশে লােকপ্রিয় হইয়াছে, তাহারই কয়েকটির কথা বলিতেছি।
প্রথমেই উল্লেখযােগ্য বিদ্যুৎ। তীব্র উপহাসের ফলে এই শব্দটির প্রয়ােগে আজকাল কিঞ্চিৎ সংযম আসিয়াছে। টিকিতে বিদ্যুৎ, পইতায় বিদ্যুৎ, গঙ্গাজলে বিদ্যুৎ—এখন বড় একটা শােনা যায় না। গল্প শুনিয়াছি এক সভায় পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি অগস্ত্যমুনির সমুদ্রশােষণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। অগস্ত্যের ক্রুদ্ধ চক্ষু হইতে এমন প্রচণ্ড বিদ্যুৎস্রোত নির্গত হইল যে সমস্ত সমুদ্রের জল এক নিমেষে বিশ্লিষ্ট হইয়া হাইড্রোজেন অক্সিজেন রূপে উবিয়া গেল। সকলে অবাক হইয়া এই ব্যাখ্যা শুনিল, কেবল একজন ধৃষ্ট শ্রোতা বলিল—আরে না মশায়, আপনি জানেন না, চোঁ করে মেরে দিয়েছিল।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.