নিজেদের জমি, সম্পত্তি ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে এবং গ্রামে সমৃদ্ধি ফেরাতে দেবতার শরণাপন্ন হয়েছিলেন গ্রামের রায় পরিবার। শুরু করেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজো। পুজো শুরুর পর গ্রামে ফিরেছে শান্তি ও সমৃদ্ধি। ফলে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে এবারও জগদ্ধাত্রী পুজোয় মাততে চলেছেন বীরভূমের রামপুরহাট থানার দেখুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দারা। পুজো শুরুর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলতে না পারলেও গ্রামবাসীদের দাবি, প্রায় ৪৫০ বছর আগে গ্রামের রায় পরিবারের ইষ্টদেবতা হিসাবে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। মায়ের নিত্যপুজোর জন্য গ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিল ভট্টাচার্য পরিবারকে। তাদের দৌহিত্ররা আজও বংশের পুজো চালিয়ে আসছেন।
পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দেখুড়িয়া গ্রামে একসময় তেজচন্দ্র রায়, সতীশ রায়দের পূর্বপুরুষরা দেখুড়িয়া গ্রামে জমিদারি শুরু করেছিলেন। গ্রামে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফেরাতে তারাই জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেছিলেন। সেই সময় পুজো পাঠ করার জন্য সত্যঞ্জীব ভট্টাচার্য নামে এক পুরোহিতকে গ্রামে নিয়ে আসেন জমিদাররা। শুরু হয় গ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজো। মা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্ট দেবতা হিসাবে পুজো করেন গ্রামবাসীরা। তার পরেই গ্রামে শুরু হয় কালী পুজো। মা কালীকে গ্রাম্যদেবী রূপে পুজো করেন গ্রামবাসীরা। পুজোর জন্য জমি দান করে গিয়েছিলেন পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু কালক্রমে সেই জমি বেশ কিছু অংশ বেহাত হয়ে গিয়েছে। তাই এখন পুজো হয় সবার সাহায্যে”।
বর্তমানে পুজো কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা সৌমব্রত রায়, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ময়ূখ চট্টোপাধ্যায়, পার্থ সারথি মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রাচীন রীতি মেনে এখানে শুধুমাত্র নবমীর দিন পুজো করা হয়। একই দিনে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী পুজো করা হয়। যেহেতু দ্বারকা নদী উত্তরদিকে বয়ে চলেছে। সেহেতু দ্বারকা নদীর জল গঙ্গার সমান বলে বিশ্বাস মানুষের। তাই মঙ্গলবার ভোরের দিকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাঁসর, ঘণ্টা, ঢাক ঢোল নিয়ে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দ্বারকা নদী থেকে সুসজ্জিত ভাবে ঘট ভরে আনা হয়। তারপরই বীরাচারে শুরু হয় পুজো। বলিদান প্রথা আজও রয়ে গিয়েছে। অন্যান্যবারের মতো সন্ধ্যায় হাজার পাঁচেক মানুষের মধ্যে পুজোর ভোগ বিতরণ করা হবে। দশমীর সন্ধ্যায় মাকে গ্রাম প্রদক্ষীণ করে নিরঞ্জন দেওয়া হবে বড় পুকুরে”।
এই পুজোয় অংশগ্রহণ করেন পার্শ্ববর্তী উদয়পুর, বলরামপুর, কাঁদা, কামাখ্যা, সাতঘড়িয়া সহ আট- দশটি গ্রামের মানুষ। তারাপীঠের সেবাইত থেকে রামপুরহাট শহরের মানুষও পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। কথিত আছে গ্রামের ইষ্ট দেবীর কাছে কেউ মানত করলে তার মনস্কামনা পূরণ হয়। সেই বিশ্বাসে বহু মানুষ মায়ের কাছে মানসিক করে পুজোয় অংশগ্রহণ। কেউ কেউ প্রতিমা দেওয়ার অঙ্গীকার করে থাকেন। সেই মতো এবার কাটোয়ার বনকাপাসির বাসিন্দা পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিমা দিচ্ছেন। প্রতিমা তৈরি করছেন রাপুরহাটের শিল্পী অঙ্কন শর্মা। পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামে মেলা বসে। কর্মসূত্রে, কিংবা বিবাহ সূত্রে গ্রামের বাইরে থাকা মেয়ে কিংবা পুরুষ সদস্যরা জগদ্ধাত্রী পুজোয় গ্রামে ফেরেন। পুজোয় তাদের অংশগ্রহণে গ্রামে মিলন উৎসবের চেহারা নেয়।
পুজোর পাশাপাশি উদ্যোক্তারা সামাজিক কাজেও নিজেদের নিয়োগ করেন। এবার বিনামূল্যে চক্ষু পরীক্ষা শিবির ও চশমা দেওয়া হয়েছে। দুঃস্থদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে”।