সেই ১৯৯৫ সালে সুমন গেয়েছিলেন, ‘কেমন আছো হে কলেজ স্ট্রিট?’ প্রায় তিন দশক পরে এই ২০২৪ সালে কেমন আছে সেই কলেজ স্ট্রিট?
প্রশ্নটা সহজ। আর উত্তরও জানা। কলেজ স্ট্রিট রয়েছে আন্দোলনের ধাত্রীভূমি হিসেবেই। সে নাগরিক আন্দোলনই হোক বা রাজনৈতিক আন্দোলন। আরজি কর-কাণ্ডের পরেও সমস্ত মিছিলের সূতিকাগৃহ সেই কলেজ স্ট্রিট। যেমন বৃহস্পতিবার শহরে তিনটি (মতান্তরে চারটি) মিছিল বেরিয়েছিল আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচার চেয়ে। চারটিরই সূচনা হয়েছে কলেজ স্ট্রিট থেকে।
প্রথমটি রাজনৈতিক মিছিল। গিয়েছে শ্যামবাজার পর্যন্ত। যার পুরোভাগে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের বিদায়ী সভাপতি অধীর চৌধুরী। দ্বিতীয়টি মূলত বিভিন্ন পেশার মহিলাদের ‘অঙ্গীকার যাত্রা’। সেটিরও গন্তব্য ছিল শ্যামবাজার। তৃতীয় মিছিল ‘পথের দাবি’। সেখানেও ভিড় হয়েছিল প্রচুর। সে মিছিলে যেমন ছিলেন বাম মনোভাবাপন্নেরা, তেমনই ছিলেন সিপিএমের লোকজনও। সেটির শেষ হয়েছে ধর্মতলায়। চতুর্থ একটি মিছিল কলেজ স্ট্রিটেই শুরু হয়েছিল। সেখানে ছিলেন কলকাতা ময়দানের তিন প্রধান ক্লাবের সমর্থকেরা। তাঁদেরও গন্তব্য ছিল ধর্মতলা। সেটি অবশ্য একটা সময়ে ‘পথের দাবি’র সঙ্গেই মিশে যায়।
গত ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে ‘মেয়েদের রাত দখল’ করার আহ্বানেও যাদবপুর, অ্যাকাডেমির পাশাপাশি সাড়া দিয়েছিল কলেজ স্ট্রিটও। মেয়েদের রাত দখলের বিশাল মিছিল বেরিয়েছিল শ্যামবাজারের উদ্দেশে। বস্তুত, আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে একাধিক সভা-মিছিল হয়েছে কলেজ স্ট্রিটে। গত মঙ্গলবার নবান্ন অভিযানের দিন বিজেপিও কলেজ স্ট্রিটেই মিছিল করেছে।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রশান্ত রায় কলেজ স্ট্রিটকে বলেন ‘নলেজ স্ট্রিট’। ঠিকই। তাঁর কথায়, ‘‘বেথুন কলেজ থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত ধরা হলে বলা যায়, এটি বাংলার জ্ঞান সরণি (নলেজ স্ট্রিট)। এখানে বহুবিধ আন্দোলন হয়েছে। পাশ্চাত্য শিক্ষাকে গ্রহণ করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। আবার নবজাগরণের আন্দোলনও হয়েছে।’’ বস্তুত, তিনি কলেজ স্ট্রিটের তুলনা টেনেছেন লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়্যারের সঙ্গে। যা ব্রিটেনে নানা আন্দোলনের পীঠস্থান। প্রশান্তের কথায়, ‘‘লন্ডনে ট্রাফালগার স্কোয়্যারে বিভিন্ন আন্দোলনের জমায়েত হয়। কলেজ স্কোয়্যারও খানিকটা তেমনই। তবে বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বহু আন্দোলনের জমায়েতস্থল হয়ে উঠেছিল তাঁর বাড়ির অদূরে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারও (বর্তমান সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার)।’’
ইতিহাস বলছে, ঊনবিংশ শতকে নবজাগরণ থেকে একবিংশ শতকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্যন্ত বঙ্গ রাজনীতি যত বার আলোড়িত হয়েছে, তত বার উত্তাল হয়েছে কলেজ স্ট্রিট। মুখরিত হয়েছে মিছিল-স্লোগানে। অনেকের মতে, এর কারণ কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজ), সংস্কৃত কলেজ। অন্য দিকে হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল। বিভিন্ন বয়সি পড়ুয়া এবং তরুণ-তরুণীদের সমাগম। আশ্চর্য নয় যে, সেই এলাকাকে কেন্দ্র করেই যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য বরাবরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি ব্রহ্মদেশ থেকে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে সেখানকার ছাত্র আন্দোলন বরাবরই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাড়া ফেলেছে।
জন্মলগ্নে অবশ্য কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনও সম্পর্ক ছিল না। অষ্টাদশ শতকের শেষ লগ্নে ফোর্ট উইলিয়ামের জেনারেল হন লর্ড ওয়েলেসলি। তাঁর উদ্যোগে কলকাতা জুড়ে বিভিন্ন ‘আর্টেরিয়াল’ সড়ক তৈরি হয়েছিল। সেই পর্বেই নির্মিত হয় কলেজ স্ট্রিট। তখন মূলত সামরিক বাহিনী যাতায়াত করত এই রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তার নামের সঙ্গে ‘কলেজ’ শব্দটি জুড়ে যায় হিন্দু কলেজ (পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্সি কলেজ) প্রতিষ্ঠার পর। তার পর থেকেই দ্রুত বদলে যায় জায়গাটির চালচিত্র। তারও পরে রাস্তার নাম হয় ‘কলেজ স্ট্রিট’। যা আরও এক বার বাংলার বিরোধী রাজনীতির ‘ভরকেন্দ্র’ হয়ে উঠেছে।
কেন কলেজ স্ট্রিট? ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, ‘‘কলেজ স্ট্রিটের একটা স্থানমাহাত্ম্য রয়েছে। আমি মনে করি, কলেজ স্ট্রিট কলকাতার মস্তিষ্ক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি, হেয়ার স্কুল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় আরও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই কারণে রাজনৈতিক দলগুলি বা অরাজনৈতিক সংগঠনগুলি বরাবর কলেজ স্ট্রিটকে বেছে নিয়েছে।’’ তা হলে কি ‘কলকাতার মস্তিষ্ক’ কলেজ স্ট্রিটে জমায়েত করে সমাজের মস্তিষ্কে আঘাত করতে চাইছেন আন্দোলনকারীরা? পবিত্রের মতে, ‘‘সে ভাবনা অমূলক নয়। কারও কারও মধ্যে যদি এই ভাবনা এসে থাকে, তাতে ভুল দেখছি না।’’
ভিয়েতনাম যুদ্ধের আবহে আমেরিকার প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারার ভারত সফরের বিরোধিতা থেকে ট্রামভাড়া বৃদ্ধি, নকশালবাড়িতে কৃষকদের উপর পুলিশের গুলিচালনার ঘটনা— সবেতেই উত্তাল হয়েছে কলেজ স্ট্রিট। ১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনেও উত্তাল হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ। সেই সময় ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ গর্জনের সাক্ষী ছিল এই কলেজ স্ট্রিট চত্বর। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে বাংলায় বামজমানার পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়, সেই আন্দোলনের গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে ছিল ২০০৭ সালে কলেজ স্ট্রিট থেকেই বেরোনো নাগরিক সমাজের মিছিল। সেই মিছিলে তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন না। কিন্তু তার ‘সুফল’ থেকে তিনি বঞ্চিত হননি। তবে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গিয়েছে। ২০১১ সালে বামেদের হারিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা। ১৩ বছর পরে যাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধেই গর্জন শুরু হচ্ছে সেই কলেজ স্ট্রিট থেকে।
মমতার দল তৃণমূলের প্রবীণ নেতা নির্বেদ রায়ের কথায়, ‘‘কলেজ স্ট্রিটই বাংলার রাজনীতির ভরকেন্দ্র। একটা সময়ে বাংলার রাজনীতির শ্রেষ্ঠ মেধারা এই পাড়াতেই রাজনীতি করতেন। যে কোনও কারণেই হোক, সেটা থেকে গিয়েছে। যাঁরা কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল করছেন, তাঁরা যে ইতিহাস জেনে সেই সরণিতে হাঁটতে চাইছেন, তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ হয়তো লোকমুখে শুনেছেন। সেই থেকে এই ধারণাটা রয়ে গিয়েছে।’’
সেই ১৯৯৫ সালে ‘কলেজ স্ট্রিট’ গানে সুমন গেয়েছিলেন, ‘কেমন আছো হে কলকাতা? অসুখ-বিসুখ বাপরে বাপ! গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ, কমছে-বাড়ছে রক্তচাপ’। সমাপতন। কিন্তু গলায় স্টেথোস্কোপ-ঝোলানো এক তরুণী চিকিৎসকের উপর নির্যাতন এবং খুনের প্রতিবাদের জন্য বিরোধীদের সূতিকাগৃহ হয়ে আবার দেখা দিয়েছে কলেজ স্ট্রিট। রক্তচাপ বাড়ছে-কমছে শাসকের।