লাফিয়ে বাড়তে থাকা চিকিৎসার খরচ সামলাতে স্বাস্থ্য বিমা ছাড়া গতি নেই। অথচ সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, সম্প্রতি প্রকল্পের প্রিমিয়াম লাফিয়ে বাড়ছে। তার ধাক্কা এতটাই যে, অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী এবং প্রবীণ নাগরিকেরা স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রিমিয়ামের উপরে ১৮% জিএসটি কমিয়ে শূন্যে নামানোর উদ্যোগ যখন শুরু হয়েছে, তখন হঠাৎ প্রিমিয়াম এমন ভাবে বাড়তে শুরু করল কেন? এর ফলে ফের তা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে না কি? আরও প্রশ্ন উঠেছে, সরকার বা নিয়ন্ত্রক যখন গোটা দেশকে বিমার আওতায় আনতে চাইছে, তখন এ ক্ষেত্রে স্বল্প বাসাধারণ আয়ের মানুষদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ন্যূনতম চেষ্টাটুকুও নেই কেন?
শিল্প সূত্রের খবর, অধিকাংশ বিমা সংস্থাই প্রিমিয়াম বাড়াচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। বাকিটা শীঘ্রই বাড়বে। চলতি মাস থেকে বর্ধিত হার কার্যকর হবে বেশির ভাগ প্রকল্পে। ফলে বিমা বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, আরও কিছু মানুষ স্বাস্থ্য বিমা থেকে নাম কাটাবেন। কারণ, চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়ে যাওয়া সংসার খরচ সামলানোর পরে একাংশ চেষ্টা করেও প্রিমিয়ামের টাকা জোগাতে পারবেন না। স্বাস্থ্য বিমা এজেন্ট সৌমেন চৌধুরী জানান, ইতিমধ্যেই প্রিমিয়াম বাড়িয়ে এমন এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ৭০ বছরের প্রবীণ নাগরিকদের ৫ লক্ষ টাকার বিমার ক্ষেত্রে জিএসটি নিয়ে প্রিমিয়ামের হার ঠিক করেছে ১,০৪,৮৪৭ টাকা!
অনেক বিমা সংস্থায় ৬১-৬৫ বছরের প্রবীণদের জন্য প্রিমিয়ামের ধাপ আলাদা। সেখানেও ৫ লক্ষ টাকা বিমায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিতে হচ্ছে ৩৪,০০০-৩৯,০০০ টাকা। বিমা শিল্পের একাংশ খুব শীঘ্রই ওই শ্রেণির গ্রাহকদের প্রিমিয়াম ১০% বাড়ানোরসিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাশনাল ইনশিয়োরেন্সের জেনারেল ম্যানেজার কস্তুরী সেনগুপ্ত বলেন, “ডিসেম্বর থেকে প্রিমিয়াম বাড়াব। তবে সব প্রকল্পে নয়। লোকসান ঠেকাতে নির্দিষ্ট কয়েকটির গড়ে ৭%-৮% বাড়ানো হবে।’’ নিউ ইন্ডিয়া অ্যাশিয়োরেন্স সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহ থেকে প্রবীণদের প্রিমিয়াম বাড়ছে ১০%।
বেলেঘাটার ৮৩ বছর বয়সি জয়দেব চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, তিনি বছরে প্রিমিয়াম দিতেন ২০,০০০ টাকা। বছর দুয়েক আগে নবীকরণের সময় দেখেন তা ৩৫,০০০ টাকা হয়ে গিয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত অতি প্রবীণ জয়দেববাবু ১০ বছর প্রিমিয়াম দিয়েও বিমা প্রকল্পটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সম্প্রতি নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। পুরোটা জমানো টাকা থেকে দিয়েছেন। জয়দেবের আক্ষেপ, ‘‘আমার পেনশন নেই। স্ত্রীর চিকিৎসায় প্রচুর খরচ হয়েছে। নিজের জন্য একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম বিমা থাকায়। কষ্ট করে টাকা দিয়েছি প্রতি বছর। আর টানতে পারলাম না।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘যে ভয় পেয়েছিলাম, তার পরে সেটাই হল। ঘর থেকে লক্ষাধিক টাকা বেরিয়ে গেল।’’ তাঁর কণ্ঠে হতাশার সুর। বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে আবার অসুস্থ হলে কী হবে, বুঝতে পারছি না।’’
জয়দেবের মতো অনেকেই বলছেন, তাঁরা জানেন, বিমা না-থাকা বিরাট ঝুঁকির। কিন্তু উপায় কী! প্রিমিয়াম টানতে না পেরে প্রকল্প ছেড়েছেন ৭২ বছরের অনিন্দিতা সাহাও। মেয়ের সঙ্গে করা তিন লক্ষ টাকার যৌথ বিমা প্রকল্পে প্রিমিয়াম ৭০০০ টাকা থেকে বেড়ে ক’দিন আগে ২৪,০০০ টাকা হয়েছে। তিনি বলছেন, ‘‘এই টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই। সরকারের আমাদের মতো মানুষদের জন্য ভাবা উচিত। হাসপাতাল আর বিমা সংস্থাগুলি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে পথে বসিয়ে দিতে চায়।’’ বিমা এজেন্টদের সংগঠনের অন্যতম নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘অনেকে স্বাস্থ্য বিমা ছাড়ছেন। বিশেষত প্রবীণরা। সব থেকে খারাপ লাগছে, সারা চাকরি জীবন প্রিমিয়াম বয়ে এখন আর চালাতে পারছেন না একাংশ। অথচ বুড়ো বয়সে রোগ বেশি হয়। তখনই বিমার প্রয়োজন বেশি।’’
বিমা সংস্থার কর্তাদের যুক্তি, চিকিৎসার খরচ দ্রুত বাড়ছে বলেই বিমার দাবি মেটানোর খরচও বাড়ছে। প্রিমিয়াম না বাড়ালে বিমা ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। উপদেষ্টা প্রাইসওয়াটার হাউস কুপার্সের বিমা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সংস্থার পার্টনার ও লিডার অমিত রায় বলেন, “চিকিৎসা খরচের লাগামছাড়া বৃদ্ধিই প্রিমিয়াম বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। বিশ্বের যে সব দেশে চিকিৎসা পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি সর্বাধিক, ভারত তার অন্যতম। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে যেখানে এই হার ৭%-৮%, সেখানে ভারতে ১৪%।’’ তাঁর দাবি, এ দেশে ৫ লাখ টাকার বিমাও কম। অনেক ক্ষেত্রে ৪-৫ দিনের মধ্যে হাসপাতালের বিল ৫ লক্ষ ছাড়ায়। তাই বিমা সংস্থাগুলিও লোকসান এড়াতে প্রিমিয়াম বাড়ায়।
গ্রাহক মহলের অবশ্য প্রশ্ন, হাসপাতাল বেশি বিল করলে তার দায় মানুষকে বইতে হবে কেন? তাঁদের অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রে বিমা সংস্থা দাবির পুরো টাকাও দেয় না। খুঁটিনাটি নিয়ে আপত্তি তোলে। এমনকি, বিমা থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগটা ঘর থেকে দিতে হয়েছে— এমন ঘটনাও ঘটে।
কেন্দ্র ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশের সকলকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনারলক্ষ্য স্থির করেছে। অথচ চড়া প্রিমিয়ামের ধাক্কায় গ্রাহক কমছে। নতুনদের একাংশও পলিসি কেনার আগে বহু বার ভাবছেন। অমিতের মতো বিমা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এখন এমন এক নিয়ন্ত্রক দরকার, যাঁরা নজরদারি করে হাসপাতালগুলিতে অযথা চিকিৎসা বিল বৃদ্ধিতে রাশ টানতে পারবে। সেই সঙ্গে দেখাশোনা করবে স্বাস্থ্য বিমা পরিষেবার খুঁটিনাটি। রোগীর বিমা আছে জানলে বহু হাসপাতাল চিকিৎসার খরচ বাড়িয়ে দেয় বা অপ্রয়োজনীয় ভাবে বিল বাড়ানোর ব্যবস্থা করে, অভিযোগ বিমা বিশেষজ্ঞ জীবন বিমা নিগমের বিপণন বিভাগের প্রাক্তন আঞ্চলিক কর্তা অরূপ দাশগুপ্তের। তিনি বলেন, “এটা বন্ধের ব্যবস্থা জরুরি। তা ছাড়া, কেন্দ্র ও অধিকাংশ রাজ্যই শুধু নিম্নবিত্তদের জন্য কম খরচের বা নিখরচার বিমা প্রকল্প আনে। এখন এমন সুবিধা মধ্যবিত্তদেরও দেওয়া দরকার।’’