‘হায় রে পোড়া বাঁশি, রইতে দিল না ঘরেতে’! এ বাঁশির সুরও খানিকটা যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো! সুরের মূর্ছনায় যেন ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা! একাধিক গল্পের মায়াবী আলোকেও ভেসে যাওয়া শান্তির পথে। দমদম স্টেশনের (Dumdum Station) বাঁশিওয়ালাও (Flute Player) ঠিক তেমন। নিত্যযাত্রীদের ভিড়ে তিনিই যেন কৃষ্ণ (Krishna) ! রাজার আদেশে তিনিই যেন এ যুগের হ্যামলিন! ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় অথবা কোনও স্টেশনে!PauseUnmute
ব্যস্ততম দমদম স্টেশনের সাবওয়ে ঠিক যেখানে শুরু হয় সেখানেই অর্থাৎ কলকাতা মেট্রো পরিসরের সূচনায় দেখা মেলে এই ‘বাঁশি বুড়ো’র। এক চিলতে জায়গায় নিত্যযাত্রীদের আনাগোনার মধ্যেই বসে থাকেন পূর্ব বর্ধমানের (Purba Bardhaman) মন্তেশ্বরের (Manteswar) অনিলকুমার মোহন্ত (Anil Kumar Mohanta) । আগে নিয়মিত কলকাতা আসতেন তিনি।
এই প্রবীণ বয়সেও দমে যাননি বছর ৬৭-র অনিল। দুই সন্তানের বাবা আজও বাঁশির টানে পাড়ি দেন তিলোত্তমায় (Kolkata) । ভিড় ট্রেনে কলকাতা আসেন। দমদম স্টেশনের পরিচিত সাবওয়েতে বসেই হিল্লোল তোলেন বাঁশির সুরে। তাঁর শিল্পের প্রদর্শনে বিমুদ্ধ হন বহু। শিল্পীর প্রকাশে দাঁডিয়ে পড়েন কেউ কেউ। কিন্তু ”একটু চা খাওয়াবেন!” কাউকে বাঁশি শুনতে দেখলেই এই প্রশ্নই করে বসেন বাঁশিওয়ালা! কেন?
অনিলের কথায়, ”বাঁশি বাজায় রোজ কিন্তু পেট চলে না আর! সারাদিন বসে থাকি! আগে অনেকেই কিনতেন, এখন আর বাঁশি কেনেন না কেউ!” বলতে বলতে চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে জল। তাঁর কথায়, ”বয়স হয়েছে আর পারি না রোজ কলকাতা আসতে। এখন মাঝে মাঝে আসি। এখানে থাকি বসে। আর রাতে…!” শিল্পী জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন প্রবীণ অনিল। বাঁশির সঙ্গেই কাটিয়েছেন বহু বসন্ত। তবে কলকাতায় কোনও ঘর নেই তাঁর! দিনে স্টেশন, আর রাত হলেই ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুনশান কলেজ স্ট্রিটে শুয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালা (Flute Player) । এত কষ্টের পরেও কেন বিক্রি করেন বাঁশি? শিল্পীর (Pieper) জবাব, ”আমি সুর ভালবাসি। বাঁশিতেই খুঁজে পাই বেঁচে থাকার রসদ। তাই একাজ আজও করে চলি। পেটে খাবার না থাকলেও আমৃত্যু বাঁশি নিয়েই বাঁচতে চাই!”
মাঝে মাঝে ফেরেন বাড়িতে। বর্ধমানের সেই বাড়িতে বসেই কয়েকটা বাঁশি তৈরি করেন এই শিল্পী। তারপর কাঁধের ঝোলায় বন্দি হয়ে সেই বাঁশি কখনও পাড়ি দেয় রবীন্দ্রসদন চত্বর, কখনও তা সাময়িকভাবে বাসা বাঁধে দমদম স্টেশনে। অনিলের কথায়, ”যখন মেট্রো (Kolkata Metro) শুরু হয়নি তখন সব সময় রবীন্দ্রসদনে (Rabindra Sadan) থাকতাম। এখন দমদম ছেড়ে শুধু শনিবার বিকেলে যাই নন্দন চত্বরে (Nandan Kolkata)। সেখানেও তেমন একটা বিক্রি হয় না বাঁশি।” শুধু হতাশা আর শিল্পের বশবর্তী হয়েই এগিয়ে যান বৃ্দ্ধ। এত লড়াইয়ের পরেও পেশাবদল করেননি কেন? শিল্পীর জবাব, ”মাকে ভালবাসেন, তাঁর জন্য স্বার্থ দেখেন আপনি! আমিও তাই, এই জিনিস জীবনেও ছাড়তে পারব না!” বর্ধমান, নদিয়া, কলকাতায় ছাত্রও রয়েছে তাঁর। যাঁরা বাঁশি শেখেন ‘অনিল স্যরে’র কাছে। তা থেকেই হয় সামান্য রোজগার! শিল্পী আক্ষেপের সুরে বলছেন, ”কেউ কেউ ভালবেসে খেতে দেন। কেউ টাকা দিয়ে যান। এভাবে হাত পেতেই চলে আমার বাঁশির জীবন!”
লড়াই আছে প্রবল। তবুও বেঁচে থাকার রসদকে অমূল্য করে তোলার প্রয়াস আজও রয়েছে শিল্পী অনিলকুমার মোহন্তর জীবনে। তাই কোটি কোটি জনতার ভিড়ের শব্দেও বাঁশির সুরে যেন এক আকাশ সুখ কিনতে চান এই বাঁশিওয়ালা! কী সম্ভব, কী সম্ভব নয়, তা তিনি জানেন না। শুধু জানেন এভাবেও বেশ ভাল থাকা যায়!