৮৭.৫৮। ভারতের খেলাধুলোর ইতিহাস এই চারটি সংখ্যা হয়তো সারাজীবন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিন বছর আগে টোকিয়োর এক রাতে ঠিক এই দূরত্বেই গিয়ে পড়েছিল নীরজ চোপড়ার বর্শা। তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। প্রতিভাবান থেকে রাতারাতি খ্যাতনামী হয়ে উঠেছিলেন নীরজ। গোটা দেশ এবং বিশ্বে তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়েছিল। দেশে ফেরার পর আনন্দের আতিশয্যে কয়েক মাস অনুশীলন করতেই পারেননি।
তবে খেলাধুলোর সঙ্গে যাঁরা নিবিড় ভাবে যুক্ত তাঁরা বলছেন, রাতারাতি খ্যাতনামী হওয়া সহজ কাজ। কিন্তু সেটা ধরে রাখাই আসল পরীক্ষা। যে উচ্চতায় পৌঁছনো গিয়েছে, সেই উচ্চতায় টিকে থাকার যোগ্য কি না, তা বোঝাও দরকার। গোটা দেশ এবং বিশ্বকে সেটা বোঝাতেই বর্শা হাতে আবার অলিম্পিক্সে নামছেন নীরজ। এ বার স্তাঁদ দ্য ফ্রাঁসে নিজেকে ফের প্রমাণ করার পালা। গত বারের সোনাজয়ী এ বারও পদকের রং একই রাখতে পারলে নিঃসন্দেহে ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ হয়ে যাবেন। পদকের রং বদলালে বা ফস্কালে তাঁকে নিয়ে কাটাছেঁড়া চলবেই। সমালোচনার তীর ধেয়ে আসবে প্রবল বেগে।
তিন বছর আগের সেই টোকিয়োর রাতের পর মানুষ হিসাবে অনেকটাই বদলে গিয়েছেন নীরজ। সেই অলিম্পিক্সের কয়েক মাস পরেই ফিরে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। কোচের কাছে নিজেকে অনুশীলনে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুশীলন করেছিলেন। অলিম্পিক্সে সোনা জয় যে ‘ফ্লুক’ ছিল না, তার প্রমাণ মিলেছে বার বার। ২০২২ সালে প্রথম বার ডায়মন্ড লিগে সোনা জেতেন। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন। অর্থাৎ প্যারিসে নীরজ নামবেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন এই দুই তকমা নিয়েই।
তবে নীরজের প্রস্তুতি খুব একটা ভাল হয়নি। এ বছর মাত্র তিনটি প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তিনি। ২০২৪-এর বর্শা ছোড়ার দূরত্বের নিরিখে তিনি চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। কাঙ্ক্ষিত ৯০ মিটার দূরত্ব এখনও অতিক্রম করতে পারেননি।
অলিম্পিক্সে নীরজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চলেছেন চেকিয়ার ইয়াকুব ভাদলেই। সাম্প্রতিক কালে প্রায় প্রতিটি ইভেন্টেই নীরজকে লড়তে হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বুদাপেস্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নীরজ সোনা জেতার পর ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন ভাদলেই। এ বছর দোহায় ডায়মন্ড লিগে নীরজের থেকে ২ সেন্টিমিটার বেশি বর্শা ছুড়ে সোনা জিতেছেন। ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সেরা হয়েছেন। ৯০ মিটারের বেশি দূরত্বে জ্যাভলিন ছোড়ার নজিরও রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানির জুলিয়ান ওয়েবার। শারীরিক ভাবে শক্তিশালী এবং চমক দিতে অভ্যস্ত। গত অলিম্পিক্সে চতুর্থ হয়েছিলেন। ইউরোপে দ্বিতীয় সেরা। চাপ থাকবে জার্মানির ম্যাক্স ডেনিংকে নিয়েও। এ বছর জ্যাভলিনে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছেন তিনিই। জার্মানির হালের একটি ইভেন্টে ৯০.২০ মিটার বর্শা ছুড়েছিলেন। যদিও পরের দিকে সেই ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি। ৭০ বা ৮০ মিটারের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছেন। যে হেতু এক বার ৯০ মিটারের বেশি ছুড়েছেন, তাই তাঁকে হিসাবের বাইরে রাখা যাবে না।
পুরনো ‘শত্রু’ অ্যান্ডারসন পিটার্সও নীরজকে টক্কর দিতে প্রস্তুত। পেশাদার জীবনে চার বার ৯০ মিটারের বেশি ছুড়েছেন। ২০২২ সালের অগস্টে একটি বোটে পার্টি করতে গিয়ে পাঁচ নাবিকের হাতে মার খেয়েছিলেন পিটার্স। সেই ঘটনায় ভাল রকম চোট পেয়েছিলেন। তা সারিয়ে সার্কিটে ফিরেছেন। পুরনো ছন্দও আস্তে আস্তে ফিরে পাচ্ছেন।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো পাওয়া পাকিস্তানের আর্শাদ নাদিমের সঙ্গেও নীরজের লড়াই রয়েছে। এ বছর শুধু প্যারিস ডায়মন্ড লিগে অংশ নিয়েছেন তিনি। নীরজ না পারলেও আর্শাদ ইতিমধ্যেই ৯০ মিটারের বেশি দূরত্বে বর্শা ছুড়েছেন। এ ছাড়া ফিনল্যান্ডের অলিভার হেলান্ডার, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর কেশর্ন ওয়ালকটেরাও রয়েছেন।
এটা ঠিকই, অলিম্পিক্সে কোনও লড়াই সোজা হয় না। সেরাদের হারিয়েই সোনা জিততে হয়। টোকিয়োয় নীরজ সেটা করে দেখিয়েছেন। প্যারিসে পারবেন কি না, তা সময়ই বলবে।