‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানটি বিভেদের ; ‘মজদুর দুনিয়াকে এক করো’ স্লোগানটি মিলনের।

সত্যিই আজ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হোক বা বিজ্ঞানী বা নৃত্যশিল্পী বা কোনো এক লেখক — দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষকে এক করেছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান বেড়ে ভারতবর্ষের মন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠিত করছে — বসুধৈব কুটুম্বকম।
যে মজদুর ভারতবর্ষের ল্যাবোরেটরিতে করোনার ভ্যাক্সিন তৈরি করলো, তিনি ব্রাজিলের মজদুর কে দেখেন নি কিন্তু তার শ্রম ভারত-ব্রাজিলের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন তৈরি করে দিল।আপন আপন সংস্কৃতি নিয়ে তারা আছেন কিন্তু তারা সেই তথাকথিত ‘থিসিস’ কে জিইয়ে রেখেই ‘আন্তর্জাতিক’ । জাতীয়তাকে ভেঙে ‘আন্তর্জাতিক’ হতে হয় নি।
ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুর্কির জন্য ভারতীয় ডাক্তার, বিপর্যয় মোকাবিলার দল তুর্কি পৌঁছে গেলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে, তাদের শ্রম দিয়ে তুর্কির ভারত-বিরোধিতা সত্ত্বেও মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিলেন। কই নিজের দেশের গন্ডীর মধ্যে থেকেই তুর্কির মানুষ ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’-র বাস্তবিক রূপটি দেখতে পেলো।
নিজের দেশের সংস্কৃতির বিরোধিতা করে কেউ এক হয় নি কিন্তু দেশের সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই দুনিয়াকে এক করতে পেরেছে।
শুধু মজদুর এক হবে আর মালিক ? কার বিরুদ্ধে এক হবে? কেনো হবে?
এখন যে কম্পিউটারের সফটওয়্যার তৈরি করে সেও কি মজদুর নয়? শুধু কায়িক শ্রম মজদুরি নয়।
বৌদ্ধিক শ্রম প্রয়োগ করে কায়িক শ্রম কমানোতেই কি বিজ্ঞানের সাফল্য ধরা হয় না?

পুঁজি না থাকলে একটি বড় শিল্প, বড় নিয়োগ কখনোই হতে পারে না।পুঁজি আসবে কায়িক বা বৌদ্ধিক শ্রমের ফলে উৎপন্ন লাভ থেকে।লভ্যাংশ কে সবসময় যদি শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় তাহলে নতুন প্রয়োগ হবে কি করে?
নদীর জল বাঁধ দিয়ে ধরে রেখে প্রয়োজনের সময় ছেড়ে দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় ঠিক তেমনি অর্থ মজুদ করে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।পুঁজি, তাই খারাপ নয় ; খারাপ হচ্ছে পুঁজিবাদ। সাম্য খারাপ নয় কিন্তু সেই সাম্যের নামে পাখির আকাশে ওড়া আর মাছের সাঁতার কাটাকে এক বলে তাকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বললে কম্পিউটার ব্যবহার করা প্রজন্ম সহজে মেনে নিবে না।
বর্তমান প্রজন্ম, এখন বাড়িতে বসে মোবাইলের এ্যাপ তৈরি করছে আর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ নামে একসময় কম্পিউটারের বিরোধিতা করা হয়েছে।
তারা সবসময়ই দেশের সংস্কৃতি, প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভাঙতে ‘অ্যান্টি থিসিস’ দেয় আর ভাবে কিছু একটা ‘সিন্থেসিস’ হয়ে যাবে কিন্তু প্রায় ১০০ বছরে মার্ক্সবাদ কিছুই দিতে পারেনি ভারতবর্ষে।

দিয়েছে শুধু তোষণ, ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের সংস্কৃতির বিরোধিতা।

মার্ক্সবাদ শুধু অর্থকেই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে গিয়ে ভারতবর্ষের দান ও ভক্তিকে বুঝতে পারে নি। সমস্ত সম্পদের অধিকারী হয়েও ভারতবর্ষে রাজারা কেনো গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েছে , কেনোই বা সর্বজ্ঞ পন্ডিত গরীবের কুটীর থেকে তুলে এনে শাস্ত্র-শস্ত্রের জ্ঞান দিয়ে একজনকে বিশ্বজয়ী সম্রাট করে নিজে সমস্ত ভোগ থেকে দূরে থাকে ।
কোন উদ্দেশ্যে নিমাই পন্ডিত গৃহসুখ ত্যাগ করে ভক্তির গঙ্গা বইয়ে দেয় , কোন উদ্দেশ্যে এক ১২ বছরের কিশোর পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে তর্কে বড় বড় পন্ডিতদের পরাজিত করে ভারতবর্ষের চারপ্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে, কোন উদ্দেশ্যে এক ৩২ বছরের ‘শিক্ষিত’ যুবক অনাহারে থেকে, গতানুগতিক জীবন ত্যাগ করে ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি-সভ্যতার মহানতা বিশ্বমঞ্চে শোনাতে যায় , কি পাওয়ার জন্য একজন ঔষধ ব্যবসায়ী , সমস্ত কিছু ত্যাগ করে ৬০ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হয়ে ‘কৃষ্ণনাম’ ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে—- এসবের উত্তর দিতে পারে না ‘মার্কসবাদ’ যাকে এই বিদেশীয় তত্ত্বের সমর্থকরা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করেন।
এ যে শুধু ভারতবর্ষেই সম্ভব, বারবার সম্ভব, কয়েক হাজার বছর ধরে সম্ভব।
ভারতবর্ষ কে ইউরোপীয় চশমা দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে না, ভারতবর্ষ কে বুঝতে হলে ভারতীয় দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে।

যারা সারা বিশ্বে কৃষক – শ্রমিক দরদী সেজে রক্তাক্ত বিপ্লবের আহ্বান করে, তারা বিভিন্ন দেশে কৃষক-শ্রমিকদের গণহত্যা করেছে।
জোসেফ স্তালিন , কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়ার স্বৈরাচারী নায়ক( ১৯২৪-৫৩)।
পার্জ , হলডোমোর ও গুলাগ — এই তিনটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে মানব ইতিহাসের এক নৃশংসতার অধ্যায় এবং মতাদর্শের নামে মানবতার হত্যার করুণ কাহিনী।
কমিউনিস্টদের সহানুভূতি পেতে হলে ‘সর্বহারা’ হতে হবে। সোভিয়েত রাশিয়ায় যে সমস্ত কৃষকদের হাতে বেশি জমি থাকতো তাদের ‘কুলাক’ বলা হতো। জোর করে যৌথ খামার পদ্ধতিতে চাষ করানোর বিরোধিতা যারা করেছিল তাদের কপালে জুটেছিল অকথ্য অত্যাচার।১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর এই গণহত্যা নিয়ে মুখ খোলা শুরু হয়।
সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর বিভিন্ন স্থানে জনসমাধি খুঁজে পাওয়া যায়। সেই স্থানগুলিতে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।দি গ্ৰেট পার্জ ( The Great Purge) বা চরম সন্ত্রাস ( ১৯৩৬ – ৩৮ ) নামে কুখ্যাত এই হত্যালীলায় এইসময় কুলাক ( বড় কৃষক) , বুদ্ধিজীবী, বলশেভিক পার্টির নেতা , পার্টির মধ্যেকার বিরোধীদের হত্যা করা হয়। সংখ্যা শুনলে শিউড়ে উঠতে হয় — প্রায় ১০লক্ষ ৫০ হাজার ( গুগল সার্চ করলে সহজেই তথ্য পাওয়া যাবে)। যৌথ খামারে চাষিদের পরিশ্রম করার ইচ্ছা কমে যায় যা নিজের মালিকানাধীন জমিতে থাকে তার তুলনায়। স্বাভাবিক পরিণতি দেশের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু দেশের খাদ্যশস্য রপ্তানি করে যে শিল্পের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করতে হবে। তাই সর্বহারাদের নেতা স্তালিন দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে খাদ্যশস্য রপ্তানি করলেন , মজুদ করলেন সাধারণ মানুষকে ভুখা রেখে। তাদের ‘ভাত দে’ আর্তনাদ কমিউনিস্ট সরকারের মনে দয়া সৃষ্টি করতে পারে নি। দেশের ভেতরে বিদ্রোহ দমন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে বিশ্বনেতা হতে স্তালিনের প্রয়োজন ছিল বিশাল সেনাবাহিনীর আর তাদের জন্য প্রচুর খাদ্য। সেই খাদ্য জমা করতে গিয়ে ইউক্রেনের কৃষক যারা সেই খাদ্যশস্য উৎপাদন করলেন তারাই অনাহারে মারা যেতে লাগলেন। খিদের জ্বালায় ইউক্রেনের মানুষ আমিষের দিকে ঝুকলো, এমনকি মানুষকে ‘মানুষ খেকো’ বানিয়ে দিয়েছিল ইউক্রেনের এই কমিউনিস্ট সরকারের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ।স্তালিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ইতিহাসের এই করুণ অধ্যায় হলডোমোর ( ১৯৩০-৩৩) নামে পরিচিত। স্তালিনের আমলে দ্রুত শিল্পায়ন হয়েছে সত্য কিন্তু দ্রুত শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক আসবে কোথা থেকে ? শ্রমিক দরদী কমিউনিস্ট সরকার তৈরি করলেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বন্দী শিবির। বন্দীদের থেকে জোর করে শ্রম করানো হতো। এই তবে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ ? প্রতিবছর প্রায় সর্বনিম্ন ৫ লক্ষ থেকে সর্বাধিক ১৭ লক্ষ বন্দীকে গুলাগ ক্যাম্পে (১৯৩০ – ৫০) রাখা হয়েছিল।মোট প্রায় ১৫ – ১৭ লক্ষ মানুষকে গুলাগের কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
ভাবতেও অবাক লাগে এই পশ্চিমবঙ্গে যেখানে রামকৃষ্ণ – বিবেকানন্দের মতো মহাপুরুষ জন্মগ্ৰহণ করেছেন যারা সেবার মাধ্যমে মনুষ্য চরিত্র পরিবর্তন করে সমাজ পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছেন সেখানে স্তালিনের মতো নরখাদকের পূজারী থাকতে পারে? যে লাল সন্ত্রাস একসময় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়াকে এক বড় কারাগারে পরিণত করেছিল তার সমর্থক থাকতে পারে?
মানুষকে শুধুমাত্র অর্থের পেছনে ছুটতে থাকা জীব মনে করে যারা সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে শ্রেণী সংগ্রামের জন্য উস্কে দেয় তাদের থেকে বড় ‘সাম্প্রদায়িক’ কে আছে?
সোভিয়েত রাশিয়ায় লেনিন – স্তালিন, চীনে মাও , কম্বোডিয়ায় পল পটের হত্যালীলা দেখলেই বোঝা যায় কৃষক-মজদুরদের হিতৈষী সেজে কিভাবে দেশে দেশে সেনানায়ক ক্ষমতা দখল করেছে যেখানে মানুষের প্রাণের মূল্য নেই, তার মতামতের মূল্য নেই।
ভারতবর্ষের মানুষ বেছে নিয়েছে রামকৃষ্ণ -বিবেকানন্দের সাম্যের পথ , আধ্যাত্মিকতার সাহায্যে মানুষের ভেতরে শুভবুদ্ধি জাগ্ৰত করে সমাজ পরিবর্তনের পথ। সেই পথ লাঙ্গল চালানো কৃষকের রক্তে রঞ্জিত নয় , সেনানায়কের গুলিতে প্রাণ হারানো শ্রমিকের শবদেহ সেই পথে থাকে না।বিধাতা কমিউনিজমের এই রক্তাক্ত ইতিহাসের মাঝে সঠিক পথটি চিনিয়ে দিতেই কি ১লা মে কে বেছে নিয়েছিলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশনে’র প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে!

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.