স্বামীজী ছিলেন বহু প্রতিভাধর। তিনি ইতিহাস চর্চাও করেছেন, মতামত দিয়েছেন গ্রন্থতত্ত্ব বিষয়েও। তাঁর মতে ইতিহাস যা হয় লিখলেই সেটা সত্য হয় না। এককালে অনেক কথা কল্পনা থেকে লেখা হতো। কারণ পৃথিবী সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের দীনতা ছিল। তাই অনেক বিষয়ে সত্যাসত্য নির্ধারণে সন্দেহ জন্মায়। কোনও একটি বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার উপায় হিসাবে তিনি কয়েকটি সূত্র তুলে ধরেন। তিনি লিখছেন,
“১. মনে কর, একজন গ্রিক ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, অমুক সময়ে ভারতবর্ষে চন্দ্রগুপ্ত বলে একজন রাজা ছিলেন। যদি ভারতবর্ষের গ্রন্থেও ওই সময়ে ওই রাজার উল্লেখ দেখা যায়, তাহলে বিষয়টা অনেক প্রমাণ হলো বইকি। যদি চন্দ্রগুপ্তের কতকগুলো টাকা পাওয়া যায় বা তার সময়ের একটা বাড়ি পাওয়া যায়, যাতে তার উল্লেখ আছে, তা হলে আর কোনও গোলই রইল না।
২. মনে কর, আবার একটা পুস্তকে লেখা আছে যে একটা ঘটনা সিকন্দর বাদশার সময়ের, কিন্তু তার মধ্যে দু-এক জন রোমক বাদশার উল্লেখ রয়েছে। এমনভাবে রয়েছে যে প্রক্ষিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়—তা হলে সে পুস্তকটি সিকন্দর বাদশার সময়ের নয় বলে প্রমাণ হলো।
৩. তৃতীয় উপায় ভাষা। সময়ে সময়ে সকল ভাষারই পরিবর্তন হচ্ছে, আবার এক এক লেখকের এক একটা ঢঙ থাকে। যদি একটা পুস্তকে খামকা একটা অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনা লেখকের বিপরীত ঢঙে থাকে, তা হলেই সেটা প্রক্ষিপ্ত বলে সন্দেহ হবে।…
৪. তার উপর আধুনিক বিজ্ঞান দ্রুত পদসঞ্চারে নানা দিক হতে রশ্মি বিকিরণ করতে লাগলো; হল— যে পুস্তকে কোনও অলৌকিক ঘটনা লিখিত আছে, তা একেবারেই অবিশ্বাস্য হয়ে পড়ল।
৫. মহাতরঙ্গরপ সংস্কৃত ভাষার ইউরোপে প্রবেশ এবং ভারতবর্ষে, ইউফ্রেটিস নদীতটে ও মিসরদেশে প্রাচীন শিলালেখের পুনঃপঠন; আর ভূগর্ভে বা পর্বতপার্শ্বে লুক্কায়িত মন্দিরাদির আবিস্ক্রিয়া ও তাহাদের যথার্থ ইতিহাসের জ্ঞান।
স্বামী বিবেকানন্দের ইতিহাস চেতনার বিশ্লেষণ করতে দেখা গেছে বিমান বিহারী মজুমদারকে। তিনি মত প্রকাশ করেছেন, অ্যারিস্টটলের মতো তিনি ঐতিহাসিক প্রণালীতে তথ্য সংগ্রহ করে তার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত স্থাপন করেছেন। স্বতঃ প্রামাণ্য বলে কিছু ধরে তা থেকে কোনও সিদ্ধান্ত টানা তার রীতি ছিল না। তিনি সন্ধানী আলো ফেলে অতীতকে উন্মোচন, বর্তমানকে বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দিগদর্শন করেছেন।
স্বামীজীর বক্তব্য ছিল, আকর গ্রন্থ পড়তে হবে। এ প্রসঙ্গে নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা তুলেছেন। তিনি মাসপেরো নামক এক ফরাসি পণ্ডিত তথা মিশর প্রত্নতাত্ত্বিকের মিশর ও ব্যাবিলনের ইতিহাস (Historie Ancien Oriental) পড়েছিলেন একজন ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিকের ইংরেজি তর্জমায়। পরে সে বিষয়ে আরও অনুধ্যান করতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গেলে, অধ্যক্ষ তাকে বললেন, তর্জমা পড়লে হবে না, মূল গ্রন্থ ফরাসি ভাষাতেই পড়তে হবে। কারণ অনুবাদক একজন গোঁড়া ক্রিশ্চান। খ্রিষ্টধর্মকে আঘাত করে এমন অংশ তিনি গোলমাল করে দিয়েছেন। স্বামীজী বুঝলেন ধর্মের গোঁড়ামি সত্যাসত্য তাল পাকিয়ে দেয়। তাই গবেষণা গ্রন্থের তর্জমার উপর তাঁর শ্রদ্ধা কমে যায়। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল, গবেষণাবিদ্যা বাইবেল, নিউ টেস্টামেন্টকে আলাদা রেখেছে। কারণ এককালের মারধোর, জ্যান্ত পোড়ানোর ভয় এখন না থাকলেও সমাজের ভয় কাজ করেছে।
সুন্দরবন প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ
‘পরিব্রাজক’ (ভারত : বর্তমান ও ভবিষ্যত) গ্রন্থে লিখেছেন, “সোঁদরবন পূর্বে গ্রাম নগরময় ছিল, উচ্চ ছিল। অনেকে এখন ও কথা মানতে চায় না। এই সকল স্থানেই পোর্তুগিজ বম্বেটেদের আড্ডা হয়েছিল, আরাকানরাজের এই সকল স্থান অধিকারের বহু চেষ্টা, মোগল প্রতিনিধির গঞ্জালেজ প্রমুখ পোর্তুগিজ বম্বেটেদের শাসিত করবার নানা উদ্যোগ, বারংবার ক্রিশ্চান, মোগল, মগ, বাঙ্গালির যুদ্ধ।”
স্বামী বিবেকানন্দ লিখছেন (পরিব্রাজক মনসুন : এডেন), “এখন প্রত্যেক শক্তিমান জাতির যুদ্ধপোতনিচয় পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।…সুয়েজ খাল হচ্ছে এখন ইউরো-আশিয়ার সংযোগ স্থান। সেটা ফরাসিদের হাতে। কাজেই ইংরেজ এডেনে খুব চেপে বসেছে, আর অন্যান্য জাতও রেড-সীর ধারে ধারে এক একটা জায়গা করেছে। সাতশো বছরের পর পদদলিত ইতালি কত কষ্টে পায়ের উপর খাড়া হয়ে, হয়েই ভাবলে—কী হলুম রে! এখনি দিগ্বিজয় করতে হবে। ইউরোপের এক টুকরোও কারুর নেবার জো নাই; সকলে মিলে তাকে মারবে! এখন বাকি আছে দু-চার টুকরো আফ্রিকার। ইতালি সেই দিকে চলল। প্রথমে উত্তর আফ্রিকায় চেষ্টা করলে। সেথায় ফ্রান্সের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এল। তারপর ইংরেজরা রেড-সীর ধারে একটা জমি দান করলে।”
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী