অভিরাম দাসের স্বপ্নে বাবরি মসজিদের মধ্যে রামচন্দ্রের আবির্ভাব হওয়ার কথা শুনে সিটি ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী গুরুদত্ত সিংহ বলেছিলেন — ‘আরে ভাই, তুমি এই স্বপ্ন আজ দেখছ? আমি তো কবে থেকেই এই স্বপ্নটাই দেখে আসছি।’

অযোধ্যার এক সাধু এবং এক প্রশাসক বাবরি মসজিদের গর্ভে শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাবের স্বপ্ন দেখছিলেন। হয়তো বিধাতাই দুজনকে এক করে দিয়েছিলেন। আজ রাজনীতির চক্করে পড়ে লোকে অভিরাম দাস বাবাজ্বির নাম ভুলে গেছে, গুরুদত্ত সিংহকে ভুলে গেছে। মনে নেই কে কে নায়ারের নামটাও।

ওহ, কে কে নায়ারকে নিয়ে তো বলাই হয়নি। তাই না?

কে কে মুহম্মদের নামটা পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং তার সূত্র বাইরে আনার জন্যে বারে বারে উঠেছে অযোধ্যার ক্ষেত্রে, কিন্তু প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছেন আরেক মালায়ালি কে কে নায়ার। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ নায়ার সাহেব ছিলেন তৎকালীন (১৯৪৯) ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বাবরির গর্ভে রামলাল্লার প্রকট হওয়ার আগে নাকি গুরুদত্ত সিংহ সাহেবের বাড়ি রাম ভবনে একটা মিটিং বসেছিল। উপস্থিত ছিলেন কে কে নায়ার, সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ শ্রী কৃপাল সিংহ, বিচারক ঠাকুর শ্রী বীর সিংহ। জেলার তাবড় সব রথী – মহারথীর সেই সান্ধ্য আসরে হয়তো রামচন্দ্রের আবির্ভাবের স্বপ্নটাই আলোচনা করেছিলেন ধর্মপ্রাণ গুরুদত্ত সিংহ।

কে কে নায়ার নিজেও ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। হিন্দু মহাসভার প্রতি একটা সফট কর্নার ছিলও। যে রাতে রামলাল্লা আবির্ভূত হন, সেইদিন নায়ার সাহেব ছুটিতে ছিলেন। তবে তিনি হেডকোয়ার্টার (ফৈজাবাদ) লিভ করেননি। তাই ২২/২৩শে ডিসেম্বরের ওই ঘটনার খবর যখন গুরুদত্ত সিংহ পান, তখন তা কে কে নায়ারকে দেওয়াটাও অত্যাবশ্যকীয় ছিল।

সাইকেলে চড়ে এক মেসেঞ্জার খবর নিয়ে গেল কে কে নায়ারের কাছে — বাবরির মধ্যে রামলাল্লার মূর্তি প্রকট হয়েছে। হিন্দুরা বাইরে যজ্ঞ করছে, নাম সংকীর্তন আরম্ভ করেছে। পুলিশ কনস্টেবল ডেপ্লয় করা হলেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। পুলিশকে শুধুমাত্র হাওয়াতে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হলেও পুলিশ গুলি চালিয়েছে। একজনের পেটে আর একজনের পায়ের বুড়ো আঙুলে গুলি লেগেছে।

কে কে নায়ার ভোর চারটে নাগাদ পৌঁছান। কিন্তু তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে খবরটা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে দেন সকাল সাড়ে দশটায়। পন্থ সাহেব প্রধানমন্ত্রী নেহরুজির সঙ্গে কথা বলেন। নেহরুজির নির্দেশ ছিল মূর্তি সরিয়ে ফেলতে হবে। সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পন্থ সাহেব সেই কথাই বলেন আধিকারিকদের। কে কে নায়ার আদেশ পালন করাতে কোনো আগ্রহ দেখাননি। নেহরুজির পক্ষ থেকে আবার টেলিগ্রাম আসে। এবারে কে কে নায়ার অফিসিয়াল নোট দিয়ে লেখেন — ‘বিফোর রিমুভিং দ্য আইডলস, আই শুড বি রিমুভড…’। তবে কে কে নায়ারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়নি। তারপরের বাবরি ধ্বংস থেকে আরম্ভ করে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অনুসন্ধান কিংবা বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মহা সংঘর্ষে শ্রীরামমন্দিরের পক্ষ রায়দান সবার জানা। আমার কাজ ছিল আজকের রাজনৈতিক রামনামের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া নামগুলোকে তুলে আনা। সেটুকুই সারলাম।

এখানে একটা কথা না-বললেই নয়। পাঠকদেরও ভাবা দরকার। নেহরুজি যত বড় পলিটিসিয়ান ছিলেন, তার থেকেও বড় ছিল তাঁর স্টেটসম্যানশিপ। অযোধ্যা আগামীদিনে ভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে তা বুঝেই পন্থকে বলেছিলেন যে, ভারতের বুকে দুটো কাঁটা বিঁধে রইল। এক, কাশ্মীর সমস্যা। দুই, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ। নিজের ব্যস্ততার কারণে (!) তিনি অযোধ্যায় গিয়ে সব নিষ্পত্তি করবেন বলেও আর সেই যাওয়াটা হয়ে ওঠেনি। সত্যিই কি এতোটাই ব্যস্ত থেকে গিয়েছিলেন নেহরুজি বছরের পর বছর? নাকি আন্তরিক ইচ্ছাটা অন্য কিছুই ছিল? কেনই বা দুর্গাশক্তি ইন্দিরাজি নিজের সময়ে রামলাল্লাকে নিয়ে ঘাঁটাতে চাননি? কেনই বা ইন্দিরা-তনয় রাজীব গান্ধী দেওরাহা বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলেন যে রামমন্দির নিয়ে কী হবে এবং দেওরাহা বাবার কথা শুনে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা মসজিদ/ মন্দিরের তালা খুলিয়েছিলেন? কেনই বা বাবরি ধ্বংস হয়েছিল নরসিমা রাওয়ের আমলে? আর কেনই বা মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদীজি কর্তৃক ভূমিপূজার পরে রাজীব তনয় ও তনয়ার টুইট বার্তা এল শ্রীরামের গুণগান করে? অজস্র প্রশ্ন। শুধু কি রাজনীতি? রামনীতি কি এখানে রাজনীতিকে ছাপিয়ে যায়নি? এক আক্রমণকারী কোনো এক সময়ে এসে রামচন্দ্রের অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু সে-ও বোঝেনি যে রামের থেকে রামের নাম বড়। সেই আক্রমণকারীর গড়ে তোলা সৌধখানি আজ নেই। তার ঠিকুজি কুলুজিও লোকে ভুলে গেছে। আজ শত যুদ্ধের শেষে ভারতভূমির সত্য একটাই — শ্রীরামচন্দ্র। রাম সে বড়া হ্যায় রাম কা নাম!

অভীক মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.