‘এক পবন, এক হি পানি, এক জ্যোতি সংসারা
এর হি খাক ঘরে সব ভাণ্ডে একি সৃজন হারা
এক বায়ু একটাই সূর্য। এক মাটিতে গড়া নশ্বর দেহ, একজনই সৃজনকর্তা। এক ওঙ্কার সত্যনাম পরমপুরুষের কীর্তনেই আস্থা ছিল তাঁর। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, সে তো ঈশ্বরের সৃষ্টি চরম অবমাননা। তাঁর প্রবচন দূর করেছিল সামাজিক বৈষম্য। তিনি শ্রী গুরু নানকদেব।
গুরু নানকদেব ও মুঘল সম্রাট বাবর সমসাময়িক ছিলেন। বাবরের ভারত আক্রমণ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন শিখপন্থের প্রতিষ্ঠাতা নানকদেব। বাবরের অত্যাচারে ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। কিভাবে বাবর আমাদের শস্য-শ্যামলা ভারতবর্ষকে তছনছ করেছিল তাই নিয়ে লিপিবদ্ধ করেছিলেন “বাবর গাথা” নামক প্রামাণ্য কাব্যকৃতি।
গুরু নানাক দেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাজার ১৪৬৯ সালে। পৃথিবীতে তাঁর জীবনকাল ১৫৩৯ সাল পর্যন্ত। বাবর ভারতে প্রথম আক্রমণ করে পঞ্জাবের এমনাবাদ অঞ্চলে ১৫২২ সালে। সেই সময় তিন বছরের বিদেশ ভ্রমণ শেষে স্বদেশে ফিরেছেন নানকদেব। খবর পেলেন, বাবরের খুনি সেনাবাহিনী এমনাবাদের হাজার হাজার নাগরিককে নিশংসভাবে হত্যা করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটিতে মৃত নগরীতে পরিণত করেছে। এমনাবাদের প্রজাদের প্রতি সমবেদনা তিনি ভারাক্রান্ত হলেন। ছুটে গেলেন অকুস্থলে। চারিদিকে রক্ত আর ধ্বংসের স্তূপ দেখে, শোকাতুর হয়ে তিনি বাবরের নির্মমতার আখ্যান গাইতে লাগলেন। হাতে রাবার নামের বাদ্যযন্ত্রটি। তাঁর মুখনিঃসৃত বাবরের অত্যাচারের কাহিনিই “বাবর গাথা” নামে পরিচিত।
বাবরের মুঘল সৈন্য এমনাদাবাদ নগরজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে তখন। তাদের ঘোড়ার খুরে দলিত হচ্ছে অসহায় মানুষ। প্রজারা যে যেখানে পারছে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটছে। হাত পড়েছে নারীদের সম্ভ্রমে। একদিকে নিরীহ নগরবাসীদের হাহাকার, অন্যদিকে অত্যাচারী মুঘলসেনাদের পৈশাচিক উল্লাস। চারদিকে লুট-মারের চিহ্ন! আতঙ্কিত পুরুষদের ধরে ধরে লুটের মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে মুঘল সেনারা। সেই সময়ে গুরু নানাকদেবও এমনাবাদে রাস্তার ধারে উপস্থিত। নিরীহ মানুষের ওপর মুঘলদের এই বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে নানকদেব বলে উঠলেন, ‘সত্য নাম, করতা পুরুষ।’ অর্থাৎ এক ওঙ্কার, এক পরমপুরুষ সত্য ব্রহ্ম। তিনি ওয়াহে গুরুজী। এই প্রবচন শুনে তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মুঘল সেনারা। উঁচু কাঁধের বলিষ্ঠ, শক্ত-সামর্থ্য নানকদেবকে দেখে মুঘল সেনারা তাঁকে দিয়ে লুটের মালপত্র বইতে নির্দেশ দিল। নানকদেব অস্বীকার করলেন। বাবরের সৈন্যরা তাঁকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে অন্যান্য নগরবাসীর সঙ্গে কয়েদখানায় বন্দি বানালো।
কারাগারের অন্ধকূপ আলোকিত করে কীর্তন গাইতে শুরু করলেন গুরু নানক। তাঁর চারপাশে জ্যোতির্বলয়। কুয়েদখানার দারোগা থেকে দ্বাররক্ষী - সবাই ভাবের জোয়ারে ভেসে গেল। নত মস্তকে বসে রইল মহান সাধকের সামনে। খবর পৌঁছালো বাবরের কাছে। মুঘল বাদশা ছুটে গেলেন কয়েদখানায়। নানকদেবের কুঠুরির কাছে পৌঁছে দেখলেন অবাক করার দৃশ্য। তাঁর সেপাই-সান্ত্রীরা নানকদেবের গুরুবাণী শুনেছে মুগ্ধ হয়ে!
গুরু নানকের আধ্যাত্বিক মাহাত্ম্য সম্পর্কে আগেই শুনেছিলেন বাবর। এই প্রথম তাঁকে দর্শন করলেন। তাও কিনা নিজের কয়েদখানায় বন্দি রূপে। নানকদেবের সামনে মাথা নোয়ালেন বাবর।
গুরু নানক বলে উঠলেন, ‘সেই অকাল পুরুষকে ধন্যবাদ দিন বাদশাহ!’ বাবর ক্ষমাপ্রার্থী চেয়ে বললেন, ‘আমার সৈন্যরা আপনার সঙ্গে যে অভব্য আচরণ করেছে সেজন্য আমি খুবই দুঃখিত।’ নানকদেব বললেন, ‘ক্ষমা তুমি তাঁর কাছে চাও, যার সৃষ্টিকে তুমি পদদলিত করেছো। নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, আর অকারনে তাঁদের কারাবন্দি করে তুমি যে অন্যায় করেছো, সেই সব কিছুর জন্য তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
বাবর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে নানকদেবকে কথা দিলেন, আর কখনো কোনও নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন না।
গুরু নানক বাবরকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দরিদ্রকে বিরক্ত করতে নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করো না, বরং তাদের মন জয় করার চেষ্টা করো। বাবর গুরু নানক-সহ সমস্ত নগরবাসীকে সসম্মানে মুক্তি দিলেন।
বাবর ছিলেন ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম মুঘল বাদশাহ। ১৫১৯ সাল থেকে ১৫২৬ সালের মধ্যে পাঁচবার ভারত আক্রমণ করেন তিনি। শেষ দফায় আক্রমণে পানিপথের রণক্ষেত্রে ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থাপন হয় বাবরের হাতে।
বাবরের প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্য আগামীদিনে ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি, শাসনতন্ত্র, অর্থতন্ত্র, ধর্মীয়, এমনকি সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে – এমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন গুরু নানকদেব। এমনাবাদে মুঘলশাসনের শুরুটা চাক্ষুষ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল নানকদেবের ভবিষ্যৎবাণী।
গুরুগ্রন্থ সাহেবের নানকদেব বলেছেন – ‘ বাবর বাণী ফিরি গই কুইরু না রোড খাই।’ – যার মর্মার্থ, বাবরের সাম্রাজ্য যত বিস্তৃত হচ্ছে অত্যাচারও ততই বাড়ছে। বাবরের নির্দেশে শাহজাদিদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। কাব্যকৃতি ‘বাবরগাথা’য় সর্বমোট চার পংক্তিতে গুরুনানকের ভবিষ্যৎবাণী ও উপদেশ উদ্ধৃত রয়েছে। ‘বাবরগাথা’র প্রথম চরণে ‘লালো বড়োই’ নামে জনৈক ব্যক্তিকে সম্বোধন করে তিনি বলেছেন ‘হে লালো’! বাবর নিজের পাপের বোঝা নিয়ে আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে, আর জোর জবরদস্তি করে আমাদের ঘরের মেয়েদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে। ধর্ম আর লজ্জা দুইই আজ নিরুদ্দেশ। পাপ, মিথ্যা – এই দোষগুলি মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হে লালো! আমাদের এই মাতৃভূমিতে রক্তের দাগ লেগেছে। তবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুঘলদের স্থায়িত্ব ভারতে বেশিদিন হবে না। ততোদিনে, মর্দ কা চেলা’ জন্ম নেবে এই ভারতভূমিতে।
এখানে সম্ভবত, ১৫২২ সালে মুঘলদের ভারত আক্রমণ কোন ১৫৪১ এ সালে মুঘল সাম্রাজ্য পতনের ভবিষ্যতবাণী নিহিত রয়েছে। আর ‘মর্দ কা চেলা’ বলা হয়েছে শেরশাহ সুরিকে। শেরশাহ ১৫৩৮ ছেলে হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লিতে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
কাব্যকৃতির দ্বিতীয় চরণে গুরু নানকদেব লিখেছেন লিখেছেন, ‘হে ঈশ্বর ভারতে এখন বাবরের শাসন চলছে, তা সত্ত্বেও খুরসান প্রদেশ এখন সুরক্ষিত। কারণ তুমি তার প্রহরী। অথচ বাবর’ এর বর্বরতার আগুনে তুমি নিক্ষেপ করেছো হিন্দুস্থানকে। যমরূপী মুঘলদের দিয়ে ভারত আক্রমণ করিয়েছো তুমি। পরিনামে এত মার – দাঙ্গা হয়েছে যে ভারতবাসী আতঙ্কিত। ইশ্বর, তুমি কি এত নির্দয়!
তৃতীয় চরণে, নারীদের ওপর বাবরের হিংস্রতার বর্ণনা রয়েছে ছত্রে ছত্রে। বলা হয়েছে, ভারতের যে প্রতিব্রতা নারীদের সিঁথিতে সিঁদুর জ্বল-জ্বল করতো তাঁরা আজ মুণ্ডিত-মস্তক। এক সময় যারা অন্দরমহলে থাকতেন, মুঘলদের অত্যাচারে সড়কেও তাঁদের ঠাঁই মেলেনি। স্বামীহীনা, অভুক্ত ভারতীয় রমণীরা স্বামী-সন্তান হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
চতুর্থ চরণে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে সম্বোধন করে নানকদেব বলেছেন – ‘ আমি এই জগতের একটা অংশ মাত্র যার একমাত্রিক মালিক তুমি। তুমিই গড়ো আবার তুমি তার লয় করো। তুমিই সমস্ত কর্মের হোতা। তোমার নির্দেশেই সুখ-দুঃখ আসে আর যায়। এই হিন্দুস্থানের আজ যে দশা চলছে, তার সমাপ্তি হবে শীঘ্রই।
বাবরের ভারত আক্রমণ এবং মুঘলদের অত্যাচারে গুরু নানাকদেব কত ব্যথিত ও চিন্তিত ছিলেন তা এই কাব্যগ্রন্থ থেকে জানা যায়। তৎকালীন পরিস্থিতিতে তিনি যথেষ্ট নিরাশ ও হতাশ ছিলেন। কিন্তু সবটাই ঈশ্বরের লীলা মেনে নিয়ে সহ্য করেছিলেন। বাবরগাথায় যেভাবে বাবরের ভারত আক্রমণ ও সমকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন গুরু নানকদেব, নিঃসন্দেহে তা ভারতের ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
~ নিখিল চিত্রকর