কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সমালোচনা অনেকটাই লজঝড়ে হয়ে আসে, যখন আমরা নরেন্দ্র মোদীর স্বচ্ছ ভারত’ গঠনের গভীরতা ও সাফল্যের বিশ্লেষণ শুরু করি। এই উন্নয়ন সাময়িক নয়, এর বিস্তৃতিও ব্যাপক। সমালোচনা করার চেয়ে সহজকাজ আর দ্বিতীয়টা হয় না; অনেকের কাছে এটা আবার বেশ উপাদেয়, যেন চপ-পাকোড়া সমেত গরম চায়ে গলা ভেজানো। আমার অনুরোধ, একবার খোলা মনে বর্তমান সরকারের স্বচ্ছভারত অভিযানের অগ্রগতি নিয়ে ভাবুন, তথ্যাদি জোগাড় করুন। বট-অশ্বথের শিকডে থেকে থেকে ঘাই মারবার অভ্যেসটা কমে আসবে। কমবে। অস্থির কিচির-মিচির করবার প্রবণতাও। স্বচ্ছ ভারত মিশনকে কেন অভিনব বলা উচিত, প্রথমে তার ব্যাখ্যা করব। তথ্যাদি চর্চা করে দেখেছি, স্যানিটেশন নিয়ে এত বিশাল উদ্যোগ বিশ্বের আর কোনোও দেশ আজ অবধি গ্রহণ করেনি। ভারতেও পূর্ববর্তী কোনও সরকারই এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ঘামাবার মতো বোধশক্তিও ছিল কিনা সন্দেহ। ৫৫০ মিলিয়ন গ্রামীণ জনতার উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্মের অভ্যেস তথা ঐতিহ্য থেকে বের করে আনা যে কত বড় কঠিন কাজ, তা ভাবতে গেলেও মাথা ঘুরে যায়। একটা সরকার হরেক স্কিমের পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজে মুনসিয়ানা দেখাতেই পারে, কিন্তু কোটি কোটি মানুষের আজন্মলালিত কুঅভ্যাসের পরিবর্তন। আনার শপথ কোন কোন দেশের সরকার ইতিপূর্বে নিয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। ২০১৭ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশ মোতাবেক ‘কোয়ালিটি কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া সংস্থা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমীক্ষা চালিয়ে যে আস্ত রিপোর্টটি জমা দেয়, তাতে ছিল মোট ১ লক্ষ ৫০ হাজার পরিবারের কথা। সেই রিপোর্টকে ধরে আরও বিস্তারিত সমীক্ষা চালাবার পর সরকার যে ছবিটা পায়, তা কিন্তু বেশ উৎসাহজনক। বোঝা গেল, স্বচ্ছভারত মিশনের বিরামহীন প্রয়াসে এই দেশের ৯১ শতাংশ পরিবারে শৌচাগারের ব্যবহার বাস্তবায়িত হয়েছে।
কিন্তু মুশকিল হলো, উন্নয়নের এই ধারাকে অব্যাহত রাখা অত্যন্ত কঠিন কর্ম। এ রকম বিস্তর নিদর্শন আমাদের গোচরে এসেছে, বহু গ্রামাঞ্চলেই কিছু কিছু মানুষ আবার মাঠেঘাটে সাবেক অভ্যেসে ফিরে গিয়েছে। অর্থাৎ এর সাফল্যকে ধরে রাখতে হলে দরকার এক ধারাবাহিক গণ-আন্দোলন। কেবলমাত্র সরকারি কানুনের ডানা-ঝাপটানিতে কাজ হবে না। তদনুযায়ী ২০১৭ থেকে শুরু করে এই ২০১৯ সনের শেষার্ধ অবধি চলেছে এক সার্বিক ও শশব্যস্ত গণজাগরণ প্রকল্প। মাঝে মাঝেই চালানো হয় সমীক্ষা। ইতিমধ্যে গ্রামীণ ভারতের ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্মের বদঅভ্যেস থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছে। এ আন্দোলন চলবে। চালাতেই হবে এবং এর জন্য প্রয়োজন নরেন্দ্র মোদীর ন্যায় ঋজু ব্যক্তিত্বের ধারাবাহিক নেতৃত্ব। এই মুহূর্তে সারা ভারতের ৪ লক্ষ ২৫ হাজার গ্রামকে Open Defecation Free অর্থাৎ শৌচকর্মের রেওয়াজবিহীন রূপে আমরা মান্যতা দিতে পারছি। যে পাঁচটি রাজ্য এই বিষয়ে অন্যান্য রাজ্য থেকে এগিয়ে আছে, তারা হলো উত্তরাখণ্ড, সিকিম, কেরালা, হরিয়ানা এবং হিমাচলপ্রদেশ। প্রায় সংখ্যাতীত শৌচগার নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। হাতে মগ বা জলের ঘোট বালতি ঝুলিয়ে মাঠে ময়দানে কিংবা ঝোপঝাড়ের দিকে দৌড়তে দৌড়তে চলেছে ওই লোকটা—এ রকম দৃশ্যের সংখ্যা প্রতিদিন কমছে। এটা কোনোও গুণিনের কেরামতিতে সম্ভব হয়নি; সম্ভব হয়েছে সরকারি অনুপ্রেরণায় সংগঠিত এক সর্বভারতীয় গণআন্দোলনে যাকে আরও অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে।
কেবল কতগুলো শৌচাগার তৈরি করা হলো, সেই পরিসংখ্যান নিয়ে আত্মতুষ্টির অবকাশ এখানে নেই। দেখতে হবে, মগ হাতে ছোটাছুটি করা লোকের সংখ্যা কতটা কমেছে। আরও সোজা কথায় এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে সাধারণ মানুষকেও। সরকারি প্রকল্প, অতএব আমি যমন আপন পরিবারকে নিয়ে গুড়িশুড়ি মেরে থাকি, তেমনটিই থাকব, এই ধরনের মানসিকতা না করে ত্যাগ করতেই হবে। সমাজ উন্নয়নে আমি নিজে যদি যুক্ত না হতে পারি, আমার নিজস্ব অন্তর্লোকেই আলোর চেয়ে অন্ধকারের প্রাধান্য থাকবে অধিকতর। বিশেষ লক্ষণীয় যে, প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছভারত মিশনকে সফল করতে পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ ব্যাপকতর। ২০১৭ সনের আন্তর্জাতিক নারীদিবসে নরেন্দ্র মোদী তথ্যসহ এই কথা জানিয়েছেন। ৬ হাজার মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানদের এক জমায়েতে তিনি দেশের মাতা, ভগ্নী এবং কন্যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং এই আন্দোলনে পুরোধা ১০জন মহিলাকে ‘স্বচ্ছতা চ্যাম্পিয়ান’ পুরস্কারে ভূষিত করেন।
তাছাড়া বর্জ্যপদার্থকে সঠিক পদ্ধতিতে পরিশোধিত করতে পারলে তা যে কৃষিভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠবে, প্রধানমন্ত্রী বারংবার তা উল্লেখও করেছেন। প্রকৃতপক্ষে স্বচ্ছভারত মিশন এমন এক কর্মসূচি, যাকে সফল করবার জন্য দেশের তাবৎ সরকারি মেশিনারিকেই কাজে লাগান হচ্ছে। কর্পোরেট দুনিয়াকেও দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল সূচনামুহুর্তেই। সেই আবেদনে সবচেয়ে জোরালোভাবে টাটার অছি পরিষদ (Tata Trust) সাড়া দিয়েছে। শুধুমাত্র এই কাজে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে টাটা কোম্পানি ৬০০ জন পেশাদারকে নিয়োগ করে এবং বহু জেলা প্রশাসন তাদের সহায়তা পেয়ে এতই মুগ্ধ হয় যে তাদের বাক্যস্ফূর্তিরও যেন অবকাশ থাকে না। অথচ সরকারের সঠিক বা বেঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলা যাঁদের নিত্য নৈমিত্তিক অভ্যেস, তারা নিশ্চ পই থাকলেন। গণতান্ত্রিক সুস্থতাকে লয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে যুগপৎসমালোচনা ও সমর্থন দুয়েরই যে দরকার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল বহু বছর আগেই তা বলে গিয়েছেন।
‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’আন্দোলন সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯ তারিখ অবধি ৬,৭৯,৩৩,৯৬৩ টিরও বেশি শৌচালয় তৈরি করে দিয়েছে ৩, ৩২,৭১৯ টি গ্রামীণ লোকালে। এটা অবশ্যই এক অচরাচর নজির। স্বচ্ছ সংকল্প থেকে স্বচ্ছ সিদ্ধিলাভ এই ভাবেই দ্রুততার সঙ্গে অর্জিত হতে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর সবল পৌরোহিত্যে। আমরা আশাবাদী, সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন ভারতের প্রতিটি গ্রাম চরিত্রে ও পরিচ্ছন্নতায় এক একটি পঞ্চবটী হয়ে উঠবে।
শেখর সেনগুপ্ত
2020-01-17