নেপালি রামায়ণ

নেপালি ভাষায় লেখা রামায়ণের যে প্রাচীনতম পুঁথিটি পাওয়া গেছে তা ১৮৩৩ সালের। পুঁথিটির নাম ‘রাম অশ্বমেধ’। পুঁথিটির লেখক অবশ্য কে তা জানা যায়নি। নেপালি ভাষায় রামায়ণের প্রসঙ্গ উঠলেই সাধারণত আদিকবি ভানুভক্ত আচার্যের নাম স্মরণে আসে। যদিও তারও আগে নেপালিতে রামায়ণ লেখা হয়েছে। সুন্দরানন্দ ১৮৩৯ সালে ‘সপ্তকাণ্ড রামায়ণ’ লেখেন নেপালি গদ্যে। সমগ্র রামায়ণটি সুন্দরানন্দ ২১৯টি সর্গে বিন্যস্ত করেন। এখানে বলার যে। সুন্দরানন্দের রামায়ণ কোনোভাবেই মূল রামায়ণের অনুবাদ নয়। বহু জায়গায় তিনি নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। বস্তুত তাঁর রামায়ণের উপর পূর্ববর্তী দুইটি সংস্কৃত রামায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর একটি হলো অধ্যাত্ম রামায়ণ, অপরটি বাল্মীকি রামায়ণ। তাঁর রামায়ণের প্রথম কয়েকটি কাণ্ড তিনি অধ্যাত্ম রামায়ণ অনুসরণে লিখেছেন। স্থানে স্থানে নেপলের প্রেক্ষিত ব্যবহার করে তিনি তার রচনার স্বকীয়তা দেখিয়েছেন।

সুন্দরানন্দ ও আচার্য ভানুভক্তের রামায়ণের রচনার অন্তর্বর্তী সময়ে আমরা রামায়ণের কাব্যানুবাদ পাচ্ছি। অবশ্য নেপালি ভাষায় রচিত হলেও তা প্রকাশ পেয়েছে বারাণসী থেকে। মনে করা হয়, পণ্ডিত রঘুনাথ ভট্টের অধ্যাত্ম রামায়ণের অনুবাদ ভানুভক্তের রামায়ণের পূর্ববর্তী। ভট্টমশাই বয়েসেও আচার্য ভানুভক্তের। চেয়ে কিছুটা বড়ো ছিলেন। যাইহোক, তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৮ সালে, ভানুভক্তের রামায়ণ প্রকাশের এক বছর পর।

নেপালি সাহিত্যে ‘আদিকবি’ সম্মানে বিভূষিত ভানুভক্ত আচার্যের জন্ম ১৮১৪ সালে ১৩ জুলাই, মধ্য নেপালের তানুহান (তানুহা) জেলার রামখা বা রামঘা গ্রামে। ভানুভক্তের বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বংশ। তার নিজেরও শিক্ষা হয়েছিল ঠাকুরদা সুপণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের কাছে। বৃদ্ধ বয়সে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য বারাণসীতে বাস করতেন। সে সময়ে ভানুভক্ত তার । ঠাকুরদার সঙ্গেই এখানে থাকতেন। এর ফলে হিন্দুশাস্ত্র, সংস্কৃত ইত্যাদি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জনের বিশেষ সুযোগ তাঁর। ঘটেছিল। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য নিয়মিত ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’ পাঠ করতেন। এই রামায়ণ। ভানুভক্তের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ঠাকুরদা বারাণসীতে দেহ রাখার পর, তিনি যখন নেপালে তার পৈতৃক ভিটেয় ফিরে এলেন, একটি বিষয় তাঁকে বারংবার ভাবিত করতে থাকল। এই ভাবনাটি হলো, এত সুন্দর সুললিত রামায়ণ কাব্যরস তার দেশবাসী আস্বাদন করতে পারছেন না— কেননা তাঁরা। সংস্কৃত পাঠে অক্ষম। দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক ভাবেও তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করছেন। এই সমস্যা নিরসনের মানসে তিনি স্থির করলেন, নেপালিভাষায়। রামায়ণ রচনা করবেন। নেপালিভাষার প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে সুললিত ছন্দে রামায়ণ পরিবেশন করলেন ভানুভক্ত। প্রথমেই লিখলেন ‘বাল কাণ্ড। মাত্র। তিরিশ বছর বয়েসে এই “বাল কাণ্ড’ তিনি সম্পূর্ণ করেন। ধীরে ধীরে বাকি কাণ্ডগুলি তিনি শেষ করেন। কবি ভানুভক্ত শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৮৬৯ সালে। আর তার রামায়ণ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। ভানুভক্তের রামায়ণে মোট ১৩১৯টি শ্লোক রয়েছে। তার রামায়ণে বালকাণ্ড, অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্য কাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড, সুন্দর কাণ্ড, যুদ্ধ কাণ্ড ও উত্তর কাণ্ড— এই সাতটি কাণ্ড রয়েছে।

ভানুভক্তের পরও নেপালিতে রামায়ণ লেখা হয়েছে। এর মধ্যে পণ্ডিত চক্রপাণি চালিসের লেখা ‘নেপালি। সংক্ষিপ্ত রামায়’ উল্লেখযোগ্য। পণ্ডিত চক্রপাণিও বারাণসীতে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত করেছেন। এখান থেকে । প্রকাশিত দুটি নেপালি পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আরও একটি কথা উল্লেখ্য যে, তিনি প্রথম নেপালের জাতীয় সংগীতের কথা লিখেছিলেন। রামায়ণ ছাড়াও সংক্ষিপ্ত মহাভারত, মনুস্মৃতি ইত্যাদি নেপালিভাষায় পরিবেশন করার কৃতিত্বও তাঁর। যাইহোক, পণ্ডিত চক্রপাণির চালিসের রামায়ণ প্রথম প্রকাশ পায়। ১৯২৫ সালে। নেপালিভাষায় রামায়ণ রচনার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ভৈরব সিংহ থাপার ‘আত্ম রামায়ণ। এটিও মূলত ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’-এর প্রভাবপুষ্ট লেখা। যদিও শ্রী থাপা হিন্দিভাষায় রচিত কয়েকটি রামায়ণের সাহায্যও গ্রহণ করেছেন।‘আত্ম রামায়ণ’ মূলত রামায়ণ কাহিনির রূপকে এক ধরনের আধ্যাত্মিক অন্বেষণ। এখানে শ্রীরামচন্দ্র জ্ঞানের প্রতীক, সীতা শান্তির, লক্ষ্মণ বিবেক এবং ভরত বৈরাগ্যের প্রতীক।

ভৈরব সিংহ থাপার ‘আত্ম রামায়’-র অল্পকাল পূর্বে দুটি উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচিত হয়। এর একটি হলো সোমনাথ সিগদেলের ‘আদর্শ রাঘব’ (১৯৪৮) আর অন্যটি লোকনাথ শৰ্মা পাউদালের ‘মেরো রাম’ (১৯৫৪)। সোমনাথ সিগদেল কেবলমাত্র বিশিষ্ট কবি ছিলেন তাই নয়, সংস্কৃত ভাষায় তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত।

পড়াশোনার সূত্রে কলকাতার সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। এখান থেকেই সংস্কৃত ‘কাব্যতীর্থ’ উপাধি তিনি লাভ করেন। সিগদেল মশাইয়ের রামায়ণ মুখ্যত বাল্মীকির ‘আদি রামায়ণ অনুসারে লেখা। এর বিশেষত্ব হলো, এখানে কোনো কাণ্ড’ বিভাগ নেই। সম্পূর্ণ রামায়ণটি ১৬টি সর্গে বিভক্ত। এই রচনায় প্রায় ২০-২২টি ভিন্ন ছন্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। লোকনাথ। শর্মার ‘মেরো রাম’অর্থাৎ আমার রাম বিরচিত হয়েছে অধ্যাত্ম রামায়ণের ভিত্তিতে। মূল কথাগুলিকে গদ্যছন্দে সংক্ষেপে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন লেকনাথজী। এজন্য তার রামায়ণ ‘মেরো। রাম’-এর অপর নাম ‘রামায়ণ সার’। এখানে অবশ্য সাত কাণ্ডেই রামায়ণ তিনি লিখেছেন। কিন্তু ভানুভক্তের রামায়ণে যেখানে । সহস্রাধিক শ্লোক রয়েছে, মেরো রাম’-এ শ্লোক সংখ্যা ২৭৫টি।

এই সমস্ত রামায়ণ ছাড়া আরও কয়েকটি রামায়ণ মৌলিক ভাবে রচিত, অনুসৃত এবং অনুদিত হয়েছে নেপালিভাষায়। এর মধ্যে পণ্ডিত রামকান্ত বড়ালের ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত ‘অদ্ভুত রামায়ণ’-এর কথা প্রথমেই বলতে হয়। নেপালিতে তুলসীদাসী রামায়ণের অনুবাদ করেছিলেন পণ্ডিত কুলচন্দ্র গৌতম (১৮৭৫-১৯৩৮)। তুলসীদাসের রামায়ণের অনুসরণে আরেকটি নেপালি রামায়ণ হলো পণ্ডিত রেওতিরাম নিওপানিয়ার (১৮৭৬১৯৪৩) “অগ্নিবেশ রামায়ণ। পণ্ডিত কালিদাস পরাজুলি (১৮৮১-১৯৫০) ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নেপালিতে অনুবাদ করেন। আবার, ১৯০১ সালে পণ্ডিত ভোজরাজ শর্মা লেখেন। ‘আনন্দ রামায়ণ’। এখানে মাতা পৃথিবী সীতাকে আপন অঙ্গে স্থান দেবার পর, শ্রীরামের ভয়ে আবার তাকে ফিরেয়ে দেন। অতঃপর কতকগুলি নতুন কাণ্ডে এই কাহিনি বিবৃত হয়েছে। যে সকল নতুন কাণ্ড এতে রয়েছে সেগুলি হলো বিবাহকাণ্ড, রাজ্যকাণ্ড, মনোহরকাণ্ড ও পুরাণকাণ্ড। ১৯৩৩ সালে খাদগা বাহাদুর শ্রেষ্ঠ (১৮৭২-১৯৪৫) “রাধেশ্যাম রামায়ণ’-এর একটি কাণ্ড (বালকাণ্ড’) প্রকাশ করেন। এই সম্পূর্ণ রামায়ণটি প্রকাশ পায় ১২ বছর পরে। পণ্ডিত তারানাথ শর্মা বাল্মীকির রামায়ণের। অনুসরণে লক্ষ্মণের শক্তিশেল কাহিনি বর্ণনা করেছেন ‘রামের বিলাপ’-এ। এর বাইরে পূর্ণপ্রসাদ শর্মার ‘বৈজ্ঞানিক রামায়ণ ও লক্ষ্মীপ্রসাদ দেওকোটার ‘সীতা হরণ’ রামায়ণ রচনার ধারায় সাম্প্রতিক সংযোজন।

নেপালে রামায়ণের প্রসঙ্গ সাম্প্রতিককালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর একটি দাবিকে কেন্দ্র করে। নিজ বক্তব্যের সমর্থনে,তার যুক্তি , সুদূর অযোধ্যার সঙ্গে মিথিলার (যা কিনা নেপালে) বিবাহ সম্ভব ছিল না। কেননা এত দূরে যাতায়াতের পথ এবং যানবাহন সে সময় থাকা সম্ভব নয়। রামায়ণ যারা খুঁটিয়ে পড়েছেন, তারা জানেন, এই কাহিনিতেই রাম-সীতার বিবাহের পূর্বেই আরও দূরবর্তী দুটি অঞ্চলের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ও যাতায়াতের উল্লেখ রয়েছে। অযোধ্যার নৃপতি দশরথের দ্বিতীয় মহীষী কৈকেয়ী ছিলেন কেকয়রাজ কন্যা। পুরাতত্ত্ববিদরা এই কেকয় রাজ্যের রাজধানীর স্থান চিহ্নিত করেছেন অধুনা লাহোরের সন্নিকটে। শুধু তাই নয়, বয়োপ্রাপ্ত হয়ে ভরত নিজে এই মাতুলগৃহে গমনাগমন করেছেন। ভরতের যাত্রাপথের পথরেখা যদি অনুসরণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে। এই যোগাযোগ অসম্ভব ছিল না। পুরাতাত্ত্বিক অন্বেষণেও অনুরূপ একটি পথের অস্তিত্বের কথা স্বীকৃত হয়েছে। পণ্ডিত সোমনাথ সিগদেল তার আদর্শ রামায়ণ’-এর কাহিনিকে প্রাচীন ভারতের এক আদর্শ দম্পতির উপাখ্যান বলেছেন— যাদের একজন নেপালের বাগমতী তীরের সীতা এবং পরজন ভারতের সরযুনদীর তীরে অযোধ্যার রাম।

পাদটীকা :

১. “রামাশ্বমেধ কাণ্ড’ নামের আরেকটি রচনার পরিচয় পাওয়া যায়, যার লেখক সুব্ব হোমনাথ খাতিয়ারা (১৯৫৪-১৮২৭৪। এটিকে প্রথমে তিনি ভানুভক্তের রামায়ণের অষ্টম সর্গ হিসেবে প্রকাশ করেন।

২. এখানে উল্লেখ্য যে ভানুভক্তের আগে গুমানিপন্থ (১৭৯০-১৮৪৬) এবং পণ্ডিত রঘুনাথ ভট্ট (১৮১১-১৮৬১) রামায়ণ ভিত্তিক কাব্য-কবিতা লিখেছেন। রঘুনাথ ভট্টের রামায়ণ আসলে নেপালি ভাষায় ‘অধ্যাত্ম রামায়ণের সপ্তকাণ্ডের অনুবাদ। পণ্ডিত রঘুনাথের রামায়ণ অবশ্য ভানুভক্তের রামায়ণ প্রকাশিত হবার পর, ১৮৮৮ সালে প্রকাশ পেয়েছিল।

৩. সুন্দরানন্দের পদবি কেউ লিখছেন বাউড়া, কোথাও বা বানড়া অথবা বাঁড়া (Banrah)।

ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.